ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অবরোধের বোমায় গরিব পরিবারটির স্বপ্ন খান খান

প্রকাশিত: ০৫:১৮, ২৩ জানুয়ারি ২০১৫

অবরোধের বোমায় গরিব পরিবারটির স্বপ্ন খান খান

গাফফার খান চৌধুরী ॥ অবরোধের বোমা কেড়ে নিল রাজধানীর সরকারী কবি নজরুল ইসলাম কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীর ছাত্র সানজিদ হাসান অভিকে (২০)। ছেলেকে আইনজীবী বানানোর ইচ্ছে ছিল। বড় সাধ ছিল ছেলের মাধ্যমে মানুষকে আইনী সেবা দেয়ার। ছেলেকে মানুষ করার টাকা যোগাতে হিমশীতের মধ্যেও সদরঘাট বুড়িগঙ্গা নদীর ধারে বসে দিনরাত ডিম বিক্রি করতেন অভির পিতা। কিন্তু সে স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেল। অভি আর অভির পরিবারের স্বপ্নের সব চাকা থেমে গেল অবরোধের বোমার বিস্ফোরণে। অভির পরিবার আর গ্রামের বাড়িতে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। অভির পিতা দেলোয়ার হোসেনের (৫৫) বাড়ি মুন্সীগঞ্জ জেলার শ্রীনগর থানাধীন আটপাড়া গ্রামে। স্ত্রী নুরজাহান বেগম রিতা। অভাবের সংসারে তিন সন্তান। বড় মেয়ে সালমাকে এলাকাতেই বিয়ে দিয়েছেন। সংসারের অভাব দূর করতে দুই ছেলে অভি আর দেড় বছর বয়সী সানজুসহ স্ত্রীকে নিয়ে ২০০৬ সালে ঢাকায় আসেন। ব্যবসা শুরু করেন সদরঘাটে। ব্যবসা বলতে তেমন কিছুই নয়। পাশের মহাজনের কাছ থেকে বাকিতে ডিম কিনে রাস্তার ধারে বসে তা বিক্রি করা। বুড়িগঙ্গার পাড়ে নিত্য ডিম বিক্রি করতেন। প্রচ- হিমশীতের ভেতরেও ছেলের প্রাইভেট আর পড়াশুনার খরচ যোগাতে সদরঘাটে বসে ডিম বিক্রি করতেন। সংসারে অভাব, তাই বলে অশান্তি ছিল না। একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। মেয়ে সুখী। কিন্তু বিধি বাম। মাত্র তিন মাস আগে একমাত্র মেয়ে সন্তান জন্ম দেয়ার সময় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত সালমার (২৫) মৃত্যু হয়। মেয়ে হারানোর সেই শোক কাটিয়ে ওঠার আগেই আরেক শোকে এবার পাথর হয়ে গেলেন বাবা দেলোয়ার। মেয়ের মৃত্যুর পর দুই ছেলেকে মানুষ করতে মরিয়া হয়ে ওঠেন পিতা। দুই ছেলেকে মানুষ করে সুখের সংসার গড়ার স্বপ্ন নিয়ে আবার নতুন উদ্যোমে কাজ শুরু করেন। হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খাটতে থাকেন অভির পিতা। অনেক কষ্টে ছেলেকে এসএসসি পাস করান। ছেলেকে আইনজীবী বানাতে স্বপ্নের জাল বুনছিলেন পিতা দেলোয়ার। তাই এসএসসি পাস করার পর ছেলেকে নিজের ব্যবসার সাহায্যকারী করেননি। ছেলেকে মানুষের মতো মানুষ করতে ভর্তি করে দেন পুরান ঢাকার সরকারী কবি নজরুল ইসলাম কলেজে। ছেলে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীর প্রথম বর্ষে কলা বিভাগে পড়াশুনা করছিল। কলেজ পড়ুয়া ছেলের খরচ নেহায়েত কম নয়। তাই বেশি টাকা রোজগার করতে অনেক শীতের মধ্যেও ডিম বিক্রি করতেন। একদিকে ছেলের খরচ, আরেকদিকে মাসিক সাত হাজার টাকা বাসা ভাড়া। দুই ছেলে আর স্ত্রীকে নিয়ে পরিবারটির বসবাস পুরানা ঢাকার সূত্রাপুর থানাধীন কলতাবাজারের কুঞ্জবাবু লেনের ১০ নম্বর বাড়িতে। অভাবের সংসার। তাই ছেলে কলেজে পড়াশুনার পাশাপাশি দুই একটি টিউশনি করত। যতসামান্য উপার্জন করে সংসারে সহায়তা করত। আর অবসরে পিতার ডিম বিক্রিতে সহায়তা করত। তাই বলে পড়াশুনা ফাঁকি দিয়ে নয়। নিয়মিত পড়াশুনা আর প্রাইভেট পড়ত। গত ১৪ জানুয়ারি বিএনপির ডাকা দেশব্যাপী টানা অবরোধের মধ্যেই প্রাইভেট পড়ে বাসযোগে বাসায় ফিরছিল অভি। অভিকে বহনকারী বাসটি ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট সংলগ্ন এনেক্স ভবনের সামনে যাওয়ামাত্র তাতে বোমা মেরে আগুন ধরিয়ে দেয় অবরোধকারীরা। মারাত্মক দগ্ধ হয় অভি ও আরেক যুবক সজীব (২২)। আহতদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। অভি মাথা ও চোখে মারাত্মক আঘাতপ্রাপ্ত হয়। সজীব কোনমতে টিকে গেলেও জীবন যুদ্ধে হেরে গেল অভি। অভিকে বাঁচানোর জন্য চিকিৎসকরা প্রাণান্ত চেষ্টা করতে থাকেন। কিন্তু কোন চেষ্টাই অভিকে বাঁচাতে পারেনি। ওপারের ডাক আসে। বুধবার রাত তিনটার দিকে চিকিৎসকরা অভিকে মৃত ঘোষণা করেন। মৃত্যু হয় অভি আর তার পরিবারের স্বপ্নের। চিরতরে থেমে যায় স্বপ্নের চাকা। অভির পিতা-মাতা, ছোট ভাই আর আত্মীয়স্বজনদের কান্না কিছুতেই থামছে না। তাঁদের কান্নায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের বাতাস ভারী হয়ে যায়। দুপুর দুটোর দিকে অভির লাশ হস্তান্তর করা হয় পরিবারের কাছে। অভির মামা রফিকুল ইসলাম জনকণ্ঠকে জানান, অভির মৃত্যুর খবরে সকাল থেকেই তাঁদের গ্রামের বাড়িতে অশ্রুসজল নয়নে ভিড় করছেন শত শত মানুষ। বিকেলে লাশবাহী এ্যাম্বুলেন্স গ্রামের বাড়িতে পৌঁছলে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। অশ্রুসিক্ত শত শত মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। তাঁরা এমন হত্যার বিচার ও অবরোধ আহ্বানকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন। বিকেলেই পারিবারিক কবরস্থানে অভিকে সমাহিত করা হয়। এখন কিভাবে চলবে অভিদের সংসার? দুই সন্তান হারানোর কষ্ট কিভাবে সামাল দেবেন অভির পিতামাতা? সেই চিন্তা আর শোকে বার বার মূর্ছা যাচ্ছেন অভির পিতামাতা। আর দেড় বছরের একমাত্র ছেলে অবুঝ সানজু পিতামাতার কান্না দেখে হাউমাউ করে কাঁদছে। তার কান্না দেখে অভিকে দেখতে আসা কেউ আর চোখের জল ধরে রাখতে পারেনি। পুরো গ্রামে কান্নার রোল পড়ে যায়।
×