ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নিজ দল সম্পর্কে বিএনপি বুদ্ধিজীবীদের ভাবনা

প্রকাশিত: ০৩:২৭, ২৮ জানুয়ারি ২০১৫

নিজ দল সম্পর্কে বিএনপি বুদ্ধিজীবীদের ভাবনা

কয়েকদিন আগে একটি বহুল পত্রিকায় পড়লাম যে, শফিক রেহমান বিএনপির শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে একজন। লেখকের মতে, তিনি বেগম জিয়ার ঘনিষ্ঠ পরামর্শদাতা। তাই বিএনপি সম্বন্ধে তাঁর পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত মূল্যবান। ‘যায়যায়দিন’ নামে প্রথমে সাপ্তাহিক ও পরে দৈনিক যে পত্রিকাটির তিনি সম্পাদনা করতেন সেটি ছিল জনপ্রিয়। এই পত্রিকাটিতে প্রকাশিত রচনাগুলোর কিছুসংখ্যক একত্রিত করে ’৮০-র দশকে তিনি একটি পুস্তক প্রকাশ করেন এবং এটির নামকরণ করেন পত্রিকাটির নাম অনুসরণ করে। এই পত্রিকার একজন নিয়মিত লেখক ছিলেন ‘তারিখ ইব্রাহিম’। তাঁর কিছু রচনার সঙ্কলন ‘বিশ্বাসহীনতার রাজনীতি’ নামে একটি পুস্তক। এই বই দুটিতে সে সময়ের চলমান ঘটনাবলী নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বিএনপি সম্বন্ধে মতামত প্রতিফলিত হয়েছে তাঁদের রচনায়। আমরা সেই বিষয়েই আলোচনা করব। পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন সম্পর্কে শফিক সাহেব লিখেছেন যে, ‘বটমূল, ছায়ানট ও পহেলা বৈশাখ এখন বাংলাদেশের প্রকৃত জাতীয়তাবাদের একটি অবিভাজ্য অংশ।’ পহেলা বৈশাখ কারও প্রয়োজনে সৃষ্ট কৃত্রিম জাতীয়তাবাদ নয়Ñ এই কথাটিই হয়ত তিনি বলতে চেয়েছেন। আজকের বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদের প্রশ্নটি একটি বিশাল ব্যাপার। এই জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে একটা ধোঁয়াটে পরিস্থিতি সৃষ্টি করেই বাংলাদেশের গতি উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দেয়া হয়েছিল। শফিক সাহেব লিখেছেন যে, বছর অর্থাৎ যে বছর তিনি প্রবন্ধটি লিখেছিলেন তাঁর আগের বছর রাষ্ট্র্রপতি জিয়াউর রহমান পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। আর তাই মন্ত্রী, এমপি, নেতা-নেত্রীসহ অনেকে এসেছিলেন। সে বছর রাষ্ট্রপতি না আসাতে কেউ আসেনি। বিশাল একটা দুঃখজনক উপসংহারে শফিক সাহেব পৌঁছেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য গড়ে তোলার কোন প্রয়াস দূরের কথাÑ কোন চিন্তা বোধহয় বিএনপির নেই।’ শফিক সাহেবের আজকের অবস্থান আশ্চর্যজনক। বৈষয়িক অবস্থান তাঁর আজকের অবস্থানের জন্য দায়ী কিনা তা আমাদের জানা নেই। বঙ্গবন্ধু তদন্ত কমিশনকে জিয়া সরকার বাংলাদেশে আসতে দেয়নি। শফিক সাহেব এজন্য দুঃখ পেয়েছিলেন। অবশ্য তিনি মনে করেন যে, এতে ক্ষতি বৃদ্ধি কিছু হয়নি। তাঁর বই থেকেই হুবহু উদ্ধৃত করা যাক, ‘হত্যাকারী কারা এবং তারা কোথায় আছে সেটা সবাই জানে। সবাই এটা জানে যে বর্তমান প্রশাসনে তাদের বিরুদ্ধে কোন শাস্তি দেয়া সম্ভব নয়Ñ কারণ তারা বর্তমান প্রশাসনের অঙ্গ। হত্যাকারীদের বেশিরভাগই এখন মোটা মাইনেতে বিদেশে কূটনৈতিক কাজ করছে।’ এই শফিক সাহেব এখন তাদের পরামর্শদাতা যারা ’৭১-এর খুনী অথবা তাদের রক্ষার প্রচেষ্টায় লিপ্ত। জিয়াউর রহমানের সমর্থকরা খাল খননের জন্য তাঁকে অমর করে রাখতে চায়। শফিক সাহেব তাঁকে ‘আয়াতুল্লাহ খালকাটি’ নামে একটি ব্যঙ্গাত্মক উপাধিতে ভূষিত করেছেন। তাঁর মতে আর একদল খননকারী অর্থাৎ ‘কূপ খননকারী’দের সঙ্গে খাল খননকারীদের সংঘাত লেগেই থাকত। এই খননকারীদের পেছনে সরকারের কোটি কোটি টাকা নষ্ট হতো। শফিক সাহেব লিখেছেন, এদের সত্যিকারের কোন উন্নয়নমূলক কাজে লাগানো উচিত ছিল। আসলে সেনানায়কের সমর্থকরা কিছু একটা খুঁজে বের করে তাঁকে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে চেষ্টা করে। এমন ভূরি ভূরি উদাহরণ দেশে-বিদেশে আছে। জিয়াউর রহমানের খাল খনন এমনি একটি প্রয়াস। কিন্তু আসলে কী হয়েছিল তা শফিক রেহমানের বই পড়লেই জানা যায়। তিনি বিএনপির প্রথমসারির একজন বুদ্ধিজীবী। তারিক ইব্রাহিম ‘যায়যায়দিনের’ একজন নিয়মিত লেখক ছিলেন। শুনেছি এটি তাঁর ছদ্মনাম। তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাস সম্বন্ধে আমার কিছুই জানা নেই। ‘যায়যায়দিনের’ সম্পাদক ছিলেন শফিক রেহমান এবং তারিখ ইব্রাহিম ছিলেন ওই পত্রিকার নিয়মিত লেখক। এভাবেই আমি সমস্ত জিনিসটাকে দেখছি। ইব্রাহিম সাহেবের লেখা ‘বিশ্বাসহীনতার রাজনীতি’ প্রকাশিত হয় ১৯৮৭ সালে। বইটিতে সাধারণভাবে জিয়া পরবর্তী সময়ের ঘটনাবলী স্থান পেয়েছে আর তাই স্বাভাবিকভাবেই পূর্ববর্তী ঘটনা বলির কিছু উল্লেখ রয়েছে। ‘পেশাছুট প্লাস দলছুট = জিরো প্লাস জিরো = জিরো ‘প্রবন্ধটির শুরুতেই তিনি প্রশ্ন করেছেন, ‘আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র কি শেষ পর্যন্ত উচ্চাকাক্সক্ষী ব্যক্তিদের চাকরি দেয়ার প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে?’ তারিখ ইব্রাহিম লিখেছেন যে, জিয়াউর রহমানের শাসনামল থেকেই ব্যাপারটি রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে শুরু হয়। জিয়াউর রহমান রাজনৈতিক দল ভাঙ্গার কাজ শুরু করেন। শূন্যহাতে তিনি কাউকে কাছে ডাকেননি। রাজনীতিকে যারা আখেরগোছানোর হাতিয়ার হিসেবে মনে করতেন তাদের প্রায় সবাই জড়ো হয়েছিল জিয়াউর রহমানের পাশে। প্রলোভন দেখিয়ে ছোট-বড় সব দল থেকে জিয়া সাহেব লোক বাগিয়েছিলেন। নানা দলছুট লোকদের নিয়ে তিনি তাঁর বেসামরিক রাজনৈতিক ভিত্তি হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন তাঁর নিজস্ব রাজনৈতিক দল বিএনপি। নানা মত ও আদর্শের (আসলে আদর্শহীনতার) জগাখিচুড়ি এই দল। ইব্রাহিম সাহেবের মতে ‘এই খিচুড়ি দিয়ে দেশ শাসন করতে গিয়ে জিয়াউর রহমান সামগ্রিকভাবে দেশের এবং ব্যক্তিগতভাবে নিজের ক্ষতি করেছিলেন।’ হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পরবর্তীতে জিয়াউর রহমানের পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। ‘এসব দল-বদল, নীতি-আদর্শ বদল, পেশা বদল করা মানুষদের দ্বারা দেশ-জাতি বা সমষ্টির কল্যাণ সাধন সম্ভব নয়।’ আমাদের দুই সেনানায়কের মন্ত্রিসভায় আর একদল মানুষকে দেখা যেত যাদের পেশাছুট বলা যায়। এদের কেউ কেউ ছিল (অব)। পেনশনভোগী অবসরপ্রাপ্ত এসব ব্যক্তি রাজনীতির কোন অভিজ্ঞতা ছাড়াই রাজনীতির উচ্চপদে পুনর্বাসিত হন। কেউ কেউ সম্ভবত নিজের পেশায় একঘেয়েমি বোধ করছিলেন। উত্তেজনার আশায় তাঁরা রাজনীতিতে যোগ দেন। একবার এ ধরনের রাজনীতিতে যোগ দিলে আর ফেরার পথ থাকে না। রেল লাইন ধরে দৌড়ালেও পরে এসে নত মস্তকে বসে পড়তে হয়। আমরা কয়েক জাতীয় পর্যায়ের নেতাকে দেখেছি বহুবার দল থেকে বহিষ্কৃত হতে এবং আবার নত মস্তকে ফিরে আসতে। জিয়া-পরবর্তী সময়ের বিএনপির চিত্র আমরা দেখতে পাই ‘শাহ আজিজের সোনার মুকুট’ ও ‘বিএনপিতে টানাপোড়েন’ নামক দুটি অধ্যায়ে। একদিকে বিচারপতি সাত্তার আর অন্যদিকে বেগম জিয়া। তারপর একদিকে শাহ আজিজের নেতৃত্বে প্রাক্তন মুসলিম লিগাররা আর অন্যদিকে ডাঃ চৌধুরীকে ঘিরে অন্যরা। ইদানীং অধ্যাপক মান্নান সাহেব একটি প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন যে, ‘ওরা যে কোন মূল্যে বেগম জিয়াকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়।’ আসলে জিয়াউর রহমানের স্মৃতি ছাড়া বিএনপির ইতিবাচক দিক আর কী আছে? আর তাঁকে ঘিরে যে স্মৃতি তার কিছু আমরা আলোচনা করলাম। লেখক : রয়্যাল কলেজ অব সাইকিয়াট্রিস্টের একজন ফেলো
×