ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রসালো ফল বাউকুল- স্বাদে আপেলের মতো ॥ বাড়ছে আবাদ

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ২৮ জানুয়ারি ২০১৫

রসালো ফল বাউকুল- স্বাদে আপেলের মতো ॥ বাড়ছে আবাদ

বিশ্বজিৎ মনি বাউকুল এমনই এক ফল যা দেখতে সুন্দর, খেতেও মিষ্টি। এমন সুস্বাদু আর টসটসে ফল দেখলে জিহ্বায় জল আসবে না, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দায়। কাঁচা থাকতে সবুজ আর পাকলে হাল্কা হলুদ বর্ণের এই ফল কখনও টক আবার কখনও মিষ্টি স্বাদের। এই ফল গোল, লম্বা উভয় আকৃতির হয়। দেখতে বেশ আকর্ষণীয়। দেশী গোল কুলবরই আর হাল্কা মিষ্টি বা পানসে স্বাদের রাজ বরইয়ের নাম আগের যুগের মানুষদের কাছে বেশ প্রচলিত ছিল। পরবর্তীতে এই পানসে স্বাদের সঙ্গে যোগ হয়েছে আপেলকুল, বাউকুল আর থাইকুল। এগুলো দামে বেশি হলেও স্বাদে কম নয়। এই ফল শুধু কাঁচাই খাওয়া যায় না। এর আচার অত্যন্ত লোভনীয় খাবার। তবে শুধু আচার নয়, দেশী টক গোল বরই ডাল বা রান্নার তরকারিতে দিয়েও খাওয়া যায়। কিন্তু রাজ বরই তথা কুল দিয়ে ডাল-তরকারি টক করা যায় না। তবে আচার তৈরিতে গোল বরইয়ের একচ্ছত্র আধিপত্য। উত্তরের নওগাঁসহ বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণ নানা জাতের কুল বা বরই উৎপাদন হয়। নওগাঁর মান্দা এলাকায় প্রচুর পরিমাণ বরই বা কুল জন্মে। উপজেলার প্রতি গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই চোখে পড়ে কুল গাছ। এ অঞ্চলে নারকেলি জাতের কুল বেশি জন্মে। এ জাতের কুল লম্বাটে এবং দুই মাথা খানিকটা সূচালো। খেতে আপেলের মতো কচকচে শাঁস আর পানসে মিষ্টি। এছাড়াও কুলের বৈচিত্র্যের সঙ্গে প্রজাতিও অনেক। আপেলকুল, থাইকুল আর বাউকুলের চাষও হয় এলাকা ভেদে। তবে বাউকুল এবার আগাম বাজারে উঠেছে। নওগাঁ বাজারে বর্তমানে বাউকুল বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৪০ টাকা করে। স্বাদও বেশ মিষ্টি। হালে বাউকুল আর আপেল কুল বেশ বাজার গড়েছে। এসব কুলের চাষও শুরু হয়েছে জেলাজুড়ে। হাটে বাজারে এসব কুলের এখন প্রচুর আমদানি। গাছে গাছে বাউকুল আর আপেলকুল দেখলে মনটাও ভরে যায়। তবে সবজিকুলের মধ্যে নারকেলি কুল এখন পর্যন্ত শীর্ষ স্থানে রয়েছে। নওগাঁ-পোরশা সড়কের মহাদেবপুর উপজেলার বনগ্রাম মৌজায় গড়ে তোলা হয়েছে বাউকুলের বাগান। প্রায় দুই একর জমিতে বাউকুলের গাছ লাগানো হয়েছে। ধরেছেও এবার অনেক। দিনে-রাতে ঝুপড়ি ঘর করে বাগানেই পাহারার ব্যবস্থা করা হয়েছে। রাস্তার পাশেই এই লোভনীয় বাউকুলের বাগানে গাছভরা কুল নিমিষেই পথচারীদের নজর কাড়ে। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, এই কুলের উৎপত্তি স্থান ভারতে। পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মিয়ানমার এবং আফ্রিকার কয়েক অঞ্চলে এর বিস্তার ঘটে। আমাদের দেশে কত জাতের কুল আছে তার হিসেব নেই। তবে ভারতে প্রায় দেড় শতাধিক জাতের কুল আছে বলে সে দেশের উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা সন্ধান পেয়েছেন। আমাদের দেশে সাম্প্রতিক কালে কুল চাষ বৃদ্ধি হতে শুরু করেছে। প্রায় ৬ হাজার হেক্টর জমিতে কুলের চাষ হচ্ছে বলে কৃষি অধিদফতরের একটি সূত্র জানিয়েছে। বছরে গড় উৎপাদন প্রায় ১৬ হাজার মে. টন। পাশাপাশি গ্রামে গ্রামে বরই আবাদও বাড়ছে। গ্রামে-গঞ্জে, গৃহস্থের বাড়ি, কৃষকের বাড়ি বাড়ি, বনে-জঙ্গলে বরই গাছ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। নওগাঁ সিভিল সার্জন অফিসের মেডিক্যাল অফিসার ডা. জাহিদ নজরুল চৌধুরী জানান, বরই একটি ফল। এই দেশী গোল বরই আর কুল পুষ্টিমানে ভরপুর। প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন-সি অর্থাৎ ক্যালসিয়ামসহ নানা ধরনের খনিজ উপাদান এতে বিদ্যমান। যা শরীরের জন্য খুবই উপকারী। তবে শীতকালে আমাদের দেশে নিপা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটে। সে ক্ষেত্রে পাখিতে খাওয়া কোন বরই বা কুল না খাওয়ার জন্য সকলকে পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। বর্তমান সময়ে বরই বা কুল একটি অর্থকরী ফসল। আগে একটা সময় গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে, জঙ্গলে-বনে এবং অনেক শহুরে বাড়িতেও বরই বা কুল গাছ থাকত। বরই গাছে ফল টসটসে আকার ধারণ করলে প্রতিবেশী বা যে কোন মানুষ ইচ্ছে করলেই পেড়ে খেত। শিশু-কিশোররা মরিচ-লবণ দিয়ে চাটনি বানিয়ে গাছে ঢিল ছুড়ে বা অন্য যে কোনভাবে কুল-বরই পেড়ে খেত আর কতই না আনন্দ করত। এতে গাছওয়ালা কিছুই বলত না। বাড়ির আঙ্গিনা, পুকুর পাড়, খেলার মাঠ ও নদীর ঘাটে বসে বসে মরিচ-লবণের চাটনি দিয়ে বন্ধুবান্ধব মিলে একসঙ্গে বরই খাওয়ার মজাই ছিল আলাদা। এখন দিন পাল্টেছে। এর দামও বেড়ে গেছে। আগের মানুষ ঘরে বিয়েরযোগ্য মেয়ে থাকলে বলত, ‘বাড়িতে বরই গাছ থাকলে সকলেই ঝাঁকাবে’। অর্থাৎ মেয়ের বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে আসবে। এখানে বিয়েরযোগ্য মেয়েকে বরইয়ের সঙ্গে তুলনা করা হতো। কিন্তু মেয়ের বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে এলেও বরই গাছে এখন আর কাউকে ঝাঁকাতে বা ঢিল ছুড়তে দেয়া হয় না। বর্তমানে দেশী ফলের মধ্যে বরই বেশ ভাল একটা স্থান দখল করে নিয়েছে। চাহিদাও বেড়েছে। আর ফলন বাড়াতে কৃষকও তৎপর হয়ে উঠেছে।
×