ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

বায়তুল মোকাররমে জানাজা

কোকোর লাশ বনানী কবরস্থানে দাফন

প্রকাশিত: ০৪:৫৬, ২৮ জানুয়ারি ২০১৫

কোকোর লাশ বনানী কবরস্থানে দাফন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ মঙ্গলবার বাদ আছর জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে জানাজা শেষে সাবেক রাষ্ট্রপতি মরহুম জিয়াউর রহমান ও বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মরদেহ বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়। এর আগে গুলশান কার্যালয়ে কোকোর লাশ দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন খালেদা জিয়া ও তাঁর নিকটাত্মীয়রা। এক পর্যায়ে আবেগাপ্লুত খালেদা জিয়া যখন কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান ও ২ মেয়ে জাফিয়া রহমান ও জাহিয়া রহমানকে বুকে জড়িয়ে ধরেন তখন সেখানে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। পুত্র কোকোর মরদেহ ছুঁতে গিয়ে মূর্ছা যান মা বেগম খালেদা জিয়া। বিশেষ করে গুলশান কার্যালয় থেকে কোকোর লাশ যখন বের করে আনা হয় তখন দরজায় দাঁড়িয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোকে নীরবে শেষ বিদায় জানান মা খালেদা জিয়া। এদিকে রাজধানীর বাইরে সারাদেশের বিভিন্ন জায়গায় আরাফাত রহমান কোকোর গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। তার আত্মার প্রতি সম্মান জানাতে সোমবার থেকে বিএনপি তিন দিনের শোক কর্মসূচী শুরু করেছে। এরই অংশ হিসেবে সকল স্তরের কার্যালয়ে দলীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ ও কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়। নেতাকর্মীরা বুকে কালোব্যাজ ধারণ করছেন। এ ছাড়া সারাদেশের মসজিদে মসজিদে কোরানখানি ও দোয়া মাহফিল হচ্ছে। এ কর্মসূচী আজ শেষ হবে। উল্লেখ্য, শনিবার দুপুরে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে মারা যান আরাফাত রহমান কোকো। রবিবার সে দেশের জাতীয় মসজিদে তাঁর প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে এর আগে সকাল পৌনে ৯টায় মালয়েশিয়ান এয়ার লাইন্সের একটি ফ্লাইটে কুয়ালালামপুর থেকে ঢাকার উদ্দেশে কোকোর লাশ নিয়ে রওনা দেন বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা মোসাদ্দেক আলী ফালু ও খালেদা জিয়ার ছোট ভাই শামীম এস্কান্দারসহ অন্য নেতৃবৃন্দ। সঙ্গে ছিলেন কোকোর স্ত্রী ও ২ কন্যা। দুপুর পৌনে ১২টার দিকে আরাফাত রহমান কোকোর লাশ হযরত শাহজালাল (রাঃ) বিমানবন্দরে এসে পৌঁছে। বিমানবন্দরের প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষে বেলা সোয়া ১২টায় কোকোর লাশ গ্রহণ করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমান, চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ, মেজর (অব) হাফিজ উদ্দিন, সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক মিলন, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক গিয়াস কাদের চৌধুরী, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর স্ত্রী ফরহাত কাদের চৌধুরী প্রমুখ। আগেই বিমানবন্দরে উপস্থিত হন বিএনপির অনেক নেতাকর্মী। আলিফ মেডিক্যাল সার্ভিসের একটি লাশবাহী গাড়িতে করে কোকোর লাশ গুলশান কার্যালয়ে আনা হয়। গাড়িবহরে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের গাড়িসহ শতাধিক মোটরসাইকেল ছিল। বিমানবন্দর থেকে গুলশান পর্যন্ত রাস্তার পাশে কালোব্যাজ পরিহিত অবস্থায় বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্র্মীরা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। বিমানবন্দর থেকে গুলশান পর্যন্ত পুরো রাস্তায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কড়া নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলে। লাশবাহী গাড়িবহরের সামনে ও পেছনে নেতাকর্মীদের ভিড় থাকায় গাড়ির গতি ছিল শ্লøথ। এ কারণে বিমানবন্দর থেকে খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয় পর্যন্ত আসতে ১ ঘণ্টা ২০ মিনিট সময় লেগে যায়। দুপুর ১টা ৩৫ মিনিটে লাশবাহী গাড়ি পেছনের গেট দিয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সনের গুলশান কার্যালয়ে প্রবেশ করানো হয়। পরে গাড়ি থেকে কোকোর লাশ নামিয়ে গুলশান কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে রাখা হয় পৌনে ২টার দিকে। লাশ দেখে দলের নেতাকর্মী ও আত্মীয়স্বজন অঝড় ধারায় কাঁদতে থাকেন। বেলা সোয়া ২টায় দ্বিতীয় তলা থেকে সম্মেলন কক্ষে নেমে মা খালেদা জিয়া ছেলের মুখ শেষবারের মতো দেখেন। সেখানে ছেলের লাশের পাশে প্রায় আধাঘণ্টা অবস্থান করেন তিনি। পুরো সময়ই খালেদা জিয়ার চোখ ছিল অশ্রসজল। এ সময় তাঁর সঙ্গে থাকা দলের নেতা ও আত্মীয়স্বজনরাও কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। দলের নেতাদের মধ্যে চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা মোসাদ্দেক আলী ফালুর চোখ ছিল সারাক্ষণই অশ্রুসজল। এ সময় খালেদা জিয়ার সঙ্গে ছিলেন বোন সেলিনা ইসলাম, ভাই শামীম এস্কান্দারের স্ত্রী কানিজ ফাতেমা ও সাইদ এস্কান্দারের স্ত্রী নাসরিন সাইদ, তারেক রহমানের স্ত্রী জোবাইদা রহমানের মা সৈয়দা ইকবালমান্দ বানু, দলের ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান, উপদেষ্টা মোসাদ্দেক আলী, প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান সোহেল, বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস এবং সেনা, বিমান ও নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ক’জন কর্মকর্তাসহ কিছু নিকটাত্মীয়। কোকোর লাশের কফিন এ্যাম্বুলেন্সে তোলার পর নিথর খালেদা জিয়াকে দু’পাশ থেকে ধরে দোতলায় নিয়ে যান তাঁর দুই ভাইয়ের স্ত্রী। সেখানে তাঁরা খালেদা জিয়াকে সান্ত¡না দেয়ার চেষ্টা করেন। নেতাকর্মীদের গুলশান কার্যালয়ে যেতে বারণ করা হলেও সকাল থেকেই সেখানে গিয়ে ভিড় করতে থাকে অসংখ্য মানুষ। দলের সিনিয়র নেতা ও নিকটাত্মীয় ছাড়া কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া না হলে মহিলা দলের কিছু নেতাকর্মী চিৎকার চেঁচামেচি করে প্রতিবাদ করে। কোকোর লাশবাহী গাড়ি প্রবেশের সময়ও দলের নেতাকর্মীরা ভেতরে প্রবেশ করার জন্য হুড়োহুড়ি করেন। আর টিভি চ্যানেলসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের কিছু কর্মী উঁচু দেয়াল টপকিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। বিকেল পৌনে ৩টায় বিএনপি চেয়ারপার্সনের গুলশান কার্যালয় থেকে কোকোর লাশ নিয়ে বায়তুল মোকাররমের দিকে রওনা দেয়া হয়। যানজট ঠেলে তাঁর লাশবাহী গাড়িবহর বিকেল ৪টা ৪০ মিনিটে বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনে গিয়ে পৌঁছে। বিকেল পৌনে ৫টায় তাঁর লাশ মসজিদে নিয়ে যাওয়া হয়। এর আগেই পুরো মসজিদ ছাপিয়ে আশপাশের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছর নামাজ আদায় করেন মুসল্লিরা। বিকেল ৫টা ১২ মিনিটে তাঁর জানাজা শুরু হয়। তা শেষ হয় ৫টা ১৪ মিনিটে। জানাজা পড়ান বায়তুল মোকাররমের খতিব মাওলানা মুহাম্মদ সালাহউদ্দিন। জানাজার পর কিছু সময়ের জন্য তাঁর লাশ দেখার সুযোগ দেয়া হয়। এর পর বিকেল সাড়ে ৫টায় তাঁর লাশ বায়তুল মোকাররম মসজিদ থেকে বের করে সন্ধ্যা ৬টা ১০ মিনিটে বনানী কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় সেখানেই তাঁকে দাফন করা হয়। এর আগে তাঁর লাশ বনানী সামরিক কবরস্থানে দাফন করার কথা বলা হলেও অনুমতি না পাওয়ায় বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়। অবশ্য দুপুর ১২টায় বিএনপি চেয়ারপার্সনের গুলশান কার্যালয়ের বাইরে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে বিএনপি জোটের শরিক দল কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব) সৈয়দ মোহাম্মদ ইব্রাহিম সামরিক কবরস্থানে কোকোর লাশ দাফনের অনুমতি না দেয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, সামরিক বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তার সন্তান হিসেবে কোকোর লাশ সামরিক কবরস্থানে দাফন হওয়ার অধিকার থাকলেও অজ্ঞাত কারণে সে সুযোগ দেয়া হয়নি। বিকেলে এক বিবৃতিতে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী অভিযোগ করেন, প্রধানমন্ত্রী কোকোর লাশ সামরিক কবরস্থানে দাফন করতে দেননি। এতে প্রমাণিত হয় কোকোর মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রীর সমবেদনা জানাতে আসা ছিল অপরাজনীতি ও কুটিল চাতুরী। এমনকি কোকোর জানাজায় যাতে লোক সমাগম বেশি না হয় সে জন্য বিভিন্ন পাড়া-মহল্লা, স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীদের গোয়েন্দা বাহিনী হুমকি দিয়েছে। বায়তুল মোকারররম মসজিদে যারা কোকোর জানাজায় অংশ নেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, ভাইস চেয়ারম্যান শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, হাফিজউদ্দিন আহমেদ, আবদুল্লাহ আল নোমান, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ও গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র অধ্যাপক এমএ মান্নান, ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, মীর মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন, এ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদীন, আহমেদ আজম খান, রুহুল আলম চৌধুরী, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন, শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক খায়রুল কবির খোকন, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক নাজিমউদ্দিন আলম, গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরী, সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিকল্প ধারার প্রেসিডেন্ট ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, মহাসচিব মেজর (অব) আবদুল মান্নান, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব) সৈয়দ মোহাম্মদ ইব্রাহীম, ব্যারিস্টার রফিকুল হক, এলডিপি সভাপতি অলি আহমদ, মহাসচিব রেদোয়ান আহমেদ, জামায়াতের কর্মপরিষদ সদস্য সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের, রিদওয়ান উল্লাহ শাহেদী, ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ নেজামী, খেলাফত মজলিসের চেয়ারম্যান মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক, মহাসচিব আহমেদ আবদুল কাদের প্রমুখ। কোকোর জানাজাকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে এবং যে কোন ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেট, দক্ষিণ গেট, স্টেডিয়াম সংলগ্ন এলাকাসহ আশপাশের এলাকায় এলাকায় বিপুলসংখ্যক র‌্যাব-পুলিশ মোতায়েন করা হয়। এ ছাড়া দায়িত্ব পালন করেন সাদা পোশাকধারী বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরাও। এ ছাড়া জানাজায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যেন অবনতি না ঘটে সে জন্য আগেই বায়তুল মোকাররমের উত্তর ও দক্ষিণ গেটের দোকানপাট ও হকার-ব্যবসায়ীদেরও তুলে দেয়া হয়।
×