ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শাস্তি নয়, সংশোধন

প্রকাশিত: ০৩:২৫, ২৮ জানুয়ারি ২০১৫

শাস্তি নয়, সংশোধন

বিশ্বখ্যাত ‘ক্রাইম এ্যান্ড পানিশমেন্ট’ উপন্যাসের নায়ক রাসকোলনিকভকে বলা হয়েছিল, ‘রাস্তার তেমাথায় চলে যাও, মানুষের কাছে মাথা নত করো, চুমো খাও জমিনকে, কারণ ওর বিরুদ্ধেও পাপ করেছ তুমি, তারপর জোর গলায় সারা দুনিয়াকে শুনিয়ে বলো, আমি একজন খুনী।’ এ উপন্যাস বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া দারিদ্র্যপিষ্ট সমস্যা জর্জরিত এক যুবককে নিয়ে। সমাজ উদ্ধারের পথিকৃৎ হওয়ার তাড়না থেকে সে খুন করে সম্ভাবনাহীন জীবনযাপন করা এক পুঁজিপতি বৃদ্ধাকে। পুলিশের চোখকে সে ফাঁকি দিতে সমর্থ হলেও শুরু হয় তার অন্তর্দ্বন্দ্ব। অপরাধবোধ, অপরাধপ্রবণতা আর অপরাধ সংঘটিত করে ফেলা এক পাল্লায় মাপা হয় না। কারাগারে গিয়ে নিজেকে সোনার মতো পুড়িয়ে শুদ্ধ হয়ে নতুন উপলব্ধি আর জীবনবোধ নিয়ে প্রকৃত মানব হয়ে ফিরে আসার সুযোগ কয়জনের জীবনে মেলে? জেলবাস না হোক, যিনি কখনও পুলিশের হাতে আটক হয়ে কয়েক ঘণ্টা হাজতবাসও করেননি তাঁর পক্ষে অন্তরীণ হওয়া কিংবা বন্দিত্ব থেকে মুক্তির অনুভূতিটি উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। ঢাকার রাজপথে প্রায়ই আমাদের চোখে পড়ে আসামি বহনকারী দরজা-জানালাহীন গাড়ি। তবে তাতে লোহার শিক-জড়ানো এক চিলতে ভেন্টিলেটর থাকে। ওই অপরিসরে ফাঁক গলিয়ে বন্দীরা বাইরের পৃথিবীর আলো-বাতাস নেন গোগ্রাসে। ওই গাড়িতে ওঠা যাঁর হয়নি তিনি কী করে আঁচ করবেন মুক্ত পৃথিবীর ভেতর দিয়ে অনিশ্চয়তার পথে চলমান এক বন্দীযাত্রীর মানসিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া! ‘রাখিব নিরাপদ, দেখাব আলোর পথ’ এমন চমৎকার মূলমন্ত্র ধারণ করে আছে দেশের কারাব্যবস্থা। বিধিতে সুস্পষ্টভাবে লেখাও রয়েছে, ‘কারাগারে বন্দীরা রেডিও শোনা, টেলিভিশন দেখার সুযোগ পাবেন। কারা লাইব্রেরীতে বই পড়া ও পত্রপত্রিকা পড়ার সুযোগ রয়েছে। কারাগারে বন্দীরা ক্যারামবোর্ড, লুডু, দাবাসহ ভলিবল, ব্যাডমিন্টন খেলা ও শরীর চর্চার সুযোগও পাবেন।’ বাস্তবে বন্দীদের কতটুকু প্রাপ্তি ঘটে তা অনুসন্ধানসাপেক্ষ। মুক্ত কয়েদিদের অনেকেই জেলখানাকে দোজখ বলে অভিহিত করে থাকেন। মানবসভ্যতায় কারাগারের উৎপত্তিই পাপাচার সংশোধনের দৃষ্টিকোণ থেকে। কালে কালে তা প্রতিপক্ষ দমনের হাতিয়ারস্বরূপ হয়েছে। তবে স্মরণযোগ্য যে, ৫ বছর আগে আওয়ামী লীগ সরকার একসঙ্গে এক হাজার কারাবন্দীর মুক্তিদানের ব্যবস্থা করে প্রশংসিত হয়। কারা নীতিমালা সংশোধনের সাম্প্রতিক সংবাদটিকে শুভবার্তা হিসেবেই দেখছি। বাইরে স্বজনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলতে পারবেন কারাগারের কয়েদিরা। নিকটজনের সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারবেন তাঁদের সুখ-দুঃখ, আবেগ-অনুভূতি। হাজতিরা ১৫ দিন আর কয়েদিরা ৩০ দিন অন্তর একবার কথা বলতে পারবেন। অবশ্য শীর্ষ সন্ত্রাসীরা এ সুযোগ পাবেন না। ইতোপূর্বে আমরা দেখেছি কারাগারের ভেতরে থেকে গডফাদাররা অপরাধ জগত নিয়ন্ত্রণ করছেন। এখন টেলিফোনে বাইরে কথা বলার বিষয়টি বৈধ হয়ে গেলে এই বাণিজ্য আরও বেড়ে যাবে কিনা এমন আশঙ্কা অমূলক নয়। অবশ্য নতুন কারা নীতিমালায় সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে। বলা হয়েছে, কারা নিরাপত্তা তথা জননিরাপত্তা বিঘিœত হওয়ার মতো কোন কথা বলা বা যে কোন ধরনের ষড়যন্ত্র করার চেষ্টা করলে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। উন্নত বিশ্বে কারাগারকে শাস্তির স্থান হিসেবে না দেখে সংশোধনালয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আগামীতে বাংলাদেশের কারাগারগুলো অপরাধীদের সত্যিকারের সংশোধনালয় হিসেবে গড়ে উঠবেÑ এটাই প্রত্যাশা।
×