ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দুই নেত্রীর আলোচনা কতটুকু যুক্তিযুক্ত?

প্রকাশিত: ০৩:০৪, ২৪ জানুয়ারি ২০১৫

দুই নেত্রীর আলোচনা কতটুকু যুক্তিযুক্ত?

( শেষাংশ) ৫৯ জেলার ১৪৭টি আসনে ১২টি রাজনৈতিক দলের ৩৯০ প্রার্থী অংশগ্রহণ করেন। ভোটার ছিল ৪ কোটি ৩৯ লাখ ৩৮ হাজার ৩৮। সকাল থেকে ভোটকেন্দ্রে কোন ভোট নেই। অধিকাংশ মিডিয়াই এ কথা প্রচার করতে থাকে। কিন্তু কেন ভোটাররা আসছে না তার কারণ তারা উল্লেখ করছিল না। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভোটকেন্দ্রে ভোটার সংখ্যা বাড়তে থাকে। একটি কেন্দ্রে জামায়াত-বিএনপি আক্রমণ করলে যৌথবাহিনীর গুলিতে দু’জন গুলিবিদ্ধ হয়। এ ঘটনা শোনার পর ভোটকেন্দ্র ভরে ওঠে। আমি খুব আশাবাদী ছিলাম না। ৩০ ভাগ ভোট পড়লে তাতেই সন্তুষ্ট ছিলাম। শাহরিয়ার অবশ্য বলেছিল, ব্রিটেনে ২১ ভাগ ভোট পেয়ে ক্ষমতায় গেলে এখানে বিদেশীরা কেন বেশি আশা করে? মিডিয়া প্রচার আমাদের আরও হতাশ করে তুলছিল। এমনকি মানস ঘোষ, দৈনিক স্টেটসম্যানের সম্পাদক, আমাদের সুহৃদ, কয়েক ঘণ্টা পর পর ফোন করে জানতে চাচ্ছিলেন কি অবস্থা। রাতে শোনা গেল ৩৫ ভাগের ওপর ভোট পড়েছে। তারপর জানা গেল প্রায় ৪১ ভাগ। স্থগিত কেন্দ্রগুলোতে ভোটের পর সেই হার আরও বেড়েছে। ১৯৯১ সালে এ হার ছিল ৫৫.৪৫ ভাগ। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি নির্বাচনে ২৬ ভাগ। সে সময়ও আওয়ামী লীগ বয়কট করেছিল। পার্থক্যটা হচ্ছে আওয়ামী বয়কটের পর ২৬ ভাগ। আর এখন বিএনপি-জামায়াত বয়কটের পরও ৪২ ভাগ। এর কারণ হচ্ছে নির্বাচনটিকে ভোটাররা নিছক ক্ষমতা বদলের মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করেনি। আদর্শের লড়াই হিসেবে, গাফ্ফার চৌধুরীর ভাষায়Ñ ‘একাত্তরের নতুন রণাঙ্গন’ হিসেবে বিবেচনা করেছে। যে কারণে, মার খেয়ে, সরে গিয়েও এবং যে হিন্দুদের ভোট দেয়ার কথা ছিল না, তারাও ভোট দিয়ে প্রমাণ করতে চেয়েছে, এ দেশটা জামায়াত-বিএনপি, কিছু সুশীল বাটপাড় ও মিডিয়াকে শুধু লিজ দেয়া হয়নি। গাফ্ফার চৌধুরী বোধহয় আবেগ সামলাতে না পেরে, চারযুগ পর একটি কবিতাই লিখে ফেলেছিলেন, যার শেষ স্তবকটি ছিল এ রকম- “নির্বাচনকে রুখতে তাহারা মানুষ মেরেছে পুড়ে ধ্বংস এবং রক্তের বান ছড়ায়েছে দেশজুড়ে। নারী-ধর্ষণ শিশু হত্যার ঘটায়েছে মহাপাপ। এরা নররূপী পশু, এরা বাংলার অভিশাপ ॥ এই অভিশাপ ঘোচাতেই আজ সুকঠিন সংগ্রাম দানবের সাথে যুদ্ধের তরে প্রস্তুতি অবিরাম ॥ সব ভয়ভীতি কাটিয়ে জাগুক বাংলার জনগণ এ ত নির্বাচন নয়, একাত্তরের নতুন রণাঙ্গন ॥” ৫. বিএনপির এক নম্বর ও দু’নম্বর দাবির প্রাসঙ্গিকতা আছে কিনা তা উপর্যুক্ত বিবরণেই পাওয়া যাবে। তবে, হ্যাঁ, দুই ও তিন নম্বর দাবির ব্যাপারে আলোচনা হতেই পারে। কিন্তু শর্ত দিয়ে তো নয়। ১ নম্বর দাবি সাংবিধানিকভাবেই বাস্তবায়িত করা যাবে না। সংবিধান সংশোধন করলেও। কারণ, উচ্চ আদালত আবার তা বাতিল করবেন। এটি জানা সত্ত্বেও কেন বার বার এ দাবি তুলছে বিএনপি-জামায়াত? কারণ, তারা জানে আদর্শগত লড়াইয়ে তারা হেরে যাচ্ছে। তাই তত্তা¡বধায়ক সরকারকে আশ্রয় করে তারা এগুতে চায়। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর মিডিয়া এবং বিএনপি-জামায়াত এ্যাপলজিস্টরা যা বলছিলেন এখনও তাই বলছেন। সেই সময় দেশজুড়ে সহিংসতা চলছিল এবং মিডিয়া পরোক্ষে গণতন্ত্রের নামে তাদের সন্ত্রাস সমর্থন করছিল। এবার সন্ত্রাসী কার্যকলাপ শুরু হলে মিডিয়া ও সেই সুশীলরা ঠিক একই কথা বলছেন। কারণ, পরিস্থিতি তো ২০১৪ সালের মতো। আমি ঐ সময়ের কিছু উদাহরণ দেব, তার সঙ্গে আজ যারা মিডিয়াতে বক্তব্য রাখছেন সেখানে কোন অমিল খুঁজে পেলে জানাবেন। জামায়াত-বিএনপি ও সুশীলদের প্রকৃতি বাংলাদেশের সবেচেয়ে চালু পত্রিকা দৈনিক প্রথম আলোয় একটি সংবাদের শিরোনাম “শুধু ‘একতরফা’ নয়, ‘প্রাণঘাতী’ নির্বাচন।” তারা বোঝাতে চেয়েছে উর্ধকমার শব্দ দুটি তাদের নয়। কিন্তু তারা শব্দ দুটি বেছে নিয়েছে; কারণ, তারা এমনটিই মনে করে। প্রতিবেদনের প্রথম প্যারাটি এ রকমÑ “ ‘একরতফা’ তকমার পাশাপাশি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ইতিহাসের পাতায় ‘প্রাণঘাতী’ নির্বাচন হিসেবেও চিহ্নিত হয়ে থাকবে। পরিসংখ্যান বলছে, নির্বাচনের আগে এত বিপুলসংখ্যক প্রাণহানির ঘটনা বাংলাদেশের কোন নির্বাচনের আগে ঘটেনি।” [০৫.১.২০১৪] কিন্তু এই প্রাণহানির কারণ কী? প্রতিবেদনে তা স্পষ্ট নয়। এরপর মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমানের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে প্রতিবেদনের শেষ করেছে ‘এ পর্যন্ত নাগরিকদের জানমাল রক্ষার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র খুব সফলতার পরিচয় দিতে পেরেছে বলে আমাদের প্রতীয়মান হয়নি।” (্ঐ) মূল বিষয়টি কী দাঁড়াল তাহলে? নির্যাসটি হলো-প্রাণঘাতী নির্বাচন হচ্ছে এবং এতে যারা আহত হচ্ছেন বা প্রাণ দিচ্ছেন রাষ্ট্র অর্থাৎ সরকার তাদের রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। আচ্ছা, এই হত্যাগুলো কারা করেছে? প্রতিবেদনে তার কোন উল্লেখ নেই। সুশীলরাও অনবরত তফসিল ঘোষণার পর এ ধরনের কথাই বলে এসেছেন। মিডিয়াও কখনও উল্লেখ করেনি, কারা এসব করছে। হ্যাঁ, বলেছে, দুর্বৃত্তরা এসব করছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানীদের নির্দেশে মিডিয়া ‘মুক্তিযোদ্ধা’ শব্দটি ব্যবহার করত না, লিখত ‘দুষ্কৃতকারী।’ কোন কোন সংবাদপত্র ও টিভি আরেকটু নির্দিষ্ট করে বলেছে, ‘নির্বাচনবিরোধীরা।’ অধুনা মিডিয়ার দৌলতে অধিক পরিচিত ‘সুজন’ও একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছে। এর প্রধান জনাব মজুমদার সুশাসন চান দেখে সুজনের মতো এনজিও করেছেন। তো সুশাসনের প্রতিবন্ধক শুধু আওয়ামী লীগ? বিএনপি-জামায়াত নয়? তারা আবার একটি আলোচনাসভা করেছিলেন। সেখানেও ভায়োলেন্সের সমালোচনা করা হয়েছে এবং তা যে গণতন্ত্রবিরোধী তাও বলা হয়েছে। কিন্তু এই বিরোধের মূল কারণ যে যুদ্ধাপরাধ বিচার সে বিষয়ে একটি কথাও কেউ উল্লেখ করেননি। এমনকি কারা এর জন্য দায়ী তাও আলোচনায় আসেনি স্পষ্টভাবে। নির্বাচন ঘোষণার পর প্রায় ১৫০ জন প্রাণ হারিয়েছেন। টার্গেট করে পুলিশ, বিজিবি ও আনসারদের আক্রমণ করা হয়েছে। তাদের অনেককে পিটিয়ে, পুড়িয়ে মারা হয়েছে। পেট্রোলবোমা ছুড়ে শিশু, মহিলা, বৃদ্ধ, তরুণ, মধ্যবয়সীদের পুড়িয়ে মারা হয়েছে। এঁরা সব সাধারণ মানুষ, দরিদ্র। সাধারণ মানুষকে নিয়ে রাজনীতি অথচ তাদেরই পুড়িয়ে মারা হয়েছে, কুপিয়ে মারা হয়েছে, গুলি করে মারা হয়েছে, পিটিয়ে মারা হয়েছে। কিন্তু কারা করেছে উল্লিখিত সুশীলরা জানেন না। কারণ, তারা বিরোধীদের সমর্থক দেখে প্রকাশ্যে তাদের নাম বলেননি। আমরা আগেও বলেছি, এখনও বলছি-এগুলো করেছে বিএনপি-জামায়াতের কর্মীরা। এবং এর নির্দেশ দিয়েছেন এ দুটি দলের নেতারা। সাদেক হোসেন খোকা ওরফে ধোঁকা (নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর ভাষায়) প্রকাশ্যে হত্যা করার কথা বলেছেন, অন্যারা গোপনে-এই যা তফাৎ। জামায়াত-শিবির-বিএনপির এবং ১৬ দলের (একত্রে ১৮ দল) কর্মীরা শিক্ষামন্ত্রীর তথ্য অনুযায়ী ৫৩১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আগুন দিয়েছে। পাকিস্তানের পর থেকে এ পর্যন্ত ৬৭ বছরে কোন নির্বাচনে এমনটি ঘটেনি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা আছে। তবে, মাদ্রাসার সংখ্যা কম। নির্বাচনের কিছুদিন আগে শিক্ষাবর্ষ শুরুতে অন্য ছাত্ররা নতুন বই পেয়েছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে কয়েকটি মাত্র ঘটনা আছে গ্রন্থাগার পুড়িয়ে দেয়ার। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পোড়ানো অনেকটা সেই ধাঁচের। চীনের শি হুয়াংতি কনফুসিয়াস এবং আরও অনেকের বই পুড়িয়েছিলেন। হালাকু খান বাগদাদের গ্রন্থাগার পুড়িয়ে দিয়েছেন। রোমক এক সম্রাট আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরি ধ্বংস করেন। জার্মানির নাজিরা ব্যাপক হারে বই পুড়িয়েছিল। এখানে বিদ্যালয় কারা পোড়ালো? সুশীলরা জানেন না? জানলে নিশ্চয় বিবৃতি দিতেন। নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রার্থীদের তথ্য ডাউনলোড করা যাচ্ছে না- সেটির নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেয়া হয়েছে। নির্বাচন একতরফা হচ্ছে সেটি নিয়ে হরেক রকম বক্তব্য, প্রতিবাদ করা হয়েছে। কিন্তু ৫৩১টি বিদ্যালয় পুড়িয়ে দেয়ার ব্যাপারে এদের কোন বক্তব্য, নিন্দা দেখিনি। বলেননি তারা যে, বিএনপি-জামায়াত চায় এ দেশে অন্ধকার যুগ ফিরে আসুক। জ্ঞান চর্চা বড় নয়, বড় হচ্ছে মাসল চর্চা।
×