ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পোলা বাপরেই চিনতে পারতাছে না

প্রকাশিত: ০৪:৫৯, ২৭ জানুয়ারি ২০১৫

পোলা বাপরেই চিনতে পারতাছে না

শর্মী চক্রবর্তী ॥ ‘ও আল্লাহ আর কত কষ্ট দিবা? আর সহ্য করতে পারছি না, আমাকে তুমি শক্তি দাও আল্লাহ।’ শরীরের পুড়ে যাওয়া চামড়াগুলো তখন কাটছিলেন নার্স। ড্রেসিং করার সময় সেই অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে এভাবেই আর্তচিৎকার করছিলেন সালাউদ্দিন পলাশ (৩৬)। স্বামীর এই চিৎকার শুনে নিজেকে ধরে রাখতে পারছিলেন না স্ত্রী নাসরিন আক্তার। ৩ বছরের মেয়ে ইভাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন তিনি। স্ত্রীর কান্না শুনতে পেরে সালাউদ্দিন একটা কথাই বারবার বলছিলেন, তুমি কেঁদোনা; আমার জন্য দোয়া করো আল্লাহ যাতে আমাকে এই কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা দেন। ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটের বেডে শুয়ে এভাবে বিলাপ করছিলেন সালাউদ্দিন। অবরোধের আগুনে ঝলসে গেছে সালাউদ্দিনের দুই হাত মুখ ও শরীরের কিছু অংশ। পাশে দাঁড়িয়ে মা সেলিনা ছেলেকে সান্ত¡না দিচ্ছেনÑ ‘বাজান শান্ত হও, চোখ বন্ধ কইরা আল্লা আল্লা কর, কথা কইলে কষ্ট আরও বাড়ব।’ এত সান্ত¡নার পরও পোড়া যন্ত্রণায় আবার শুরু হয় তাঁর গোঙানি। ছেলের এই বিলাপ শুনে নিজেকে সামলাতে না পেরে চিৎকার করে কেঁদে ওঠেন মা সেলিনা। বলেন, ‘কেন আমার এমন হলো না আল্লা? আমার বাজান তো আর সহ্য করতে পারছে না! তুমি তার সব কষ্ট আমারে দিয়া দাও।’ সোমবার দুপুরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের এইচডিইউ ওয়ার্ডের পাশে বারান্দায় একটি বেড ঘিরে দেখা গেল এ দৃশ্য। হরতাল-অবরোধের নৃশংসতায় তৈরি হওয়া এমন অসংখ্য দৃশ্যের দেখা মিলছে এখন বার্ন ইউনিটে। পোড়া মাংসের গন্ধ, যন্ত্রণাক্লিষ্ট মানুষের চিৎকার, স্বজনদের অসহায় বিলাপে এক ভয়াল পরিস্থিতি সেখানে। দগ্ধ প্রিয়জনের যন্ত্রণায় ভেঙ্গে পড়ছে মা-বাবা, সন্তান, প্রিয়তমা স্ত্রী ও আদরের ভাই-বোনেরা। সালাউদ্দিনের শিশুকন্যা ইভা গুটিগুটি পায়ে বারবার বাবার বেডের পাশে যাচ্ছে। অস্পষ্ট ভাষায় বা, বা করে ডাকছে। বেডের কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে বাবার মুখের দিকে সে। চেনার চেষ্টা করেও চিনতে পারছে না। ভয় পেয়ে আবার ফিরে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে শিশুটি। মেয়ের এই দৃশ্য দেখে নিজেকে সামলাতে পারেন না নাসরিন, জোরে কেঁদে ওঠেন। তিনি বলেন, ‘এই মাইয়া বাপের জান। বাপের জন্য তার কত টেনশন। পোড়া মুখ দেইখা এখন সেই বাপরে চিনতে পারতাছে না। ভয় পাইতাছে।’ বাবা-মা, স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েকে নিয়ে সালাউদ্দিনের সংসার। এক বোনকে বিয়ে দিয়েছেন এবং এক ভাই আলাউদ্দিন সুমন থেকেও নেই। বিডিআর বিদ্রোহ মামলায় দ-প্রাপ্ত আসামি। বাবা আবু তাহের অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা। সংসারে তিনি একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। চাকরি করেন বসুন্ধরা সিটির দ্বিতীয় তলায়। আমির সুজের সেলসম্যান হিসেবে। প্রতিদিন সোনারগাঁওয়ের বরগাঁও থেকে আসেন ঢাকায়। ফেরেন রাত ১০-১১টায়। ১১ বছর বয়সী এক ছেলে মুহাম্মদ ইফরান ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে। তাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন সালাউদ্দিনের। সেই স্বপ্ন কি স্বপ্নই রয়ে যাবে? এই প্রশ্ন এখন সালাউদ্দিনের পরিবারের সবার। স্ত্রী নাসরিন বলেন, বড় ছেলে ইফরান প্রতিদিন বাবার অপেক্ষায় বসে থাকে। তার একটাই প্রশ্ন মা, বাবা কখন আসবে? আমার জন্য চকোলেট আনবে না? দুই দিন হলো আমি বাবাকে দেখি না। বাবাকে ছাড়া আমার ঘুম আসে না। ছেলের এ সব প্রশ্নে নির্বাক নাসরিন। কী উত্তর দেবেন ছেলেকে ভেবে পান না। ছেলেকে শান্ত করার জন্য সোমবার বাবাকে দেখাতে নিয়ে আসেন ঢাকা মেডিক্যালে। ইফরান বাবার এই পোড়ামুখ দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। মাকে প্রশ্ন করে উনি কি আমার বাবা? স্বামীর এ অবস্থায় তিনি এখন পাগলপ্রায়। খাওয়া ঘুম সব বন্ধ হয়ে গেছে। স্বামীর কিছু হলে তিনি কিভাবে ছেলে-মেয়েকে নিয়ে থাকবেন? কোথায় গিয়ে দাঁড়াবেন কিছুই জানেন না। তার ভবিষ্যত পুরোই অন্ধকার হয়ে যাবে। বাবা আবু তাহের বলেন, আমি অবসর নেয়ার পর এই ছেলেই আমার সংসারের সব। একটু বেশি আয়ের জন্য ঢাকার বসুন্ধরা সিটিতে সেলসম্যানের চাকরি নিয়েছিল। খরচ বাঁচানোর জন্য প্রতিদিন আসা যাওয়া করে কাজ করত। কারণ ঢাকা থাকলে বাড়তি খরচ হবে। তখন সংসার চালাতে কষ্ট হয়ে যাবে তার। দেশের এমন পরিস্থিতিতে কাজ বন্ধ করে থাকলে না খেয়ে মরতে হবে আমাদের সবাইকে। বেশ কিছুদিন ধরে হরতাল অবরোধে আমাদের সবার মধ্যে ভয় কাজ করত। তাই আমি প্রতিদিন গিয়ে সালাউদ্দিনকে এগিয়ে নিয়ে আসতাম। শুক্রবার রাতেও আমি তাকে ফোন দেই। তখন সে আমাকে বলে আমি গাড়িতে উঠছি তুমি আমার জন্য অপেক্ষা কর। এর আধাঘণ্টা পরই জানতে পারি সালাউদ্দিন ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি। গাড়িতে দেয়া পেট্রোলবোমায় তার শরীরের প্রায় ২৫ ভাগ পুড়ে গেছে। আমার ছেলের কিছু হলে সংসারটা ধ্বংস হয়ে যাবে। ছেলে-মেয়েগুলোকে কে মানুষ করবে? কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে আমার এই পরিবার। মা সেলিনা বলেন, ২ ছেলে আমার সব ভরসা। ছোট ছেলে কারাগারে যাওয়ার পর থেকে সালাউদ্দিনকে নিয়ে আমি বেঁচে আছি। ওর কিছু হলে আমার সব শেষ হয়ে যাবে। ছোট ছোট নাতি-নাতনি; তারা এতিম হয়ে যাবে। আমার ছেলের তো কোন অন্যায় ছিল না। তাহলে কেন অবরোধকারীরা আমার ছেলের শরীর পুড়িয়ে দিল? আমি ওর কষ্ট সহ্য করতে পারছি না। সালাউদ্দিনের পরিবারের সবার মধ্যে এখন অনিশ্চয়তা ঘিরে রেখেছে। শুক্রবার রাতে কাজ শেষে গ্লোরি পরিবহনে যাত্রাবাড়ী হয়ে বাড়ি ফিরছিলেন সালাউদ্দিন। তাঁর শরীরের ২৫ শতাংশ পুড়েছে। সংবাদ সম্মেলন ॥ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে বর্তমানে ৫০ রোগী ভর্তি আছেন। এর মধ্যে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) আছেন ছয়জন। ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে সোমবার দুপুরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়। সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন বার্ন ইউনিটের সমন্বয়কারী ডাঃ সামন্তলাল সেন। এ ছাড়া উপস্থিত ছিলেন বার্ন ইউনিটের প্রকল্প পরিচালক ডাঃ আবুল কালাম ও প্রফেসর ডাঃ সাজ্জাদ খন্দকার। ডাঃ সামন্তলাল সেন জানান, আইসিইউতে থাকা দুইজনের শারীরিক অবস্থার উন্নতি হওয়ায় তাদের জেনারেল বেডে স্থানান্তর করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, যাত্রাবাড়ীর সহিংস ঘটনাসহ অন্যান্য জেলা থেকে আসা দগ্ধ রোগীদের মধ্যে আটজনের অবস্থার উন্নতি হওয়ায় তাদের সোম অথবা মঙ্গলবারের মধ্যে রিলিজ দেয়া হবে। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য গোলাম দস্তগীর গাজী বীরপ্রতীক জানান, যাত্রাবাড়ীতে যাঁরা দগ্ধ হয়েছেন তাঁরা সবাই রূপগঞ্জের লোক। তাঁদের মধ্যে রূপগঞ্জের এক বিএনপি নেতার কারখানার শ্রমিকরাও রয়েছেন। তিনি আরও জানান, চলমান সহিংসতায় যেকোন দলের লোকই আহত হতে পারেন। এটি অত্যন্ত অমানবিক। বিএনপিকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মানুষ হত্যার রাজনীতি থেকে সরে আসারও আহ্বান জানান তিনি। তিনি বলেন, পেট্রোলবোমায় যাত্রাবাড়ীতে চলন্ত বাসে সহিংসতায় দগ্ধ অধিকাংশই খেটে খাওয়া মানুষ। এ ধরনের নাশকতার সমালোচনা করে তিনি বলেন, আগুনে পোড়ানো রাজনীতি থেকে আমাদের সরে আসতে হবে।
×