ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দুই নেত্রীর আলোচনা কতটুকু যুক্তিযুক্ত?

প্রকাশিত: ০৪:১৪, ২৭ জানুয়ারি ২০১৫

দুই নেত্রীর আলোচনা কতটুকু যুক্তিযুক্ত?

(২৬ জানুয়ারির পর) এই যে দৃষ্টিভঙ্গি- এটি হচ্ছে সাধারণকে দূরে রাখা, যারা বিভিন্ন পেশায় মর্যাদাবান তাদেরও নিম্নস্তরের মানুষ মনে করা। এটি মানুষকে অপমান, নিজের আত্মগরিমা জাহির করা, খালেদা জিয়া জানেন কিনা জানি না, একটি প্রবচন আছে, যে যত ওপরে উঠবেন তিনি তত বিনয়ী হবেন। এই মানুষকে মানুষ মনে না করা, যারা মর্যাদাবান তাদের পার্শ্বচর মনে করা- এটি ভদ্রতার কোন ব্যাপার নয়। আমি খুব অবাক হয়েছি, প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে এটিএন বাংলার জ. ই. মামুন সাংবাদিক হয়ে সর্বসমক্ষে এই বিষয়টি তুলে ধরেছিলেন। এতে তিনি হয়ত বিএনপি-জামায়াতের অসন্তোষের মুখে পড়বেন কিন্তু তিনি নিজের ক্ষোভ জানিয়ে নিজের সম্মানটা রেখেছেন। শেখ হাসিনাও সংবাদ সম্মেলন করেন। আগেও করেছেন। কেউ বলতে পারবেন না তিনি কোন পেশাজীবী সাংবাদিক বা সাধারণ মানুষের সঙ্গে মর্যাদাহানিকর ব্যবহার করেছেন। রাজনীতিতেও এই দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছে। বিএনপি কখনও আলোচনায় আসতে চায়নি। আলোচনার ছলে ভায়োলেন্স দিয়ে দাবি আদায়ে বাধ্য করতে চেয়েছে। অতীতেও তারা এ কাজটি করেছে এবং সফল হয়েছে। এখনও তারা ভেবেছিল তারা সফল হবে। ভায়োলেন্সের মাধ্যমে যদি কোন দল বা ব্যক্তি দাবি আদায় করতে পারে তাহলে সমাজরাষ্ট্রে তা একটি অতি ক্ষতিকর উদাহরণ হয়ে থাকবে। কারণ সবাই তখন সব কিছু ভায়োলেন্সের মাধ্যমে আদায় করতে চাইবে। ৮. এ প্রসঙ্গে খালেদা জিয়ার চতুর্থ দাবি বিবেচনা করা যেতে পারে। তিনি বলছেন, নির্বাচনের আগে সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দিতে হবে। এর একটা কারণ আছে। বাংলাদেশে বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জামায়াত সবাই সেনা বন্দনায় অভ্যস্ত। বিএনপি-জামায়াত-জাতীয় পার্টিকে সেনাবাহিনী প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ২৫ বছর মদদ দিয়েছে। ঐ আমলের সেনা কর্মকর্তারা ছিলেন পাকিস্তান বাহিনীর অংশ। পাকিস্তানী মন তাঁরা ত্যাগ করতে পারেননি। ঐ তিন দল মনে করে, ঐতিহ্যগত সেনারা তাদের সমর্থন দেবে। এখন পরিস্থিতি বদলেছে। মঈনউদ্দীনের পর থেকে যাঁরা কর্মকর্তা হবেন তাঁরা বাংলাদেশ প্রশিক্ষিত। ম্যানুয়েল হয়ত পাকিস্তানের। তবুও এত বছরের ঘাত-প্রতিঘাত দেখে তাঁদের হয়ত একটি অভিজ্ঞতা হয়েছে, রাজনীতিতে না জড়িয়ে কর্পোরেট স্বার্থ হাসিল করা উত্তম। এবং আওয়ামী লীগও তাদের ভয় করে, ঐতিহ্যগত কারণে তাদের সমর্থক মনে করে না। এ আমলে সামরিক বাহিনীর কর্পোরেট ইন্টারেস্ট যতটা রক্ষিত হয়েছে অন্য কোন আমলে নয়। একটি উদাহরণ দিই, একজন সামরিক কর্মকর্তার কর্পোরেট স্বার্থের কারণে মেট্রোরেলের লাইন বদল হলো। তাতে রাষ্ট্রের ক্ষতি হলো কয়েক শ’ কোটি টাকা এবং জাতীয় ঐতিহ্য লুই কানের সংসদ ভবনের সৌন্দর্য ও নিরাপত্তা বিনষ্ট হলো। প্রত্যেকটি ঠিকাদারি কাজেও তারা জড়িত। সুতরাং, পুরনো ভারসাম্য এখন আর নেই। খালেদার এই দাবির পেছনে একটি যুক্তিই কাজ করছে। তা হলো, ২০০১ সালের নির্বাচনে সেনাবাহিনীকে লতিফুর রহমান ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়েছিলেন বিএনপি-জামায়াতকে জেতানোর জন্য। সেনা কর্মকর্তাদের হাতে নির্বাচনের আগের দিন সাদা খামও পৌঁছানো হয়েছিল এটি কোন গোপন ব্যাপার ছিল না। নির্বাচনের আগে ও পরে যেভাবে পেটানো হয়েছিল আওয়ামী কর্মীদের তা আর কহতব্য নয়। লতিফুর ও তত্ত্বাবধায়ক উপদেষ্টাদের কারণেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার এখন প্রশ্নের সম্মুখীন। সেই অভিজ্ঞতার কারণেই যাঁরা ভায়োলেন্সে বিশ্বাস করেন না, সিভিল সমাজে বিশ্বাস করেন, তাঁরা এই দাবির সঙ্গে একমত হবেন। মঈনউদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সামরিক সরকারের কারণে আমরাও মনে করি এখন যে এই তত্ত্ব জনবিরোধী। খালেদা জিয়ার ৬ নম্বর দাবি নিয়ে আলোচনা হলেও পাঁচ নম্বর দাবি মানা সরকারের পক্ষে সম্ভব হবে না। বিএনপি দাবি করবে, প্রশাসনের সবাইকে বদল করতে হবে। এবং তা করতে হলে লতিফুরের উপদেষ্টা চৌধুরীকে আনতে হবে। সেটি সম্ভব হবে না। আর জামায়াত দর্শনে বিশ্বাসী ও ধর্ম নিয়ে মিথ্যা প্রচারণা চালানো মিডিয়াকেও স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়া যাবে না; কারণ, তারা অন্যের স্বাধীনতা খর্ব করে। ৯. এ দেশের স্বাধীনতা অর্জনে নেতৃত্ব দিয়েছে আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগপ্রধান ছিলেন। [পরে দলীয় পদ তিনি ত্যাগ করেন বটে] কিন্তু ১৯৬৯ সালের পর থেকে তিনি আর দলীয়প্রধান হিসেবে নন, জাতীয় বীর বা বঙ্গবন্ধু হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। ১৯৭১ সাল থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বা মুক্তিযুদ্ধকে একটি প্রত্যয় হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। এ প্রত্যয়ের মূল ছিল ধর্মরাষ্ট্র ভেঙ্গে একটি সেক্যুলার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন, যেখানে মানুষের ধর্ম মূল বিষয় নয়; মূল বিষয় মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক মুক্তি। স্বাধীনতা বা মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে বিএনপি কোনভাবেই জড়িত নয়। জামায়াত জড়িত হত্যাকারী দল হিসেবে। জামায়াত পাকিস্তানবাদ বজায় রাখতে চেয়েছে। পাকিস্তান বা পাকিস্তানবাদও একটি প্রত্যয়। এ প্রত্যয়ের মূল বিষয়, পাকিস্তান যে ধরনের ধর্মরাষ্ট্র ছিল [বা আছে] সে কাঠামো সমর্থন। ধর্মরাষ্ট্রের অর্থ ধর্ম ব্যবহৃত হবে সাধারণ মানুষকে দমন ও পীড়নে। অর্থাৎ সাধারণের সব কিছু ধর্মের নামে ভায়োলেন্সের সাহায্যে দমন করা হবে। সিভিলিয়ান শাসন হবে সামরিক শাসনের কর্তৃত্বাধীন। এ ‘ধর্মরাষ্ট্র’ যারা সমর্থন করবে তারাই শাসন করবে। ১৯৭১ সালের দ্বন্দ্বটা এখানেই নিহিত। কিন্তু আমরা মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতিটা তো অক্ষুণœ রাখতে পারিনি। এই রাজনীতির যে আধিপত্য বিস্তার করার কথা তা তো করতে পারেনি। যে কারণে জাতীয় শোক দিবসও বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে পরিণত হয় ‘এক ব্যক্তির মৃত্যু দিবসে’। এ বিষয়গুলো খতিয়ে দেখলে বর্তমান রাজনীতির সঙ্কট উপলব্ধি করা সহজ হবে। আমাদের কিছু বোধহীন মানুষ, মতলববাজ মানুষ, পাশ্চাত্যের অনেকে মনে করেন; দুটি দল বা ১০ নেতা মিলেমিশে কাজ করে না কেন? তা হলেই তো রাজনীতি সরল হয়ে যায়। তা হলে প্রশ্ন জাগে, ফ্যাসিস্ট বা নাজি দল বা নতুন নাৎসিদের রাজনীতি করতে দেয়া হয় না কেন? কারণ, যে আদর্শের ভিত্তিতে রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয় সে আদর্শের বিরোধিতা করা রাষ্ট্রের বিরোধিতা। সেটি আধুনিক, সভ্য রাষ্ট্রে সম্ভব নয়। এসব মিলে সৃষ্টি হয়েছিল জিঘাংসার ও প্রতিশোধের। বাংলাদেশের প্রতীক ছিলেন বঙ্গবন্ধু। সে জন্য তাঁর বিনাশ ছিল ষড়যন্ত্রের লক্ষ্য। কিন্তু তারা দূরদর্র্শীও ছিল। সে কারণে তাদের প্রতীক এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী প্রতীক প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন ছিল। তারা জিয়াউর রহমানকে খুঁজে পেয়েছিল। এভাবে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের নায়করা তাদের এজেন্ট খুঁজে পেল বাংলাদেশে। তারা এতটাই দূরদর্শী ছিল যে, এমন একজনকে বেছে নিয়েছিল যিনি মুক্তিযুদ্ধে জড়িত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী গোলাম আযম টাইপের কাউকে বসালে যে তা চলবে না এটি বুঝতে তাদের অসুবিধা হয়নি। পাকিস্তানী মানসিকতা তো একেবারে বিলুপ্ত করা যায়নি। সেনাবাহিনীর মধ্যে প্রবলভাবে তা ছিল। এসব পাকিস্তানীমনাকে একত্রিত করার জন্য দরকার ছিল একটি মঞ্চের। মার্কিন দলিলপত্রেই আছে, কিভাবে এ কারণে বিএনপির প্রতিষ্ঠা করা হলো। পাকিস্তানীমনারা বিএনপির পতাকাতলে একত্রিত হলেন। মুক্তিযোদ্ধা ভাবটা থাকায় এক ধরনের বিভ্রান্তি জনমানসে সৃষ্টি করা গেছে। সে কারণে মতলববাজরা বা মওদুদ, বদরুদ্দোজ্জা, হুদা টাইপের লোকজনকেও আনা সম্ভব হয়েছিল। যেমন, দেখুন, মওদুদ লিখেছেন : ১৫ আগস্ট জন্মদিন পালন করা রুচিবিগর্হিত। অর্থাৎ, তিনি তো বিবেকবান, স্বচ্ছ চিন্তার লোক। কিন্তু রাজনীতি করেন তিনি যারা ১৫ আগস্ট জন্মদিবস পালন করে তাদের সঙ্গে। বিএনপির ভিত্তি শক্ত করার জন্য জামায়াতকে রাজনীতিতে জিয়া নিয়ে এলেন যে দলকে ক্রিমিনাল অর্গানাইজেশন হিসেবে বঙ্গবন্ধু নিষিদ্ধ করেছিলেন। ভিন্ন দল হলেও যেই জামায়াত-বিএনপি কখনও বিচ্ছিন্ন হবে না। তারা একে অপরের পরিপূরক। তাদের সুকৌশলী স্ট্র্যাটেজির কারণে আজ তারা শক্তিশালী দল। বঙ্গবন্ধু দেশকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। অপ ও অপরাধমূলক রাজনীতির স্বার্থে জিয়াউর রহমান দেশ ও জাতিকে বিভক্ত করলেন। আমরা যখন এ দুটি রাজনৈতিক দলের কর্মকা- বিবেচনা করি তখন এ মূল বিষয়টি সযতনে এড়িয়ে কোন্ দল অপকর্ম করছে বা করছে না তা বিচার করে, তর্ক বাধিয়ে বিভ্রান্তির রাজনীতি প্রসারিত করি। সে কারণে, ১৫ আগস্টে যখন পেছন ফিরি তখন মনে হয়, ১৯৭১ সালে আমরা ভেবেছিলাম, জাতিরাষ্ট্র গঠন সম্পন্ন হয়েছে; আসলে তা হয়নি। আমরা ভেবেছিলাম, ধর্মরাষ্ট্র থেকে মুক্তি পেলাম; আসলে পেলাম না এবং জনসংখ্যার একটি বড় অংশ ক্রমান্বয়ে মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতির বিপক্ষে অংশ নিল। এটি বাঙালীর বড় ট্র্যাজেডি। দুঃখের বিষয়, আমরা সমাজের সব অংশের কিছু মানুষজন এ ট্র্যাজেডি সৃষ্টিতে সক্রিয় ভূমিক রেখেছি। প্রমাণ করেছি, মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া যতটা সহজ ছিল মুক্তিযোদ্ধা থাকাটা তত সহজ ছিল না। প্রমাণ করেছি, আমরা যতটা না বাঙালী তার চেয়ে বেশি মুসলমান- পরে বাঙালী মুসলমান। গত প্রায় পাঁচ শ’ বছর মুসলমান সমাজ পৃথিবীকে তেমন কিছু দিতে পারেনি। এখন তো মনে হচ্ছে সেটি আরও অসম্ভব হয়ে উঠছে। (চলবে)
×