ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

দগ্ধ যন্ত্রণা ভুলে পরিবারের চিন্তায় ব্যাকুল ওসমান

প্রকাশিত: ০৪:৫৯, ২৮ জানুয়ারি ২০১৫

দগ্ধ যন্ত্রণা ভুলে পরিবারের চিন্তায় ব্যাকুল ওসমান

শর্মী চক্রবর্তী ॥ তোমরা আমার জন্য চিন্তা করো না, আমি ভাল আছি। কিছু হয়নি আমার। তোমরা মাকে দেখে রেখো। আমি খুব তাড়াতাড়ি ভাল হয়ে যাব। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন পেট্রোলবোমায় আহত ওসমান গনি (৪০)। পোড়া শরীরের যন্ত্রণা ভুলে পরিবারের ভাবনায় ব্যাকুল হয়ে মোবাইল ফোনে ছেলেমেয়েদের সান্ত¡না দিচ্ছিলেন। তখন চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছিল পানি। তার এই কষ্ট, যন্ত্রণা বুঝতে দেননি পরিবারের কাউকে। তিনি বলছিলেন, আমি এই সপ্তাহে তো বাড়ি আসতে পারব না, একটু সুস্থ হলেই তোমাদের কাছে আসব। সবাই আমার জন্য দোয়া করো। ফোন রাখার সঙ্গে সঙ্গে হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন ওসমান। বিলাপ করতে করতে বলেন, বাচ্চা দুইটার আমি ছাড়া আর কেউ নেই। ছেলেমেয়েগুলো প্রতি সপ্তাহে আমার পথ চেয়ে বসে থাকে। কখন আমি বাড়ি যাব আর কখন ওরা আমার গলা জড়িয়ে ধরবে। তাদের মা অসুস্থ হওয়ার পর থেকে আমিই তাদের সব। আমি শুধু আমার সন্তান দুটির জন্য ভাল থাকতে চাই। ২৩ জানুয়ারি শুক্রবার যাত্রাবাড়ীতে পেট্রোলবোমায় আহত হন ওসমান গনি। বাড়ি থেকে কর্মক্ষেত্রে ফেরার সময় তিনি এই ঘটনার শিকার হন। তার শরীরের প্রায় ১৫ শতাংশ আগুনে পুড়ে গেছে। মুখ ও হাত ঝলসে গেছে। এখন একা শুয়ে আছেন হাসপাতালের বেডে। স্ত্রী সন্তান কেউ পাশে নেই। এক ভাতিজা দেখাশুনা করছেন তার। ছেলে, মেয়ে, স্ত্রী সবাই গ্রামের বাড়িতে। একে তো শরীরের যন্ত্রণা এর মধ্যে পরিবারের সদস্যদের চিন্তায় নিঃসঙ্গের মতো বেডে বসে আছেন তিনি। ওসমান গনি রূপগঞ্জে রূপসীতে নাভানা ফার্মাসিটিকেলে সিনিয়র অপারেটর হিসেবে কর্মরত আছেন। তার গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জের দৌলতপুরের আগকালিয়ায়। স্ত্রী ও দুই ছেলেমেয়ে গ্রামের বাড়িতে থাকে। স্ত্রী ঝর্ণা বেগম। বড় ছেলে আতিকুর রহমান ইমন (১২)। পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। ছোট মেয়ে সুমাইয়া আক্তার। বয়স ছয় বছর। স্ত্রী অসুস্থ হওয়ায় প্রতি সপ্তাহে বৃহস্পতিবারে তিনি গ্রামের বাড়িতে যান। শুক্রবারে ফিরে যান কর্মক্ষেত্রে। কারণ তিনি ছাড়া পরিবারের তেমন কেউ নেই। স্ত্রী অসুস্থ হওয়ার পর থেকে পরিবারের সব কিছু তিনি নিজেই দেখেন। আহত ওসমানের পাশে বসে আছেন তার ভাতিজা আবু বকর সিদ্দিকী। চাচাকে সান্ত¡না দিচ্ছেন। তিনি বলেন, চাচার আহত হওয়ার খবর পেয়ে আমি মেডিক্যালে ছুটে আসি। তার মুখ ও দুই হাত আগুনে ঝলসে গেছে। বাড়িতে চাচি খুব অসুস্থ। তিনি এসে চাচার এই অবস্থা দেখলে আরও অসুস্থ হয়ে যাবেন তাই তাকে আনা হয়নি। টেলিভিশনে গাড়িতে পেট্রোলবোমায় আহতদের ফুটেজ দেখে বার বার ফোন দিয়ে জানতে চাচ্ছেন কি অবস্থা চাচার। তাদের মিথ্যা সান্ত¡না দিয়ে রাখছি। এছাড়া আর কিছুই করতে পারছি না আমি। তিনি ছাড়া আর কেউ নেই তাদের পরিবারে। তার কিছু হয়ে গেলে বাচ্চা দুইটা কই যাবে। স্ত্রীর চিকিৎসা করাবে কে? সংসারটা ধ্বংস হয়ে যাবে। আহত ওসমান গনি বলেন, দেড় বছর হলো স্ত্রী অসুস্থ। তার চিকিৎসা সন্তানদের লেখাপড়ার সবই আমার একা করতে হয়। আমার এই অবস্থা শুনলে তারা পাগল হয়ে যাবে। তাই বলেছি বেশি কিছু হয়নি সামান্য আঘাত পেয়েছি। আমার স্ত্রী মানসিকভাবে খুবই অসুস্থ। এই অবস্থা শুনলে তার অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যাবে। প্রতি সপ্তাহে তাদের দেখার জন্য বাড়িতে যাই। সেদিনও বাড়ি থেকে আসি গুলিস্তান থেকে রূপগঞ্জ যাওয়ার সময় যাত্রাবাড়ীতে আমাদের বাসটি উদ্দেশ্য করে পিকেটাররা পেট্রোলবোমা ছোড়ে। আগুন দেখার সঙ্গে সঙ্গে আমি তাড়াহুড়া করে বের হই। এতে আমার মুখ ও হাত আগুনে ঝলসে যায়। আমার ছেলেটাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন। শত কষ্ট হলেও তাদের জন্য প্রতি সপ্তাহে বাড়িতে ছুটে যাই। এখন আমার হাতের যে অবস্থা তা নিয়ে আমি কাজ করব কিভাবে? কাজ না করলে পরিবারের সবাইকে তো না খেয়ে মরতে হবে। এভাবে আমাদের মেরে তাদের কি শান্তি? আমরা কি অন্যায় করেছি? আমরা রাজনীতি করি না, কারও কোন ক্ষতি করিনি, তাহলে আমাদের ওপর কেন এই অনল? আমরা রাজনৈতিকদের এই হিংসার অনলে মরতে চাই না। অগ্নিদগ্ধদের পাশে প্রধানমন্ত্রী ॥ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে পেট্রোলবোমাসহ বিভিন্ন হামলায় আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সরকারের পক্ষ থেকে আক্রান্তদের আর্থিক সহায়তা, উন্নত চিকিৎসা সেবা আরও উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থাও করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে এ কথা জানানো হয়েছে। সরকারী হিসাব অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সরাসরি, রেফার্ড ও ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৮৭ জন। এদের মধ্যে বর্তমানে ভর্তি রয়েছে ৫০ জন। এছাড়া ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সরাসরি বা রেফার্ড হয়ে আসা ভর্তি রোগীর সংখ্যা ১০ জন। ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন তিনজন। দেশের অন্য হাসপাতালে রয়েছেন আরও ১৩০ জন রোগী। এদের মধ্যে মারা গেছেন ১১ জন (২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত)। বর্তমানে সারাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি মোট রোগীর সংখ্যা ৭৪ জন। প্রাথমিক সহায়তা হিসেবে ঢাকার সব রোগীকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাত খরচ হিসেবে ১০ হাজার টাকা করে আর্থিক অনুদান দিয়েছেন। ঢাকার বাইরে ভর্তি অনেককেই আওয়ামী লীগ নেতারা প্রধানমন্ত্রীর আর্থিক অনুদান পৌঁছে দিয়েছেন। রাজশাহী, সিলেট, রংপুর, চট্টগ্রাম ও বগুড়ায় আওয়ামী লীগ নেতারা রোগীদের নিয়মিত খোঁজখবর রাখছেন। শুধু তাই নয়, প্রধানমন্ত্রী প্রতিদিন এসব রোগীদের ব্যক্তিগতভাবে খোঁজখবর নিচ্ছেন এবং নির্দেশ দিচ্ছেন প্রয়োজনীয় সবকিছু করার। সরকারের পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত দু’জন রোগীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানো হয়েছে। ব্যবস্থা করা হচ্ছে আরও দু’জনকে পাঠানোর। এ কথা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর উপ প্রেসসচিব আশরাফুল আলম খোকন। তিনি জানান, ফেনীতে এসএসসি পরীক্ষার্থী মিনহাজুল ইসলাম অনিক ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুল কাদেরকে চোখে মারাত্মক আঘাত থাকায় ভারতের চেন্নাইয়ের শংকর নেত্রালয়ে পাঠানো হয়েছে। একই জেলায় দগ্ধ এসএসসি পরীক্ষার্থী শাহরিয়ার হৃদয় ও গাইবান্ধার ট্রাক ড্রাইভার মোঃ লিটন মিয়াকে চেন্নাই পাঠানোর প্রক্রিয়াধীন। এদের প্রত্যেকের দেখাশুনা প্রধানমন্ত্রী সরাসরি করছেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রী চেন্নাইয়ে পত্র দিয়েছেন, জানান আশরাফুল আলম খোকন। ঢাকায় যেসব রোগী রয়েছেন তাদের সঙ্গে একজন স্বজনের হাসপাতাল থেকে খাবার সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। চিকিৎসার ব্যয়ভারও বহন করছে সরকার। তবে প্রথম প্রথম কিছু খরচ রোগীর পরিবারকে করতে হয়েছে। হাসপাতাল ত্যাগের পর যাতে চিকিৎসা ব্যাহত না হয় তার জন্যও প্রধানমন্ত্রী আর্থিক অনুদান দেবেন। স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে আহতদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী বিশেষভাবে নির্দেশ নিয়েছেন। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে আহতদের পরিবারের জন্য ভিজিএফ কার্ডের ব্যবস্থা করা। বার্ন ইউনিট শয্যার তুলনায় রোগীর আধিক্যের কারণে অতিরিক্ত নার্সের ব্যবস্থা করা হয়েছে ও অতিরিক্ত চিকিৎসকের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে ১০ জন অতিরিক্ত চিকিৎসক ও ২০ জন নার্স পদায়ন করা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন ডাঃ জুলফিকার লেলিন। ২০ দলের ডাকা অনির্দিষ্টকালের অবরোধের পেরিয়েছে ২৬ দিন। জামায়াত-শিবির-বিএনপি নেতাকর্মীদের তা-বে এরই মধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন ৩০ জনের বেশি।
×