ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রলয় সৃষ্টি তব পুতুল খেলায়

প্রকাশিত: ০৪:১৫, ২৭ জানুয়ারি ২০১৫

প্রলয় সৃষ্টি তব পুতুল খেলায়

রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘সময় যেন ক্রমেই ইতর হইয়া আসিতেছে।’ খুবই খাঁটি কথা। তবে এই বঙ্গদেশে সময় তো ইতর হয় না, ক্ষেত্রবিশেষে ইতর হয় কেউ কেউ। মানুষের অপকর্মের ফলেই কালের মুখে চুনকানি পড়ে। ইতর বললে পাছে কেউ গায়ে পেতে নেয়। সেজন্য নরম করে বলা যায়, মানুষ ক্রমেই যেন লঘুচিত্ত হয়ে আসছে। ফলে এখন কোন কিছুরই আর মর্যাদা নেই। কেউ কারও মান রেখে কথা বলে না। বিএনপি নেতৃত্ব বহরে চিন্তার জগতটি ক্ষুদ্র। কাজকর্ম সে কারণেই তুচ্ছ। চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে মানুষ মেরে আন্দোলন কোন সমস্যার সমাধান করতে পারে না। বরং সমস্যাকে জিইয়ে রেখে তাকে আরও প্রসারিত করে। যে কারণে দেখা যায়, বিএনপি নেত্রীর নির্বাসিত পুত্র আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুতেও দলটি অবরোধ কর্মসূচী স্থগিত করেনি। বরং হরতাল জুড়ে দিয়েছে। যে কর্মসূচী মানুষের প্রাণ সংহার করে সে কর্মসূচী থেকে সরে আসার বিন্দুমাত্র বোধোদয় হয়নি। অথচ দেশবাসী ভেবেছিল শোকাহতরা এমন পৈশাচিকতা থেকে আপাতত নিজেদের গুটিয়ে নেবেন। কোকোর আকস্মিক প্রয়াণের পরও দেশের মানুষ হত্যা থেমে থাকেনি। সম্পদ বিনষ্টও অব্যাহত রয়েছে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলা যায়, ‘এ তো মালা নয় গো, এ যে তোমার তরবারি/জ্বলে উঠে আগুন যেন বজ্র হেন ভারী/ এ যে তোমার তরবারি।’ তরবারির স্থান নিয়েছে আজ পেট্রোলবোমা, হাতবোমা, ককটেল। আজকের বাস্তবতা হচ্ছে দেশে দেশে, জাতিতে জাতিতে বিশ্বময় বিবাদ, বিরোধ, সংঘর্ষ লেগেই আছে। বাংলাদেশও তার বাইরে নয়। দেখে দেখে, শুনে শুনে এই নিত্য আশঙ্কা, নিত্য অশান্তিÑ এমনকি চোরাগোপ্তা গেরিলা স্টাইলের হামলার ব্যাপারেও বিএনপি-জামায়াত এত অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে যে, এর অস্বাভাবিক আর অমানুষিক দিকটা এখন আর তাদের চোখেও পড়ে না। মনেও লাগে না। দেশের মানুষকে একদল হত্যা করছে, আরেক দল তা চেয়ে চেয়ে দেখছে। অসহায় মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াবার কেউ নেই। তাদের অপরাধ তারা এ দেশের গরিব অসহায় সাধারণ মানুষ। কোন দলকে সমাবেশ করতে দেয়া হলো না প্রতিবাদে তারা নিরীহ মানুষের দিকে পেট্রোলবোমা ছুড়বে। কোন দলকে মিছিল করতে দিল না প্রতিবাদস্বরূপ তারা সাধারণ নিরীহ স্ত্রী, ছেলেমেয়ের ওপর পেট্রোলবোমা মেরে দগ্ধ করবেÑ এটা যারা সমর্থন করে তারা বিবেকহীন মানুষ। ক্ষমতার লোভের আগুনে পুড়তে থাকা দেশ ও মানুষের সামনে আগুনে ঝলসানো মানুষদের প্রতি সামান্য সহানুভূতি দেখায় না বিবেকবানরাও। তাই দেখা যায়, এক বুদ্ধিজীবী টিভির টকশোতে বলেই ফেললেন রাজনৈতিক সমাধানের জন্য জনগণকে পুড়িয়ে মারা যায়। বাংলাদেশের মানুষকে জিম্মি করে বিএনপি মানুষ মেরে তবেই দাবি আদায় করবে। দেশে সুশীল সমাজ বা বুদ্ধিজীবী বলতে যা বোঝায় ইনটেলেকচুয়াল শব্দটা তার চেয়ে বেশি বোঝায়। বুদ্ধিজীবীরা নিঃসন্দেহে বুদ্ধিকে উপজীব্য করেই জীবন ধারণ করেন। বিএনপিপন্থী সাংবাদিক সাদেক খান যেমন। কিন্তু সে শুভবুদ্ধি নাও হতে পারে। সেজন্য ইনটেলেকচুয়াল বলতে বোঝায় এমন মানুষ যিনি একাধারে মস্তিষ্কবান এবং চরিত্রবান। দেশে এমন মানুষের অভাব হয়েছে তা মনে হয় না। তবে তাঁরা যে আছেন টের পাওয়া যায় না। আমাদের রাজনীতিক এবং সংবাদপত্রসহ প্রচার মাধ্যম যেমন সরব, আমাদের ইনটেলেকচুয়ালরা আবার তেমনি নীরব। এখানেই ঘটেছে দেশবাসীর পরাভব। রাজনীতিকে হঠকারিতা, গণমাধ্যমকে বাচালতা থেকে নিবৃত্ত করবেন তো তাঁরাই। কিন্তু এই বিবেকবানরা নীরব। বিএনপি নামক দলটির ধৈর্য নেই। তাদের নেত্রী যেভাবে বলেন তা স্পষ্ট করে তাদের শ্রেণী চরিত্র। বেগম জিয়া এমনটাই বলে থাকেন যে, যা ভাববার আমিই ভেবে রেখেছি, অন্য কাউকে, অন্য কোন দলকে তা ভাবতে হবে না। আওয়ামী লীগ তাই করে যাবে, শুধু তিনি যা বলবেনÑ ‘তোমরা শুধু আমি যা বলছি তা করে যাও।’ বিএনপি-জামায়াত জোট যে কী আন্দোলন করছে তা তারাই জানে। শুধু তাই নয়, জনগণও হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। আন্দোলন মূলত দু’ধরনের হয়ে আসছে। প্রকৌশলী বন্ধু সরদার আমিনের মতে, প্রথমত, রাজধানীকে ঘেরাও করা, সারাদেশ থেকে লংমার্চ করে রাজধানী জনতা দিয়ে ঘেরাও করাÑ মাও সেতুং ও লেনিন পদ্ধতিতে। আর অপর পদ্ধতি হলো রাজধানীর কেন্দ্রে অবস্থান নিয়ে সে আন্দোলনকে সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়া। আধুনিক বিশ্বে এটাই বড় আন্দোলন। যেমন তাহরীর স্কয়ার এবং হংকংয়ের আন্দোলন। গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনও কিছুটা সেরকম। যদিও তারা সরকার বিরোধী নয়, কিন্তু বিএনপি-জামায়াত যা করছে তা জনগণের জন্য নয়। জনগণের হলে তারা নিরীহ মানুষকে হত্যা করত না। এটা জনগণের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ। এ আন্দোলন কোনদিনই সফল হতে পারে না। ক্ষমতা থেকে জন্ম নেয়া রাজনৈতিক দলগুলো বা সামরিক জান্তা শাসকদের দল গণঅভ্যুত্থানের কবলে পড়ে। আওয়ামী লীগের মতো জনগণ থেকে জন্ম নেয়া কোন দল গণঅভ্যুত্থানের কবলে কখনও পড়ে না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষে এখন শাস্তির অপেক্ষায় রয়েছে। তাদের মুক্ত করার জন্য যা যা করণীয় তাই করা এবং দুর্নীতির মামলা থেকে খালেদা-তারেকের অব্যাহতি লাভ। কিন্তু এর জন্য তাঁরা যে জঙ্গীপনায় নেমেছেন, তা দেশবাসী ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখছেন। এমনকি কোকোর মৃত্যুর পর শোক জানাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাতৃরূপে এগিয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু ঘুমিয়ে যাওয়া বা ঘুমিয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে দেখার পথ রুদ্ধ করে দিলেন। অথচ বাজারে প্রচলিত আছে যে, তিনি রাতভর কখনও জেগে থাকেন না। দিনভর ঘুমান। সেই তিনি সন্ধ্যা বেলায় ঘুমিয়ে পড়লেন ইনজেকশন নিয়ে। মনস্তাত্ত্বিক দিক রয়েছে সব ঘটনারই। ব্যক্তির জীবন চরিতই স্পষ্ট করে, তিনি কী চান। তাই জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদ বিকাশের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার গত ৬/৭ বছরের জীবনে আত্মীয় বিচ্ছেদ ঘটেছে। যা শুধু বেদনাদায়ক নয়, বিপজ্জনকও। স্বজন থেকে বিচ্ছিন্ন হলে মানুষ সহায়-সম্বল শক্তিহীন হয়ে পড়ে। বিচ্ছিন্নতা যে মানুষকে অসহায় করে সে কথা জেনেও মানুষ আলাদা হতে চায়। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘মানুষের একলা হবার প্রবৃত্তি হচ্ছে তার রিপু। সত্যভাবে মিলিত হবার সাধনাই কল্যাণ। স্বতন্ত্র হয়ে থাকলে বঞ্চিত হবে।’ প্রবীণ বয়সে মানুষ পুত্র, পুত্রবধূ, নাতি-নাতনিদের নিয়ে দিন গুজরান করে। বেগম জিয়ার ক্ষেত্রে তা ঘটছে না। তিনি সবলা হবার রিপুটাকেই প্রশ্রয় দিয়ে আসছেন। এটি একটি বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বহু শত্রু ওত পেতে আছে, রিপুগ্রস্তদের অস্ত্র দিয়ে শলাপরামর্শ দিয়ে সাহায্য করছে। রিপুগ্রাসে পড়লে রাহুগ্রাসে পড়তে হয়, সে বোধ কি বিএনপির রয়েছে? যে দুঃসহ জীবন বেগম জিয়া কাটিয়ে যাচ্ছেন, তা তাঁরই সৃষ্টি। গত ৬/৭ বছর ধরে কাজের মেয়ে কুলসুল ছাড়া তাঁকে সঙ্গ দেয়ার কেউ নেই। এই নিঃসঙ্গতা তাঁকে বাড়ি ছেড়ে অফিসে নিয়ে এসেছে। এখন ‘অফিস কাম রেসিডেন্ট’ জীবনে একাকী বসবাস তাঁকে নিঃসঙ্গতা হতে দূরে রাখার একটি প্রক্রিয়া বৈকি। তাঁর এই একাকিত্ব, পরিবার-পরিজনহীন জীবনে তাই স্বার্থান্বেষীদের প্রভাব বেড়েছে। বেগম জিয়ার ‘অবরোধ’ নামক গণবিধ্বংসী কর্মসূচীতে দেশের প্রতি বিন্দুমাত্র মমতা প্রকাশ পায়নি। মমতা তো দূরের কথা, চূড়ান্ত নির্মমতার ব্যাপার ঘটছে। মুক্তিযুদ্ধকালে শোনা যেত, দেশের ধূলি ও মাটিও আমার কাছে পবিত্র, মূল্যবান বস্তু। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার জন্য বেগম জিয়া ও তাঁর রাজনৈতিক উত্তরসূরি দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত পুত্র তারেক যে উঠেপড়ে লেগেছেন, তা দিবালোকের মতো পরিষ্কার। জামায়াতসহ জঙ্গীদের এবং দলীয় ক্যাডারদের ব্যবহার করে দেশজুড়ে পৈশাচিকতা চালানোর নির্দেশদাতাদের একজন তারেক। বাংলাদেশকে নিয়ে যারা দুষ্টু খেলা খেলতে চায়, তারা বেশি দূর যেতে পারবে বলে মনে হয় না। নজরুলকে ধার করে বলা যায়, ‘খেলিছ এ বাংলাদেশ নিয়ে বিরাট শিশু সন্তর্পণে/প্রলয় সৃষ্টি তব পুতুল খেলায়।’ ‘বাংলাদেশকে ইতর সময় ও ইতর মানুষ হতে মুক্ত করার দিন এখনই। সমবেত মানুষরা তা করবেই।
×