ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বার্ন ইউনিটে মারা গেল আবদুর রহিম ও পরিচয়হীন শিশু জাকির

প্রকাশিত: ০৫:১২, ২৪ জানুয়ারি ২০১৫

বার্ন ইউনিটে মারা গেল আবদুর রহিম ও পরিচয়হীন শিশু জাকির

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বিএনপির টানা অবরোধের পেট্রোলবোমায় দগ্ধ বগুড়ার ট্রাক হেলপার আবদুর রহিম (৩০) ও পরিচয়হীন শিশু জাকির হোসেন (১৩) না ফেরার দেশে চলে গেছে। এতে বাড়ছে লাশের মিছিল। দগ্ধদের তালিকা ক্রমেই দীর্ঘতর হচ্ছে। শুক্রবার সকালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আবদুর রহিম ও বৃহস্পতিবার গভীররাতে শিশু জাকিরের মৃত্যু হয়েছে। প্রতিদিনই সহিংস রাজনীতির আগুনের পুড়ে মরার সঙ্গে ওদের সাজানো সংসার তছনছ হয়ে গেছে। আহতের তালিকা ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে। চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে সাধারণ মানুষ। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের কর্তৃপক্ষ জানান, বিএনপির টানা অবরোধের সহিংসতায় দগ্ধ হয়ে বগুড়ার ট্রাক হেলপার আবদুর রহিম, সাভারের শিশু জাকির হোসেন, মগবাজারে প্রাইভেটকার চালক আবুল কালাম হাওলাদার, ট্রাকের হেলপার যশোরের মুরাদ মোল্লা ও রংপুরের তছিরন বেগম চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছে। বর্তমানে ২১জন দগ্ধ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। কারও মুখম-ল, কারও সারা শরীর পুড়ে গেছে। হাসপাতালের বেডে এসব পোড়া মানুষ দুঃসহ যন্ত্রণায় ছটফট করছেন। টানা অবরোধে অবরোধকারীদের পেট্রোলবোমায় দগ্ধ হয়ে এ পর্যন্ত ৪০জন বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা নিয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র জানায়, বিএনপি-জামায়াতের টানা ১৮দিন অবরোধে ৩১জন দগ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন প্রায় শতাধিক। জানা গেছে, বৃহস্পতিবার রাতে বগুড়ার নুনগোলায় অবরোধকারীদের পেট্রোলবোমায় ট্রাকের হেলপার আবদুর রহিম ও ট্রাক চালক টিটন মিয়া, ফার্নিচার ব্যবসায়ী সাজু মিয়া মারাত্মক দগ্ধ হন। পরে ট্রাক হেলপার আবদুর রহিমকে শুক্রবার ভোর ৪টার দিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার সকাল সোয়া ১০টায় তাঁর মৃত্যু হয়। নিহত আবদুর রহিমের বাবার নাম আবদুল আলেক মুল। মা মাজেদা খাতুন। গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ভোমরা ইউনিয়নের শ্রীপুরে। ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের আবাসিক চিকিৎসক ডাঃ পার্থ শংকর পাল জনকণ্ঠকে জানান, পেট্রোলবোমার আগুনে আবদুর রহিমের শ্বাসনালীসহ শরীরের ৩৩ শতাংশ পুড়ে যায়। তিনি জানান, ওই ঘটনায় ট্রাকে থাকা দগ্ধ ফার্নিচার ব্যবসায়ী সাজু মিয়ার চিকিৎসা চলছে। তার শরীরের ২০ ভাগ পুড়ে গেছে। আবদুর রহিমের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে এই পরিবারের সাজানো সংসার তছনছ হয়ে গেছে। স্বামীর লাশের পাশে বিলাপ করছিলেন স্ত্রী মর্জিনা আক্তার মুন্নি। বার বার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। বিলাপ করে বলছিলেন, আমার দুই সন্তানের পড়ালেখার খরচ কে চালাবে। সংসার চলবে কিভাবে। ওরা কেন আমার স্বামীকে পুড়িয়ে মারল। ওদের কি বাবা, মা, সন্তান নেই। আল্লাহ, তুমি ওদের বিচার কর। ওরা যেভাবে আমার স্বামীকে পুড়িয়ে মেরেছে। আমার দুই সন্তানকে এতিম করেছে। আল্লাহ, তুমিও যেন তাদের সেই অবস্থায় রেখ। নিহতের ভাই সাখাওয়াত হোসেন সুজন কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, আবদুর রহিমের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ওদের সংসারের মৃত্যু হয়েছে। তার বড় ছেলে সম্রাট (১৩) শ্রীরামপুর স্কুলে ৮ম শ্রেণীর ছাত্র। ছোট মেয়ে সুমাইয়া (৮) তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে। তিনি জানান, ছেলে-মেয়ের স্কুলে ভর্তির টাকা যোগাড়ের জন্য অবরোধের মধ্যে ট্রাক নিয়ে বের হন আবদুর রহিম। বৃহস্পতিবার রাতে বগুড়া থেকে ফার্নিচার নিয়ে ঢাকায় উদ্দেশে রওনা দেয় তাদের ট্রাকটি। বগুড়া-নামুজা সড়কের নুনগোলায় পৌঁছলে রাত ৮টার দিকে অবরোধকারীরা ট্রাকটিতে আগুন দিয়ে পালিয়ে যায়। ততক্ষণে আগুন ট্রাকে ছড়িয়ে পড়ে। ট্রাকে আটকা পড়ে ভাই রহিম ও ফার্নিচার ব্যবসায়ী সাজু দগ্ধ হয়। আর ট্রাক চালক টিটেন মিয়া কোন রকমে ট্রাকের দরজা খুলে রাস্তায় লাফিয়ে পড়ে। খবর পেয়ে পুলিশ তাদের তিনজনকে মারাত্মক দগ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে শুক্রবার ভোর ৪টার দিকে ভাই রহিম ও ব্যবসায়ী সাজুকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু ভাই রহিমকে বাঁচানো গেল না। এখন ভাইয়ের সংসার কে চালাবে। একমাত্র উপার্জনক্ষম ভাই রহিমকে হারিয়ে পুরো পরিবার অন্ধকার দেখছে। দুই স্কুলপড়ুয়া সন্তান ও বৃদ্ধ বাবা-মাকে কে দেখবে। কে ওদের সংসার চালাবে। নিহতের স্বজনরা অভিযোগ করেন, আবদুর রহিমের চিকিৎসার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে অনুদানের ১০ হাজার টাকা তারা পাননি। লাশ বহনে খরচ বাবদ ২০ হাজার টাকাও তারা পাননি। এর আগে রাতে বগুড়া সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল বাসার জানান, বগুড়া থেকে ফার্নিচার নিয়ে ঢাকায় উদ্দেশে রওনা দেয় একটি ট্রাক। বগুড়া-নামুজা সড়কের নুনগোলায় পৌঁছলে রাত ৮টার দিকে ট্রাকটিতে আগুন দিয়ে পালিয়ে যায় অবরোধ-হরতাল সমর্থকরা। সংবাদ পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নেভায়। এতে চালক টিটেন মিয়া (৩৬), হেলপার রহিমসহ তিনজন দগ্ধ হন। ট্রাকটির অধিকাংশই পুড়ে গেছে। এতে ঢাকা মেডিক্যালে মারা যান ট্রাক হেলপার আবদুর রহিম। ওসি জানান, রাতেই এ ঘটনায় বিএনপি-জামায়াতের ১০৩ নেতাকর্মীর নামে মামলা হয়েছে। শুক্রবার সকালে তার মৃত্যুর পর মামলাটি হত্যা মামলা হিসেবে রূপান্তর করা হবে। তিনি জানান, মামলায় শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে নুনগোলা ইউনিয়ন জামায়াতের সেক্রেটারি মোঃ মনিরুজ্জামান, ইউনিয়ন শ্রমিক দলের সভাপতি মোঃ রানা ও সাধারণ সম্পাদক আতিকুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদিকে সাভারে দগ্ধ হওয়ার ১০ দিন পর অবশেষে শিশু জাকির ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ বার্ন ইউনিটে বৃহস্পতিবার গভীররাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। এতদিনও হতভাগ্য এই শিশুর খোঁজে কেউ আসেনি। তার লাশের খোঁজে কেউ না এলে তাকে বেওয়ারিশ হিসেবে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের কাছে হস্তান্তর করা হবে। একসময় বেওয়ারিশ হিসেবে তার লাশ দাফন হয়ে যাবে। হয়ত তার স্বজনরা তাকে খুঁজে ফিরবে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, শিশু জাকিরের শরীরের ৭০ শতাংশ পুড়েছিল। হাসপাতাল সূত্র জানায়, গত ১৩ জানুয়ারি রাতে সাভারের নবীনগরে পথচারীরা দগ্ধ জাকিরকে উদ্ধার করে গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। সেখানে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষই শিশুটির চিকিৎসার দায়িত্ব নেয়। ডাঃ আশরাফ তার চিকিৎসার দায়িত্বে ছিলেন। আগুনে দগ্ধ হওয়ার পর থেকেই হতভাগ্য শিশুটি নিজের নাম ছাড়া কিছুই বলতে পারেনি। খুঁজে পাওয়া যায়নি তার কোন স্বজনকে। আশুলিয়ার গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে টানা নয় দিন চিকিৎসাধীন ছিল শিশু জাক্রিু। তারা জানান, কয়েক ব্যক্তি সাভার বাসস্ট্যান্ডে গাড়ি থেকে শিশুটিকে অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় এই হাসপাতালে ফেলে যায়। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে ডাঃ আশরাফ তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে এনে ভর্তি করেন। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওদিন রাত সোয়া ১টার দিকে তার মৃত্যু হয়। টানা অবরোধে অবরোধকারীদের পেট্রোলবোমায় দগ্ধ বরিশাল থেকে রেশমা বেগম (৩০), তার স্বামী মাহবুব আলমকে (৪০) শুক্রবার সকালে ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছে। তাদের মতো আরও ১৯ জন দগ্ধ এখন বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন । এদের কারও মুখম-ল, কারও হাত- পা ও কারও সারা শরীর পুড়ে গেছে। তাদের মধ্যে সিএনজি অটোরিকসা চালক সিদ্দিকুর রহমান, অশিতিপর আবু তাহের, বেল্লাল হোসেন জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। অবরোধের আগুনে দগ্ধ রোগী ও তাদের স্বজনদের চিৎকার, হাহাকার ও আহাজারি থেমে থেমে চলছেই। কারও সান্ত¡নাতেই তা থামছে না। অবরোধের আগুনে দগ্ধ হয়ে নিরীহ এসব সাধারণ মানুষ মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। আহতদের স্বজনরা একরাশ ক্ষোভে বলেন, অবরোধের আগুনে কোন রাজনৈতিক নেতার গাড়ি কিংবা স্বজনরা জ্বলছে না। পুড়ছে আমাদের মতো সাধারণ মানুষ এবং পুড়ছে আমাদের সহায়-সম্বল, বেঁচে থাকার স্বপ্ন, সবকিছু। অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছে তাদের পরিবার। দগ্ধদের দেখতে বার্ন ইউনিটে রওশন ॥ হরতাল-অবরোধ দিয়ে দেশব্যাপী সহিংসতা না করতে বিএনপির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ। শুক্রবার বেলা সাড়ে ১১টায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে দগ্ধদের দেখতে গিয়ে এ আহ্বান জানান তিনি।
×