ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বিএনপি নেতা বাবুলের নির্দেশে টাকার লোভে বোমা মারে নাইম

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ২৯ জানুয়ারি ২০১৫

বিএনপি নেতা বাবুলের নির্দেশে টাকার লোভে বোমা মারে নাইম

গাফফার খান চৌধুরী ॥ টাকার লোভ আর বিএনপি নেতাদের নির্দেশে সামান্য হোটেলবয় থেকে রীতিমতো বোমাবাজ হয়ে উঠে নাইম। মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর পল্লবী থেকে দুইটি পেট্রোলবোমা ও দুইটি ককটেলসহ গ্রেফতারের পর নাইম এমন তথ্যই দিয়েছে পুলিশকে। তাকে দুই দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। উদ্ধারকৃত বোমাগুলো নাইম ও তার তিন সহযোগীর কাছে সরবরাহ করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থানা বিএনপি নেতা চালক বাবলু ওরফে বাবু। মোটা টাকার প্রলোভন আর ভয় দেখিয়ে বিএনপি নেতা বাবু বোমাগুলো নাইম ও তার সহযোগীদের দিয়ে কালশী মোড়ে যাত্রাবাহী বাসে আগুন ধরিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেয়। শুধু ঢাকায় নয়, দেশের বিভিন্ন জেলায় বিএনপি-জামায়াত-শিবির ছাড়াও টোকাই, মাদকাসক্ত যুবক, বখাটে, হোটেলবয়, ট্রাক-বাস বা লেগুনার অশিক্ষিত বা স্বল্প শিক্ষিত হেলপারদের দিয়ে টাকার বিনিময়ে বোমাবাজ গ্রুপ তৈরি করে নাশকতা চালিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় বিএনপি নেতা ও কমিশনার হাসানের প্রত্যক্ষ মদদ আর বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশে কালশী মোড়ে বোমা হামলা, যানবাহন ভাংচুর আর অগ্নিসংযোগের দায়িত্ব দেয়া হয় বাবুকে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বোমাবাজি, যানবাহন ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের নির্দেশদাতা হিসেবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম, যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক হাবিবুন নবী খান সোহেল, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী শিমুল বিশ্বাস, প্রেস সচিব মারুফ কামাল খানসহ শীর্ষ স্থানীয় ৯ জনকে এজাহারনামীয়সহ অজ্ঞাত কয়েকজনকে আসামি করে পল্লবী থানায় একটি মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। মঙ্গলবার রাত পৌনে দশটার দিকে পল্লবী থানাধীন কালশী নতুন রাস্তা মোড়ে ইসলামিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে বিএনপি-জামায়াত-শিবিরের ৩০ থেকে ৪০ জন নেতাকর্মী আচমকা বিভিন্ন গলি থেকে বের হয়ে চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে যানবাহন ভাংচুর করে। যানবাহন ভাংচুর শেষে প্রজাপতি পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাসে ককটেল ছুড়ে মারে। কিন্তু ককটেলটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। বিকট শব্দে ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটলে অদূরে থাকা পুলিশ আর জনতা বোমাবাজদের ধরতে ধাওয়া করে। অন্ধকারে নাশকতাকারীরা বিভিন্ন গলিতে ঢুকে পড়ে। এরপর পুলিশ আর জনতা মিলে বিভিন্ন গলিতে তল্লাশি চালাতে থাকে। তল্লাশির এক পর্যায়ে একটি গলির দেয়ালের আড়াল থেকে দুইটি পেট্রোলবোমা আর দুইটি ককটেলসহ নাইম ধরা পড়ে। শুরু হয় নাইমকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ। পকেটে ককটেল থাকায় নাইম বিস্ফোরণে আহত হওয়ার ভয়ে জোরে দৌড়াতে পারছিল না। সে বাধ্য হয়ে কালশী মোড়ের একটি অন্ধকার গলির দেয়ালের আড়ালে লুকায়। এ কারণে পুলিশ ও জনতা তাকে তল্লাশি চালিয়ে ধরে ফেলতে সক্ষম হয়। নাইমের কাছ থেকে উদ্ধার হয় দুইটি পেট্রোলবোমা আর দুইটি ককটেল। গ্রেফতারের পর নাইমকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, নাইমের পিতার নাম রফিকুল ইসলাম। সে পরিবারের সঙ্গে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থানাধীন মানিকদীর আমতলী এলাকার কালু সর্দারের বাড়িতে থাকত। জন্ম ঢাকাতেই। অভাবের সংসারে লেখাপড়া হয়নি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়েছে। এরপর স্থানীয় হোটেলের বয় হিসেবে কর্মজীবন শুরু করে। হোটেলে না পোষায় লেগুনার হেলপার হিসেবে কাজ শুরু করে। লেগুনা থেকে বাসের হেলপার হয়। হেলপারী করার সুবাদে পরিচয় হয় বাসচালক ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থানা বিএনপি নেতা বাবলু ওরফে বাবুর সঙ্গে। বাবু বিএনপির স্বক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। গত ৬ জানুয়ারি থেকে দেশব্যাপী চলমান অবরোধে কালশী মোড়ে অন্তত ৮ থেকে ১০টি গাড়ি ভাংচুর, পেট্রোলবোমা ও ককটেল হামলার শিকার হয়। প্রতিটির ঘটনার নেপথ্যে রয়েছে বাবু। কালশী মোড়সহ আশপাশের এলাকায় যানবাহনে ভাংচুর ও পেট্রোলবোমা মেরে অগ্নিসংযোগ করার দায়িত্ব পেয়েছে বাবু। স্থানীয় বিএনপি নেতা ও কমিশনার হাসানের সরাসরি মদদে আর বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশে বাবু তার লোকজনদের দিয়ে কালশী এলাকায় বোমাবাজি, যানবাহন, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগসহ নানা ধরনের নাশতকতামূলক কর্মকা- চালিয়ে আসছে। ধারাবাহিক নাশকতামূলক কর্মকা-ের অংশ হিসেবে গত মঙ্গলবার রাতে নাইম ও তার তিন সহযোগীর কাছে ৩টি ককটেল ও ২টি পেট্রোলবোমা সরবরাহ করে বাবু। বোমাগুলো দিয়ে কালশী বা তার আশপাশে সুবিধাজনক স্থানে যাত্রীবাহী বাসে আগুন ধরিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেয় বিএনপি নেতা বাবু। আগুন ধরিয়ে দিলে এবং মানুষ মারা গেলে নাইমকে যথেষ্ট টাকা দেয়া হবে। তবে কি পরিমাণ টাকা দেয়া হবে, তা স্পষ্ট করে নাইমকে বলেনি বাবু। কাজ শেষে টাকা পাবে। এমন আশ্বাসের ভিত্তিতে, বাড়তি টাকার লোভে নাইমরা রাস্তার পাশে বোমা মারতে ওঁৎ পেতে থাকে। রাত পৌনে ১০টার দিকে প্রজাপতি পরিবহন সে পরিষ্কার করে। চারজন রাত সাড়ে ৯টার দিকে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে বিএনপি-জামায়াত-শিবির কালশী এলাকায় রাস্তা অবরোধ করে যানবাহন ভাংচুর শুরু করে। ভাংচুরকারীরা ঘটনাস্থল ত্যাগ করামাত্র পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথমে প্রজাপতি পরিবহনের একটি বাসে ককটেল মারা হয়। নির্দেশ অনুযায়ী দ্বিতীয় ধাপে পেট্রোলবোমা মারার কথা। কারণ প্রথমেই পেট্রোলবোমা মারলে যানবাহন ভাংচুরকারীর যদি দ্রুত সরে যেতে না পেরে ক্ষেত্রে দগ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এজন্য প্রথমে ককটেল এরপর পেট্রোলবোমা হামলা চালিয়ে বাসে আগুন দেয়া হয়। যাতে অবরোধকারীরা ততক্ষণে সরে যেতে পারে। অবরোধকারীরা যাতে পেট্রোলবোমার কবলে না পড়ে এজন্যই এমন পদ্ধতিতে হামলা চালানো হয়। এদিকে স্থানীয় বিএনপি নেতা ও কমিশনার হাসানের প্রত্যক্ষ মদদে এবং বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশে কালশীতে মঙ্গলবার রাতে যানবাহন ভাংচুর, বোমাবাজির ঘটনা ঘটার অভিযোগে একটি মামলা দায়ের হয়েছে। পল্লবী থানার উপ-পরিদর্শক খান মোঃ জোবায়ের হোসেন বিশেষ ক্ষমতা আইনে বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টায় মামলাটি দায়ের করেন। মামলায় আসামি করা হয়েছে নাইমকে বোমা সরবরাহকারী বাবু, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম, যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক হাবিবুন নবী খান সোহেল, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী শিমুল বিশ্বাস, প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান, ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি আজিজুল বারী হেলাল, বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য মোছা. পাপিয়া আক্তার ও বিএনপি নেত্রী সেলিনা আক্তারসহ অজ্ঞাত কয়েকজনকে। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি-জামায়াত-শিবির ছাড়াও সারাদেশে টাকার বিনিময়ে টোকাই, হকার, অল্প বয়সী স্বল্পশিক্ষিত বাস, ট্রাক বা লেগুনার হেলপার, হোটেলবয়, মাদকাসক্ত যুবক, বখাটেদের দিয়ে সারাদেশে যানবাহন ভাংচুর ও পেট্রোলবোমা দিয়ে মানুষকে জীবন্ত পুড়িয়ে মানুষ হত্যার মতো নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড চালানো হচ্ছে। এ ব্যাপারে পল্লবী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) বিপ্লব কিশোর শীলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জনকণ্ঠকে জানান, নাইম প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সহযোগীদের নাম প্রকাশ করেছে। আর বোমার সরবরাহকারী হিসেবে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থানা বিএনপি নেতা বাবুল ওরফে বাবুর নাম প্রকাশ করেছে। বাবু স্থানীয় বিএনপি ও দলটির কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশে কালশী মোড়সহ আশপাশের এলাকায় নাশকতা চালিয়ে আসছে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। আসামিদের গ্রেফতারে চেষ্টা চলছে।
×