ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

পেট্রোলবোমায় দগ্ধ হয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন আরও দু’জন

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ২৮ জানুয়ারি ২০১৫

পেট্রোলবোমায় দগ্ধ হয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন আরও  দু’জন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বিএনপির টানা অবরোধে পেট্রোলবোমায় দগ্ধ আরও দু’জনের মৃত্যু হয়েছে। মঙ্গলবার সকালে সিলেটের ট্রাকচালক বকুল দেবনাথ (৩৫) ও দিনাজপুরের চিরিরবন্দরে পেট্রোলবোমায় দগ্ধ ট্রাক হেলপার আব্দুর রশীদ (৩২) না ফেরার দেশে চলে গেলেন। বাড়ছে লাশের মিছিল, দগ্ধদের তালিকা ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে। টানা ছয়দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে মঙ্গলবার সকাল ৭টার দিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ট্রাকচালক বকুল দেবনাথের মৃত্যু হয়েছে। আর এর তিন ঘণ্টা পর রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ট্রাক হেলপার আব্দুল রশিদের মৃত্যু হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র জানায়, বিএনপি-জামায়াতের টানা ২২ দিন অবরোধে ৩১ জন দগ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন প্রায় দুই শতাধিক। এতে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি মোট রোগীর সংখ্যা ৭৪ জন। দেশের অন্য হাসপাতালে রয়েছেন আরও ১৩০ রোগী। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, প্রতিদিনই বোমায় মারাত্মক দগ্ধ হয়ে মৃত্যুর মিছিল বাড়ছে। ভয়ঙ্কর বোমার ছোবলে কেউ পরিবারের একমাত্র সন্তান, কেউ পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ছে। সর্বগ্রাসী পেট্রোলবোমায় কারও মুখম-লে, হাতে-পায়ে ও কারও সারা শরীর ঝলসানো পোড়া দগ্ধ শরীর নিয়ে হাসপাতালে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। কেউ ভাল হয়ে উঠলেও পঙ্গুত্বের অভিশাপ নিয়ে বাঁচাতে হচ্ছে। এভাবে বোমার আগ্রাসের শিকার হয়ে শত শত পরিবার আজ অন্ধকারের হাতড়ে বেড়াচ্ছে। কে তাদের খোঁজখবর নেয়। অনেকে বলেছেন, বোমা মেরে মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়া কি গণতন্ত্র। নাকি ক্ষমতা দখলের লড়াই। বিশেষজ্ঞদের প্রশ্নÑদেশ এখন কোন্দিকে যাচ্ছে। এমন সংশয় এখন সাধারণ মানুষেরও। চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে সাধারণ মানুষ। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিট কর্তৃপক্ষ জানায়, এর আগে বিএনপি টানা অবরোধের সহিংসতায় দগ্ধ হয়ে বগুড়ার ট্রাক হেলপার আব্দুর রহিম, সাভারের শিশু জাকির হোসেন, মগবাজারে প্রাইভেটকার চালক আবুল কালাম হাওলাদার, ট্রাকের হেলপার যশোরের মুরাদ মোল্লা ও রংপুরের তছিরন বেগম চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। এখন পর্যন্ত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সরাসরি, রেফার্ড ও ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৮৭ জন। এদের মধ্যে বর্তমানে ভর্তি রয়েছে ৫০ জন। ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন তিনজন। সিলেটে অবরোধকারীদের পেট্রোলবোমায় দগ্ধ হয়ে মৃত বকুল দেবনাথের বাবার নাম রতন মনিনাথ। গ্রামের বাড়ি সিলেটের ওসমানীনগর থানার গোয়ালাবাজার গ্রামে। নিহতের ভাই রন্টু দেবনাথ কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, গত ২০ জানুয়ারি হেলপার কিবরিয়াকে সঙ্গে নিয়ে সিলেটের জয়ন্তপুর থেকে ট্রাকে বালুবোঝাই করে সিলেট সদরে যাচ্ছিলেন। রাত সাড়ে ১২টার গোয়াইনঘাট উপজেলার বাকের সড়ক নামে স্থানে পৌঁছলে চলন্ত ট্রাকে পেট্রোলবোমা ছুড়ে মারে অবরোধকারীরা। মূহূর্তে ট্রাকে আগুন ধরে যায়। ট্রাকে আটকা পড়ে বকুল দেবনাথ মারাত্মক দগ্ধ হয়। পরে তাঁকে উদ্ধার করে ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। রন্টু দেবনাথ কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, ভাই মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের সাজা সংসার তছনছ হয়ে গেছে। যারা আগুন দিয়ে তার ভাইকে মেরেছে। ভগবান তাদের এর চেয়ে ভয়ঙ্কর কষ্ট দিয়ে মারুক। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ বার্ন ইউনিটের চিকিৎসক ডাঃ অহিদ মোরশেদ জানান, সকাল ৭টার দিকে বকুল দেবনাথ মারা যান। এদিকে এদিন সকাল ১০টার দিকে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বার্ন ইউনিটে টানা চারদিন মৃত্যুর সঙ্গে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দিনাজপুরে পেট্রোলবোমায় দগ্ধ আব্দুর রশিদের মৃত্যু হয়। রংপুর বার্ন ইউনিটের চিকিৎসক মারুফুল ইসলাম জানান, আবদুর রশিদের শরীরের ৯৫ ভাগই পুড়ে গিয়েছিল। অবস্থার অবনতি হওয়ায় সোমবার সকাল থেকে তাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণ ইউনিটে (আইসিইউ) রাখা হয়। মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টায় তিনি মারা যান। নিহত আব্দুর রশিদের বাবার নাম মহির উদ্দিন। গ্রামের বাড়ি দিনাজপুরে চিরিরবন্দর উপজেলার মাহমুদপুর গ্রামে। স্বামী আব্দুর রশিদের মৃত্যুতে স্ত্রী সুলতানা বেগমের সাজানো সংসার তছনছ হয়ে গেছে। চার মেয়ের জনক ছিলেন আব্দুর রশিদ। নিহতের স্ত্রী সুলতানা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, দুই মেয়েকে যৌতুক দিয়ে বিয়ে দিয়েছেন। তাদের একজন যৌতুকের ৩৫ হাজার টাকা বাকি রয়েছে। স্বামী আব্দুর রশিদ মেয়ে যৌতুকের টাকা মেটানোর জন্য অবরোধের মধ্যে ট্রাক নিয়ে বের হয়েছিল। কিন্তু ওই অবরোধকারীরা তার স্বামীর ট্রাকে পেট্রোলবোমা ছুড়ে তাকে পুড়িয়ে মেরেছে, মেয়েদের এতিম করেছে। আমাকে বিধবা করেছে। আল্লাহ যেন ওই রাক্ষুসীদের (অবরোধকারীদের) এ চেয়ে কঠিন অবস্থায় ফেলে। যাতে যেন তাদের বাবা-মা-স্ত্রী-সন্তান এটি দেখে আপনজনের কষ্ট অনুভব করুক। এ সময় সুলতানা বিলাপ করে জানান, মেয়ে যৌতুকের ৩৫ হাজার টাকা না দিলে ওরা আমার মেয়ে ছেড়ে দিবে। এখন আমি কি নিয়ে বাঁচব। কি দিয়ে সংসার চলবে। টানা অবরোধে অবরোধকারীদের পেট্রোলবোমায় দগ্ধ হয়ে যাত্রাবাড়ীতে মোজাফ্ফর হোসেন (৬১) ও শাহজাহান সরদার (৫৫), জয়নাল আবেদীন, ইসতিয়াক মোঃ বাবর, সালাউদ্দিন পলাশ, সালমান, নাজমুল হোসেন, মোঃ শরীফ, মোঃ রাশেদ, শাহিদা আক্তার, তার স্বামী ইয়াসির আরাফাত, সালাউদ্দিন, মোশারফ হোসেন, মোঃ হৃদয়, ওসমান গনি, মোহাম্মদ খোকন, মোঃ মোমেন, মোঃ হারিছ, নূর আলম, মোঃ ফারুক হোসেন, মোঃ সুমন, মোঃ রুবেল, আবুল হোসেন, শাহজাহান সর্দার, মোজাফ্ফর মোল্লা, জাবেদ আলী, শহীদুল ইসলাম, রফিকুল ইসলাম ও তানভির। ককটেল বিস্ফোরণে আহতরা হলেন তাকবিরুল ইসলাম, আফরোজা আক্তারসহ ৫০জন এখন বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন রয়েছে। এদের কারও মুখম-ল, কার হাত-পা ও কারও সারা শরীর পুড়ে গেছে। তাদের মধ্যে সিএনজি অটোরিক্সাচালক সিদ্দিকুর রহমান, অশীতিপর আবু তাহের, বেল্লাল হোসেন জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। আর আগুনের প্রতিদিনই বার্ন ইউনিটে অবরোধকারীদের পেট্রোলবোমায় দগ্ধ যন্ত্রণাকাতর মানুষের ভিড়ে বাড়ছে। রাজনীতির নোংরা খেলার আগুনে পুড়ে যাওয়া এসব মানুষের আর্তচিৎকার ও স্বজনদের আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠেছে হাসপাতালের বার্ন ইউনিট। এদের অনেকের মুখম-লসহ সারা শরীর আগুনে ঝলসে গেছে। পুড়ে যাওয়া অনেকে চেনার উপায় নেই। ফলে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে তাদের জীবন। পুড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওদের সাজানো সংসার তছনছ হয়ে গেছে।
×