ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নাদিরা মজুমদার

ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবস এ বছর রাষ্ট্রীয় অতিথি ওবামা

প্রকাশিত: ০৩:৩৪, ২৬ জানুয়ারি ২০১৫

ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবস এ বছর রাষ্ট্রীয় অতিথি ওবামা

২৬ জানুয়ারি ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবস। এই দিনটি ভারতের সবচেয়ে বড় জাতীয় দিবসও বটে, তারপরে আসে স্বাধীনতা দিবস ও গান্ধীজয়ন্তী। প্রজাতন্ত্র দিবস আসলে শাসনতন্ত্র দিবসই। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতাপ্রাপ্তির দুই বছর তিন মাসের মাথায় ১৯৪৯ সালেই ভারত একটি শাসনতন্ত্র তৈরি করে ফেলেছিল। শাসনতন্ত্রটিকে আনুষ্ঠানিক রূপ দেয়া হয় ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি (সেইসঙ্গে ১৯৩০ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস কর্তৃক ’পূর্ণ স্বরাজ’ ঘোষণার তারিখটিকে অমর করে রাখা হয়)। ১৯৫০ সাল থেকে ভারত প্রজাতন্ত্র দিবস পালন করে আসছে। ১৯৫৫ সাল থেকে, প্রতিবছর, ২৬ জানুয়ারি দিল্লীর ‘রাজপথ’ উৎসবমুখর হয়ে ওঠে, ‘জনগণ মন অধিনায়ক’ দিয়ে শুরু আর তিন দিন বাদে ’সারা জাঁহা সে আচ্ছা’ (ইকবালের তারানা-ই-হিন্দি) দিয়ে উৎসবের সমাপ্তি হচ্ছে। (অর্থাৎ বিটিং রিট্রিট দিয়ে, অতি পুরনো এই কাস্টমটি সাবেক ব্রিটিশ রাজদের কাছ থেকে পাওয়া)। প্রজাতন্ত্র দিবসের উৎসবে ভিনদেশী রাষ্ট্রপ্রধানকে নিমন্ত্রণ করে আনার প্রথা ১৯৫০ সাল থেকেই চালু হয়। নেহরু তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। প্রথম প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রথম প্রধান অতিথি ছিলেন ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট সুকার্নো। নেহরু, সুকার্নো, টিটো, গামাল আব্দুল নাসের, উ নু (বার্মা), কোয়ামে ন্ক্রুমা (ঘানা)-রা ১৯৬১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘কোন শক্তি-ব্লকে নেই আমরা’ তথা জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন (নাম) প্রতিষ্ঠা করেন। এ পর্যন্ত যারা রাষ্ট্রীয় অতিথি হয়ে আসেন, তাঁদের বিরাট অংশজুড়ে থাকে নামের দেশ, অধিকাংশই সব ‘প্রায় নগণ্য’ ছোট দেশ, তবে বিলাতের রানী এলিজাবেথ একবার এসেছিলেন, দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী জন মেজরও। এমনকি পাকিস্তান পর্যন্ত দুইবার আতিথ্য গ্রহণ করেছিল। চীনও। যুক্তরাজ্য ছাড়াও ফ্রান্স এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পরবর্তীকালে রুশ ফেডারেশন একাধিকবার আমন্ত্রিত হয়েছে। তিনটি দেশই ভারতের সামরিক হার্ডওয়ারের সুবাদে মিত্রদেশ। তবে শেষোক্ত এই তিন দেশের মধ্যে কেবলমাত্র ভারত-রুশ সম্পর্কই সুগভীর স্ট্র্যাটেজিক বন্ধুত্বের ওপরে প্রতিষ্ঠিত। কখনই রাজনৈতিক ‘ডিকট্যাট’ দ্বারা কলুষিত হয়নি, দীর্ঘকাল ধরে পরীক্ষিত আস্থা, অকৃত্রিম আন্তরিকতার দৃঢ় ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সম্পর্ক একটি। তাই রাজনৈতিক দল নির্বিশেষে অতি প্রশস্ত ঐকমত্যের ওপরে প্রতিষ্ঠিত বলে, যে পার্টিই কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় আসুক না কেন, তাতে সম্পর্ককে মলিন করে না। আবার উভয় দেশই ব্রিক্সভুক্তও বটে। অবশেষে ২০১৫ সালের প্রজাতন্ত্র দিবসে, বহু কাক্সিক্ষত রাষ্ট্রীয় অতিথি হওয়ার সুযোগ পায় যুক্তরাষ্ট্র, প্রথমবার। শত ব্যস্ততার মধ্যেও প্রেসিডেন্ট ওবামা সুযোগটি হারাতে পারেন না, অতিথি হচ্ছেন ঠিকই। ‘নামে’র অন্যতম প্রধান কর্ণধার হিসেবে ভারতের বৈদেশিক নীতির ভিত্তির জোর কোথায়, আন্দাজ করা সহজ। ফলে, ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক কোনকালেই আহামরির পর্যায়ে পৌঁছতে পারেনি, স্ট্র্যাটেজিক বন্ধুত্ব তো নয়ই। বরং আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারতীয় অবস্থান, দুই দেশের সম্পর্ককে যে ফ্রিজিং পয়েন্টে নামিয়ে এনেছিল, সেটি আরও নিচে নেমে আসে ১৯৯৮ সালের রাজস্থানের মরুভূমিতে পোখরান-২ পারমাণবিক বিস্ফোরণ পরীক্ষার কারণে। ২০০৮ সালে পারমাণবিক চুক্তি সই ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে স্বর্ণযুগের সূচনা করলেও পাঁচ বছরের মাথায় সব কেমন তছনছ হয়ে যায়। নিমিত্ত দেবযানী খোবরাগাড়ে উপাখ্যান (২০১৩)। উপাখ্যানটিকে কেন্দ্র করে সরকারী দল, ডানপন্থী, বামপন্থী, চীনপন্থী রাজনৈতিক দল নির্বিশেষে সারাভারত যে চূড়ান্ত ও সমন্বিত কর্মসূচী গ্রহণের ইতিহাস সৃষ্টি করে, আমরা তাতে ঈর্ষান্বিত হতে পারি মাত্র! দেবযানী ছিলেন নেহায়েত ছোট মাপের কূটনীতিক, তাঁকে স্ক্যান্ডালের মারপ্যাঁচে ফেললে প্রতিক্রিয়া যে এমন হবে, ভুল হিসাব হয়। ভারতের জন্যও ছিল ‘ধৈর্য পরীক্ষার শেষ বিন্দু।’ ভারত যে ‘ইটের বদলে পাটকেলটির ব্যবস্থা নেবে’, বুঝতে পারেনি। এমনকি মার্কিন রাষ্ট্রদূত ন্যান্সি পাওয়াল অকালে পদত্যাগ করে দেশে ফিরে যান। একইভাবে, ড্যান মজেনা ২০১৩ সালের অক্টোবর মাসে ঢাকা থেকে দিল্লীতে যান স্পেশাল মিশনে, কিন্তু শিবশঙ্কর মেননসহ উচ্চপদস্থ কূটনীতিকদের, খালেদা জিয়ার পক্ষে, শেখ হাসিনাকে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন থেকে বিরত রাখার লবিংয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেন। পশ্চিমকে, সম্পর্কের উন্নয়ন- অবনয়ন প্রশ্নে ভারত, চীন বা রুশ ফেডারেশনকে একক দেশ হিসেবে বিবেচনার অভ্যাসটি বদলাতেই হবে অর্থাৎ, ভারত-চীন, ভারত-রুশ, চীন-রুশ সম্পর্ক পৃথক পৃথকভাবে গ্রহণের সুযোগ আর নেই। এরা সবাই ব্রিক্সভুক্ত, ২০০৮ সাল থেকে অর্থনৈতিক মন্দায় মুমূর্ষু ইউরোজোনকে ব্রিক্স এবং একক রাষ্ট্র হিসেবে চীন ও ভারত প্রচুর সাহায্য করে আসছে। বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা প্রশ্নে, বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের স্বত্বাধিকার (ইনটেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস, আইপিআর) প্রশ্নে, কর বা ভিসাসংক্রান্ত বিষয় বা রুশ প্রশ্নে, আফগানিস্তান কি ইসলামী স্টেট প্রশ্নে, মার্কিনীনীতির সঙ্গে ভারত দ্বিমত প্রকাশ অব্যাহত রেখেছে। মোদ্দা কথা হলো যে রুশদের সঙ্গে বিদ্যমান ঐতিহাসিক সম্পর্ককে পাতলা করার (যেমন : ফ্রান্স রুশদের হেলিকপ্টারবাহী মিস্ট্রাল জাহাজের সরবরাহ আটকে রাখায়, ভারতও কুড়ি বিলিয়ন ডলারের রাফায়েল ফাইটার সরবরাহের ফরাসী চুক্তিটি ঝুলিয়ে রেখেছে), ইচ্ছা ভারতের নেই। একইভাবে, চীনের সঙ্গে ভূখ-ীয় বিবাদে জড়িত দেশগুলোর সঙ্গে নিরাপত্তামূলক চুক্তি সম্পাদন করে আঞ্চলিক সমস্যাকে আন্তর্জাতিক রূপ দেয়ার মার্কিনী প্রচেষ্টাকে সমর্থন করে না ভারত। তাই, চীন-ভারত সীমান্ত বিরোধকে অভ্যন্তরীণ সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে ভারত ও চীন বাণিজ্য, স্ট্র্যাটেজিক ও সামরিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা করে যাচ্ছে। সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার সঙ্গে সম্পর্ক নিবিড় হচ্ছে, ইউরেশীয় কাস্টমস ইউনিয়ন ব্রিক্সয়ের জন্যও উন্মুক্ত হচ্ছে। জাতীয় ইস্যু ও নীতির প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের মধ্যে প্রায়ই ভিন্নমত পোষণ করার দৃষ্টান্ত রয়েছে প্রচুর। বরং যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে একাধিকবার নোংরা চাতুরির অভিজ্ঞতা প্রাক্তন ইউপিএ সরকারের হয়েছে। যেমনÑ স্নোডেনের উন্মোচন থেকে জানা যায় যে, দুই দেশের মধ্যে বন্ধুসুলভ বিশেষ সম্পর্ক থাকলে কী হবে, মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা এজেন্সি এনএসএ-এর প্রিয় সার্ভেইলেন্স টার্গেটগুলোর মধ্যে ভারতও রয়েছে। এনএসএ ইচ্ছামতো নিয়মিতভাবে তথ্য সংগ্রহ ও কমিউনিকেশন ইন্টারসেপ্টের কাজ করে গেছে বা ২০০৯-১০ সালের দিকে রুশ সহযোগিতায় দক্ষিণ ভারতে নির্মীয়মাণ পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপনের বিরুদ্ধে কয়েকটি দেশী এনজিও তুমুল প্রতিবাদ বিক্ষোভে নেমেছিল। পরে সরকারী তদন্তে আবিষ্কার হয় যে মার্কিন সরকারের যে কয়েকটি ফাউন্ডেশন রয়েছে, সেসব ফাউন্ডেশন দেশী এনজিওগুলোকে বিভিন্ন প্রজেক্টে ‘স্পন্সর’ করে থাকে। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং প্রকাশ্যে উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন। রুশ ও চীনসহ অন্য অনেক দেশেরই ’দেশী আধা দেশী’ এনজিও নিয়ে একই অভিজ্ঞতা রয়েছে। এনজিওগুলোর ফাইন্যান্সিং ব্যবস্থা কড়া করে দেয়ার প্রতিক্রিয়ার ঝাপ্টা বেশ কড়া ডোজের। যেমনÑ বারবারা ক্রসেটের মতো অনেক সাংবাদিকই ভারতকে ‘এলিফ্যান্ট ইন দি রুম’ বলে থাকেন। কারণ ক্রসেটের মতে, আফগানিস্তান, ইরান, ভেনিজুয়েলা, উত্তর কোরিয়া, পাকিস্তান, এবং সম্ভবত উদীয়মান চীন বিশ্বীয় আতঙ্কের আকর বলে মনে করা হয়, কিন্তু ভারত সম্বন্ধে রোমান্টিক কল্পনায় অনেকেই বিভোর! চীন ও রুশদের সঙ্গে সম্মিলিত হয়ে ভারত মানবাধিকারবিষয়ক প্রস্তাবাবলীর বিরুদ্ধে নাশকতামূলক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নিউইয়র্ক সফরকালে হোয়াইট হাউস মোদিকে লাল কার্পেটের অভ্যর্থনা দেয় ঠিকই, মোদি-ওবামা আলোচনা এবং ওয়াশিংটনে মোদির উচ্চপদস্থ কেবিনেট সদস্যরা মিটিংও করে, কিন্তু দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান মত-পার্থক্য থেকেই যায়। সুরাহা যে হবে না, জানত বলেই হয়ত মার্কিন পত্র-পত্রিকাগুলো মোদির ভ্রমণের সংবাদ প্রথম পাতায় দেয়নি। তবে মোদির জন্য অমার্জিত দুই চমক রেডি করা ছিল। ২০০২ সালে গুজরাটের দাঙ্গাহাঙ্গামার জন্য যুক্তরাষ্ট্র মোদিকে দোষারোপ করে এবং ২০০৫ সালে মোদির যুক্তরাষ্ট্রের ভিসার আবেদন নাকচ করে দেয়। ২০১৪ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে নামতে না নামতেই ২০০২ সালের দাঙ্গার আসামি করে, মোদির হাতে ফেডারেল কোর্টে হাজিরা দেয়ার সমনপত্র ধরিয়ে দেয়া হয়। অবশ্য প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ও কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধীসহ ভারতীয় নেতাদের কোর্টে হাজিরা দেয়ার সমনপত্র পাওয়ার অতীত অভিজ্ঞতা রয়েছে। একে তাই আরেকটি ‘খোঁচা’ দেয়া বলা যায়। দ্বিতীয় চমক নিয়েও বিশেষ কিছু বলার নেই, কারণ, ইউরো-আটলান্টিকের মিডিয়া সাধারণত ভিনদেশ বা ভিনমত নিয়ে তীব্র ব্যঙ্গ বিদ্রƒপ করে কার্টুন প্রকাশ করতে ভালবাসে। ২০১৩ সালে ভারত যে মঙ্গলায়নকে (মার্স অর্বিটার মিশন বা মম) পাঠিয়েছিল, ২০১৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর সে মঙ্গল গ্রহের কক্ষপথে সফল প্রবেশ করে। যে কোন দেশের জন্য এটি একটি ঈর্ষণীয় সাফল্য, ভারতের জন্যও। ২০১৪ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্ক টাইমস পরিপাটি একটি কার্টুন ছাপেÑ পাগড়ি পরা গরিব এক লোক, সঙ্গে দড়ি ধরে টেনে আনা একটি গরু ‘এলিট স্পেস ক্লাবে’র দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে, ‘ক্লাবে’ বসা দুই সাদা চামড়ার লোকের হাতে খবরের কাগজ, টপ হেডলাইনে ‘মমে’র সাফল্যের খবর, অনাহূতের ধাক্কায় তারা যে বিরক্ত, দৃশ্যমান। ৩০ সেপ্টেম্বর, (২০১৪) ওয়াশিংটন পোস্টে মোদি এবং ওবামা ‘একবিংশ শতাব্দীতে মার্কিন-ভারত সম্পর্কের নবায়ন’ হেডিংয়ে যৌথ একটি সম্পাদকীয় লেখেন। অতীতের জমাট বাঁধা ভারত-মার্কিন সম্পর্ককে স্বাভাবিক করে আনার জন্য ওবামাকে প্রজাতন্ত্র উৎসবের রাষ্ট্রীয় অতিথি করলে ভারতের তরফ থেকে মার্জিত বোধেরই প্রকাশ ঘটে।
×