ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

...সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়

প্রকাশিত: ০৪:১৩, ২৭ জানুয়ারি ২০১৫

...সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের কালপঞ্জিতে ২৪ জানুয়ারি গণঅভ্যুত্থান দিবস। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের স্মরণে দিনটি পালন করা হয়, যে অভ্যুত্থানের কারণে পাকিস্তানের লৌহমানব প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের দশ বছরের সামরিক স্বৈরাচারের পতন ঘটেছিল। খালেদা জিয়ার চলমান অবরোধের কারণে এই দিবস পালনের কর্মসূচী সীমাবদ্ধ ছিল সংবাদপত্রের পাতায়। কয়েকটি দৈনিকে দিবসটির তাৎপর্য উল্লেখ করে নাতিদীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। তিনটি পত্রিকায় ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম নায়ক বর্তমান বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের একটি লেখা ছাপা হয়েছে। আমার ও মুনতাসীর মামুনের প্রথম মিছিলে যাওয়া এই ’৬৯-এর অভ্যুত্থান থেকে। তখন আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষের ছাত্র। কী অসাধারণ আন্দোলন! ছাত্রদের পাশাপাশি শ্রমিক কৃষকসহ সর্বস্তরের মানুষ কারফিউ উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমে এসেছে। আমরা স্লোগান দিয়েছি ‘রাজবন্দীদের মুক্তি চাই’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘জয় বাংলা’ ইত্যাদি। মিছিলে গুলি করা হয়েছে। ২৪ জানুয়ারি মিছিলে স্লোগানরত কিশোর মতিউর শহীদ হয়েছেন। এর চার দিন আগে ছাত্রনেতা আসাদ শহীদ হয়েছেন। কবি শামসুর রাহমান সঙ্গে সঙ্গে লিখেছিলেন তাঁর কালজয়ী কবিতা ‘আসাদের শার্ট’। আমরা যারা মিছিলে ছিলাম আমাদের হাতে ককটেল ছিল না, পেট্রোলবোমা ছিল না। ঢাকার কয়েকটি ভবনে আগুন লাগানো হয়েছিল বটে, সেগুলো ছিল বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিচারকদের বাসভবন, সরকারী মালিকানাধীন দৈনিক বাংলার ভবন এবং কয়েকটি সরকারী দফতর। এসব আগুনে কেউ নিহত হয়নি, কোন যানবাহনে পেট্রোলবোমা মেরে নিরীহ মানুষ হত্যা করা হয়নি। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের কারণে বঙ্গবন্ধু ও মণি সিংহসহ কারারুদ্ধ নেতারা জেল থেকে বেরিয়ে এসেছেন, পাকিস্তানের লৌহমানব প্রেসিডেন্টকে গদি ছাড়তে হয়েছে। এই ছিল তখনকার রাজনৈতিক আন্দোলন, যে ধারা ’৯০-এর দশক পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। সকালে লিখতে বসেছিলাম আমার অনিয়মিত কলাম, যার বিষয় ছিল বিএনপি-জামায়াতের চলমান অবরোধের ক্ষয়ক্ষতিÑ শিরোনাম ছিল ‘খালেদা জিয়ার সামান্য ক্ষতি।’ এক-তৃতীয়াংশ লেখা শেষ হয়নি, নির্মূল কমিটির সাধারণ সম্পাদক কাজী মুকুল টেলিফোনে জানিয়ে দিলেন মুন্সীগঞ্জে আমাদের জনসভা, একটার ভেতর রওনা না দিলে সাড়ে তিনটার ভেতর পৌঁছতে পারব না। একাত্তরের ঘাতক দালাল-নির্মূল কমিটির ২৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে সারাদেশে বিভিন্ন শাখা গত এক সপ্তাহ ধরে সভা-সমাবেশ আয়োজন করছে বিএনপি-জামায়াতের অবরোধ হরতাল থাকা সত্ত্বেওÑ যা আরও এক সপ্তাহ চলবে। মুকুলের ফোন পেয়ে লেখা বন্ধ করে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে হলো। আমাদের সঙ্গে নির্মূল কমিটির আইন সম্পাদক, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার ড. তুরিন আফরোজও যাবেন। তুরিনকে বলা হয়েছিল আমরা সবাই মহাখালীর অফিস থেকে রওনা হব। খালেদা জিয়ার রাজনীতি কখনও সমর্থন করিনি। তাঁর প্রতিহিংসার রাজনীতির কারণে কিভাবে আমার পেশাগত সাংবাদিক জীবন শেষ হয়ে গেছে, কিভাবে আমাকে ও মুনতাসীর মামুনকে কারাগারে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে এ নিয়ে অনেক লিখেছি। শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে তো খালেদা জিয়ার বিএনপি সরকারের রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ মাথায় নিয়ে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। এ সবই আমরা জানি। তারপরও তার কনিষ্ঠপুত্রের অকাল মৃত্যুতে বেদনার কথা ভেবে বিষণœ বোধ করেছি। মঞ্চে আমার দুই পাশে আমাদের দুই নেতা মুকুল ও তুরিন বসেছিলেন। তাদের বললাম, আজ বক্তৃতায় আমি খালেদা জিয়ার প্রতি সমবেদনা জানাব। দুজনই শুনে বিস্মিত হয়েছিলেন। তুরিন বললেন, নির্মূল কমিটির সভাপতি হিসেবে আপনার কি এ ধরনের কিছু বলা ঠিক হবে? মুকুল মনে করিয়ে দিলেন, মঞ্চে আওয়ামী লীগের জেলা সভাপতি ছাড়াও শ্রোতাদের অর্ধেকের বেশি আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থক। আমি দুজনকে নিরস্ত করলামÑ আমাকে আমার মতো বলতে দাও। সভায় বক্তার সংখ্যা কম ছিল না। সভাপতি জানতে চাইলেন, আমি কতক্ষণ বলব। তাকে বললাম, সবাই বলার পর মাগরিবের আজান পর্যন্ত যতটুকু সময় থাকে আমি ততক্ষণই বলব। মাগরিবের নামাজের পর শুরু হবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সভাপতি অন্য সব বক্তাকে বক্তব্য সংক্ষিপ্ত করতে বললেন। আমার জন্য বরাদ্দ হলো তিরিশ মিনিট। বিএনপি-জামায়াতের অবরোধের কারণে জীবন ও সম্পদহানির উল্লেখ করে বললাম, আজ আমি বিশ দলীয় জোট নেত্রীর সমালোচনা করব না। আপনারা সমাবেশে থাকার কারণে সম্ভবত খবর পাননি, আজ দুপুরে খালেদা জিয়ার কনিষ্ঠপুত্র আরাফাত রহমান কোকো মৃত্যুবরণ করেছেন। সন্তানহারা মায়ের দুঃসহ বেদনা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ উপলব্ধি করতে পারবেন না। গত দু’সপ্তাহ ধরে সরকারবিরোধী আন্দোলনের নামে চলমান অবরোধে এ পর্যন্ত একত্রিশ জন মায়ের বুক খালি হয়েছে। সন্তানহারা মা’দের বিলাপ আর আহাজারি যখন টেলিভিশনে দেখি, খবরের কাগজে পড়িÑ আমাদের বুক ভেঙ্গে যায়। অসহায় নিরীহ মানুষের মৃত্যুর এই মিছিল দেখার জন্য আমরা বাংলাদেশ স্বাধীন করিনি। আজকের এই সমাবেশ থেকে আমি আমাদের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী, বিএনপির চেয়ারপার্সন, বিশ দলীয় জোটের নেত্রীকে আমার গভীর সমবেদনা জানাতে চাই। আশা করি তিনি আমার সমবেদনা গ্রহণ করবেন এবং অনুভব করবেন তার অবরোধ ও হরতালের কারণে প্রতিদিন যে সব মায়ের বুক খালি হচ্ছে তাদের বেদনার দহন কতটা তীব্র। প্রতিদিন টেলিভিশনে দেখছি সন্তানহারা মায়েরা কীভাবে বিলাপ করছেন। একজন মা খালেদা জিয়াকে অভিশাপও দিয়েছেন। আমরা আশা করব আর যাতে কোন মায়ের বুক খালি না হয় অন্তত এটুকু অনুভব করে খালেদা জিয়া আন্দোলনের বিকল্প কর্মসূচীর কথা ভাববেন। সভা শেষ করে যখন ঢাকার কাছে এসেছি তখন একটি টিভি চ্যানেলের এক সাংবাদিক ফোন করে জানালেন, রাত আটটায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যাবেন বেগম খালেদা জিয়ার গুলশানের কার্যালয়ে তাঁকে সমবেদনা জানাবার জন্য। আমাকে তাদের টক শো-এ আমন্ত্রণ জানালেন। আমি সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করে বলেছিÑ আজ আমি সব টিভি চ্যানেল দেখব, কোথাও আলোচনায় যাব না। শেখ হাসিনার এই সিদ্ধান্তের কথা আমার অনুজপ্রতিম সহযোদ্ধাদের জানালাম। আমরা সবাই একমত হলামÑ একজন মমতাময়ী মা হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর এই সৌজন্য বাংলাদেশের হিংসা-বিদ্বেষপূর্ণ অসহনশীল রাজনৈতিক পরিবেশে শান্তির বাতাবরণ সৃষ্টি করবে। তিনি যখন এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন নিশ্চয় তিনি ভুলে গিয়েছিলেন তাঁর চরম শোকের দিনটিতে, যে ১৫ আগস্ট তিনি তাঁর বাবা, মা, তিন ভাইসহ পরিবারের সতেরো সদস্যকে হারিয়েছেন। প্রতিবছর সেই দিন নকল জন্মদিন পালন করে খালেদা জিয়া কিভাবে উল্লাস প্রকাশ করেন। ১৫ আগস্ট আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের স্বাধীনতা দিবস। ১৯৭৫-এর পর থেকে ভারত বাঙালী জাতির এই চরম শোকের দিনে বাংলাদেশে তাদের স্বাধীনতা দিবসের কর্মসূচী পালন করতে গিয়ে কোন আনন্দ-উৎসব করে না। গত বছরও ভারতে নরেন্দ্র মোদি যখন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন জাতীয় কংগ্রেসকে সম্পূর্ণ ধরাশায়ী করে বিপুল ভোটে বিজয়ী হলেন, তাঁর মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের তারিখ একদিন পিছিয়ে দিয়েছিলেন, কারণ সেই দিনটি ছিল কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীর স্বামী, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর মৃত্যুদিবস। প্রধানমন্ত্রী নির্ধারিত সময়েই খালেদা জিয়ার অফিস কাম-বাসভবনে এসেছিলেন। তাঁর সঙ্গে মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্যবৃন্দ এবং দলের প্রবীণ নেতৃবৃন্দ ছিলেন। উপস্থিত সাংবাদিকরা, সমবেত বিএনপির কর্মী-সমর্থকরা এবং টেলিভিশনের সামনে অপেক্ষমাণ আম-জনতা অবলোকন করলাম প্রধানমন্ত্রীর গাড়িবহর পৌঁছানোর কয়েক মিনিট আগে খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী শিমুল বিশ্বাস ভয়ঙ্কর অবিশ্বাস্য ভাষায় সাংবাদিকদের জানালেন, তাদের নেত্রীকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর দেখা হবে না। আমরা শিমুল বিশ্বাসের ইনজেকশনের গল্পটি প্রথমে বিশ্বাস করেছিলাম। পরে একাত্তর টেলিভিশনে মধ্যরাতের আলোচনা অনুষ্ঠানে বিএনপির ‘চিন্তাকলস’ প্রবীণ সাংবাদিক সাদেক খান হাটে হাঁড়ি ভেঙ্গে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ইনজেকশনের কাহিনীটি সত্য নয়। খালেদা জিয়া কর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করার জন্যই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেননি। কারণ দেখা করলে কর্মীরা ভাবত এরপর এসব করে কী হবে! আশাবাদী সাংবাদিক শ্যামল দত্ত বলেছেন, তিনি সাদেক খান নয়, শিমুল বিশ্বাসের বক্তব্যই বিশ্বাস করতে চান। তিনি আশা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রীকে ভেতরে এনে বসিয়ে বিএনপি নেতারা কথা বলবেন। খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারীর ঔদ্ধত্যপূর্ণ অশিষ্ট আচরণ ও মিথ্যাচারে আমাদের বিস্মিত হওয়া উচিত নয় এ কারণে যে, এসব শিক্ষা তো তিনি তাঁর নেত্রীর কাছ থেকেই পেয়েছেন। আমি জানি না এরপরও খালেদা জিয়ার প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মমত্ব ও সৌজন্যবোধ বজায় থাকবে কি না। তবে খালেদা জিয়ার প্রতি আমরা যত সহানুভূতিই দেখাই না কেন তাঁর এখনকার অবস্থা হচ্ছে সন্তানহারা বাঘিনীর মতো। যাদের এ বিষয়ে ধারণা আছে তারা জানেন সন্তানহারা বাঘিনী প্রতিপক্ষকে হত্যা করবার জন্য তার পক্ষে যত দূর যাওয়া সম্ভব সে যাবে। আমরা জানি না আর কত মায়ের কোল খালি হলে খালেদা জিয়ার প্রতিহিংসার আগুন নির্বাপিত হবে। একইভাবে আমরা জানি না সন্ত্রাসবিরোধী আইনে জামায়াত নিষিদ্ধ করবার জন্য আর কত সন্ত্রাস-হত্যা দেখতে হবে। আমরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের মতো শুধু বলতে পারি ‘...আমি আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়।’ ২৫ জানুয়ারি ২০১৪
×