ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

দগ্ধ স্বামীর পাশে স্ত্রী চম্পার আহাজারি

উনারে বাঁচাইয়া আল্লা আমারে উঠাই নেও...

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ২৯ জানুয়ারি ২০১৫

উনারে বাঁচাইয়া আল্লা আমারে উঠাই নেও...

শর্মী চক্রবর্তী ॥ ‘আমি বাসায় একা থাকতে পারি না। ভয় লাগে। তাই সেদিন এত রাতে উনি ঢাকা থেকে বাড়ি যাচ্ছিলেন। আমার জন্যই আজ উনার এই অবস্থা হয়েছে। এত রাতে না গেলে তো আজ তাকে এভাবে পুড়তে হতো না। নিজেকে খুব বেশি অপরাধী মনে হচ্ছে।’ এভাবে কথাগুলো বলতে বলতে দু’চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল দগ্ধ নূরে আলমের স্ত্রী চম্পা বেগমের। দগ্ধ স্বামীর বেডের পাশে দাঁড়িয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তিনি। কখনও স্বামীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন, কখনও আবার স্বামীর মুখ দেখে নীরবে চোখের পানি ফেলছেন। বুকের মধ্যে কষ্ট চাপা নিয়ে স্বামীর দেখাশুনা করছেন। ছুটছেন ডাক্তার নার্সের কাছে। আর কেউ নেই চম্পা বেগমের। সন্তানহীন স্ত্রীর স্বামীই একমাত্র ভরসা। স্ত্রীর এমন বিলাপ শুনে নূরে আলমের চোখ দিয়েও পানি গড়িয়ে পড়ছিল। স্ত্রীকে সান্ত¡না দিচ্ছিলেন, ‘তুমি কাইন্দো না আমি ভাল হইয়া যামো।’ বুধবার ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে এইচডিইউতে চিকিৎসাধীন নূরে আলমের বেডের কাছে এমন দৃশ্যই দেখা যায়। পুড়ে যাওয়া শরীরের যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছেন না তিনি। বেডে শুয়ে সর্বক্ষণ কাতরাচ্ছেন। স্বামীর এই অস্থিরতা দেখে চম্পা বেগমও পাগলের মতো হয়ে যান। একবার গিয়ে নার্সকে ডাকেন তো আর একবার ডাক্তারকে। সবাইকে ডাকাডাকি করে বলছেন, উনি তো যন্ত্রণায় ছটফট করছেন আপনারা এসে একটু দেখেন না। নার্স বললেন, ড্রেসিং করা হয়েছে তাই একটু বেশি কষ্ট হচ্ছে। আপনি চিন্তা করবেন না। আবার স্বামীর কাছে গিয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, ‘একটু সহ্য করো আস্তে আস্তে যন্ত্রণা সেরে যাইবো।’ স্বামীকে শান্ত করতে পারলেও নিজেকে তখনও শান্ত করতে পারছিলেন না চম্পা বেগম। ২৩ তারিখ শুক্রবার রাতে পেট্রোলবোমায় দগ্ধ হন নূরে আলম (৪০)। ঢাকা থেকে বাড়ি ফেরার পথে যাত্রাবাড়ী এই হামলার শিকার হন তিনি। তাঁর শরীরের প্রায় ৪৮ শতাংশ আগুনে পুড়ে গেছে। মুখ হাত ও শরীরের কিছু অংশ ঝলসে গেছে। চম্পা বেগম স্বামীর কাছে বসে পোড়ার যন্ত্রণা কম হওয়ার জন্য হাত পাখা দিয়ে বাতাস করছেন। নূরে আলম রাজউকে সাব-কন্ট্রাক্ট হিসেবে কাজ করেন। থাকেন সোনারগাঁওয়ের পেচাইং গ্রামে। প্রতিদিন সেখান থেকে ঢাকায় আসেন। পরিবারে স্ত্রী চম্পা বেগম ছাড়া আর কেউ নেই। ৮ বছরের সংসার তাদের। কোন সন্তান নেই। চম্পা বেগম বলেন, ‘এ ঘটনার আগের দিন উনি আমারে বলেছিল চলো কাল আমরা চিড়িয়াখানায় যাই। তখন আমি তাকে বললাম দেশের যে অবস্থা এখন যাওয়ার দরকার নেই। দেশের পরিস্থিতি ভাল হোক তারপর যাব। এই ঘটনার তিন মাস আগে একবার সড়ক দুর্ঘটনায় তার ডান হাত ও পা ভেঙ্গে গিয়েছিল। এ সময় থেকে তার ছোট বোনের সঙ্গে দেখা হয়নি। সেদিন বিকেলে উনার ছোট বোন হেনা ফোন দিয়ে বলে, ভাই অনেক দিন হলো আমি তোমাকে দেখি না। তোমাকে দেখতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে, আমার বাসায় আজ একটু আস না। বোনের কথা শুনে সেদিন বিকেলে মিরপুরে যান। সেখানে যাওয়ার পর ভাই বোন দুজনে কথা বলতে বলতে রাইত হইয়া যায়। তখন তার বোন হেনা বারবার বলছিল ভাই রাত হয়ে গেছে আজ যাওয়ার দরকার নেই, থেকে যাও। তখন তিনি বলেন, না আজ থাকব নারে তোর ভাবি একা বাসায় সে একা থাকতে পারে না। ভয় পায়। এর মধ্যে দেশের অবস্থা ভাল নয়। আমি বাড়ি চইলা যাই। এ কথা বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন তিনি। এরপরই গাড়িতে পেট্রোলবোমায় তিনি দগ্ধ হন। আমি খবর পেয়ে ঢাকা মেডিক্যালে আইসা দেখি তার শরীর ও মুখ পুইড়া গেছে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে চম্পা বলেন, ‘আট বছরের সংসার আমাদের। আমার কোন ছেলেমেয়ে নেই। ৪ বছর আগে একটা ছেলে হয়েছিল। জন্মের কয়েক ঘণ্টা পরেই বাচ্চাটা মারা যায়। বাচ্চাটা মারা যাওয়ার পর থেকেই আমি অনেক ভেঙ্গে পড়েছিলাম। তখন থেকেই উনি আমার সঙ্গে সবসময় থাকার চেষ্টা করে। আমার যাতে কোন কষ্ট না হয় সেজন্য একা থাকলেই আমাকে বিভিন্নভাবে মন ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করে। প্রতিসপ্তাহে আমাকে বাইরে ঘোরাতে নিয়ে যায়। আমি জানি আমাদের সন্তান নাই এতে উনারও খুব কষ্ট হয়। তারপরও আমার সামনে কোন দিন কিছু বলে না। যে আমার কষ্টের কথা চিন্তা করে এত কিছু করে, আজ তার এই কষ্ট আমি একটুও কমাতে পারছি না। তার কিছু হলে মরণ ছাড়া আমার কিছুই করার থাকবে না। এই পৃথিবীতে আমার স্বামী ছাড়া আর কেউ নেই। আমাদের কী অন্যায়? আমাদের কী ভুল? ৪ বছর আগে সন্তান হারাইছি এখন যদি স্বামীর কিছু হয় তাহলে আমি কই গিয়া দাঁড়ামু। তারে বাঁচাইয়া তুমি আমারে উঠাই নেও আল্লা। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে বর্তমানে ৪৭ রোগী ভর্তি আছেন। এর মধ্যে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) আছেন ছয়জন। ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে বুধবার দুপুরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়। সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন বার্ন ইউনিটের সমন্বয়কারী ডাঃ সামন্তলাল সেন। এ ছাড়া উপস্থিত ছিলেন বার্ন ইউনিটের প্রকল্প পরিচালক ডাঃ আবুল কালাম ও প্রফেসর ডাঃ সাজ্জাদ খন্দকার প্রমুখ। ডাঃ সামন্তলাল সেন জানান, আইসিইউতে থাকা দু’জনের শারীরিক অবস্থার উন্নতি হওয়ায় তাদের জেনারেল বেডে স্থানান্তর করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, যাত্রাবাড়ীর সহিংস ঘটনাসহ অন্যান্য জেলা থেকে আসা দগ্ধ রোগীদের মধ্যে আটজনের অবস্থার উন্নতি হওয়ায় তাদের সোম অথবা মঙ্গলবারের মধ্যে রিলিজ দেয়া হবে। এদিকে বার্ন ইউনিটে পেট্রোলবোমায় আহতদের দেখতে যান বিডিআর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ। তিনি আহতদের প্রত্যেককে ১০ হাজার টাকা ও ফলের ঝুড়ি প্রদান করেন।
×