ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দুই নেত্রীর আলোচনা কতটুকু যুক্তিযুক্ত?

প্রকাশিত: ০২:৫৫, ২৩ জানুয়ারি ২০১৫

দুই নেত্রীর আলোচনা কতটুকু যুক্তিযুক্ত?

(২২ জানুয়ারির পর) নির্বাচনের আগে সুশীল সুজনরাও আমরা যারা নির্বাচনের পক্ষে ছিলাম তাদের অনেককে গালমন্দ করেছেন। যে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী খুব বেশি টক শোতে যান না তিনিও সোচ্চার ছিলেন। রাজনীতিবিদদের মধ্যে ব্রীজোত্তম কাদের সিদ্দিকী ছিলেন। রাষ্ট্রদূতরাও হুমকি-ধমকি দিচ্ছিলেন। সুশীলদের হুমকি-ধমকিতে সরকার কর্ণপাত করেনি। পাকিস্তান, আমেরিকা, ইইউ-কে দিয়েও অনেক হুমকি-ধমকি দেয়া হয়েছে। শেখ হাসিনা কোন কিছুতেই কর্ণপাত করেননি। তারা ভেবেছিল, আমেরিকা বাংলাদেশকে বাধ্য করতে পারবে তাদের কথা শুনতে। সেটি হয়নি। ৩-৪ তারিখেও তাই তারা নির্বাচন স্থগিতের দাবি জানিয়েছিল,সরকার কর্ণপাত করেনি। এটি তাদের আত্মম্ভরিতায় ঘা দিয়েছে। বিএনপি-জামায়াত তাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করেছে। কয়েক শ’ মানুষ হত্যা করেছে। ১০০০-এর বেশি যানবাহনে আগুন দিয়েছে। কিন্তু তারপরও নির্বাচন হয়েছে। এটি তাদের স্তম্ভিত করেছে। তারা ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের কথা বেশি বলেন তুলনা হিসেবে। কিন্তু একটি বিষয় বোঝা দরকার। বেগম জিয়া বাধ্য হয়েছিল নতুন নির্বাচন দিতে। কারণ, মানুষ ছিল রাস্তায়, প্রশাসনও নেমে এসেছিল রাস্তায়, তার হুকুম তামিল করার মতো কেউ ছিল না। তার পক্ষের মানুষজনও রাস্তায় নামেনি। ২০১৪ সালেও জামায়াত-বিএনপির পক্ষে ব্যাপকভাবে রাস্তায় মানুষ নামেনি, প্রশাসন সরকারের [নির্বাচন কমিশন] নির্দেশ মেনেছে, ১৪ দলের পক্ষের মানুষজনও প্রতিরোধে প্রস্তুত ছিল, অন্তত শহরাঞ্চলে। সে কারণে, ১৯৯৬ সালের নির্বাচনপরবর্তী অবস্থা ও ২০১৪ সালের নির্বাচনপরবর্তী অবস্থা এক নয়। হলে নির্বাচনের পর পরই মানুষ রাস্তায় নামতেন এবং খালেদার মতো ১১ দিন পর নির্বাচন দিতে বাধ্য হতেন। সেটি তো হয়নি। সুতরাং যে সব সুশীল বাটপাড় ও এ্যাপোলজিস্ট ১৯৯৬ সালে খালেদা প্রদত্ত নির্বাচনকে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেন তা ধোপে টেকে না। ২০১৪ সালে বিএনপি-জামায়াতের প্রবল নৃশংসতা ছিল ১৯৭১ সালের মতো। এসব ঘটনা ১৯৭১-এর স্মৃতিকে জাগরূক করেছিল। অতীত দিয়ে মানুষ বর্তমানকে বোঝার চেষ্টা করেছেন এবং তারা দেখেছেন যে, ১৯৭১, ১৯৭৫, ১৯৯১, ২০০১- সব সময় এরা সন্ত্রাস চালিয়েছে বিরোধীদের দমন করার জন্য, খুন করতে পিছপা হয়নি। এদের ক্ষমতায় আনলে আবার ২০০১ বা ১৯৭১ ফিরে আসতে পারে। সে কারণে যারা পেরেছেন তারা ভোট দিয়েছেন। এবং নির্বাচনের পরেও বিএনপির পক্ষে তারা মাঠে নামতে রাজি হননি। এটিই সার কথা; যা আজকাল উল্লেখ করতে সবাই ভুলে যান। ৩. নির্বাচনের বৈশিষ্ট্য ২০১৪ সালের নির্বাচনের প্রধান বৈশিষ্ট্য প্রবল বিরোধিতা। সন্ত্রাসের পরও সরকার দৃঢ় থেকে তার লক্ষ্যে পৌঁছেছে। সরকার সব সময় বলেছে, তারা সংবিধান থেকে একচুলও নড়বে না। বিরোধীরা বলেছে, নড়তে হবে, সংবিধানের চেয়ে মানুষ ওপরে এবং নির্বাচন করতে হলে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করতে হবে। মানুষ সার্বভৌম এ যুক্তি সঠিক। কিন্তু ভোটের হার দেখলে ৪২ ভাগের ওপর মানুষ তো এ তত্ত্বাবধায়ক বিষয়ে একমত নয়। এর অর্থ, ভোটের হার অনুযায়ী ৩৩ ভাগের দাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সুতরাং, অন্তত এ ক্ষেত্রে সুশীল বাটপাড়দের এ যুক্তি সঠিক নয়। মাত্র কয়েকদিন আগে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি বলেছেন, মাইনরিটি বিভিন্ন অজুহাতে মেজরিটির ম্যান্ডেট চ্যালেঞ্জ করবে, সেটি কোন কার্যকর পদ্ধতি নয়। তাদের কাজ অন্যায়ের প্রতিবাদ জানানো ও ‘এক্সপোজ’ করা। সন্ত্রাস বা মানুষ হত্যা প্রতিবাদ নয়, যেখানে বলা হচ্ছে মানুষের জন্য রাজনীতি। এর আগে অনেকবার লিখেছি, আবারও লিখতে হচ্ছে, সুপ্রীমকোর্টের রায় যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পক্ষে না যেত তাহলে হয়ত খালেদা জিয়ার দাবি অনুযায়ী ব্যবস্থা করা যেত। কিন্তু সুপ্রীমকোর্টের রায়ে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, দুটি টার্ম ঐ ধরনের সরকার করা যেতে পারে যদি সংসদের সায় থাকে। দুই টার্ম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সংসদের সায় ছিল না। সুতরাং, আইনত সে সরকার আনা সম্ভব ছিল না। যদি নির্বাচনে আবার কেউ দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আসে তাহলে হয়ত সংসদের সায় থাকতে পারে। তখন তা করা যাবে কিনা, তাও আইনজ্ঞদের বিষয়। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে হলে নির্বাচনের মাধ্যমেই তো তা পেতে হবে এবং নির্বাচনে আসতে হবে। জামায়াত-বিএনপির এত বাঘা বাঘা আইনজীবী এ বিষয়টুকু জানেন না এটি বিশ্বাসযোগ্য নয়। কিন্তু তবুও তারা এবং তাদের সহযোগী সুশীলরা কেন বার বার ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছিলেন এবং দিচ্ছেন? কারণ একটিইÑ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। এ বিচারের রায়ে জামায়াতের নেতৃত্ব যারা দিচ্ছিলেন তারা থাকবেন না। ইতিহাসের কারণে তাদের সঙ্গে বিএনপির নেতাদের এক ধরনের সখ্য ও বোঝাপড়া আছে। পরের স্তরের নেতৃত্বের সঙ্গে সেটি ক্ষীণ। কিন্তু জামায়াতের ৫ ভাগ ভোটের জন্য বিএনপি কেন নিজেদের সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত করে তুলছে? কারণ, জামায়াতের অস্ত্র, অর্থ ও পেশীশক্তি। আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক। আইএসআইয়ের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ। ২০১৩-১৪ সালে রাস্তায় সন্ত্রাসে জামায়াত কিন্তু বড় ভূমিকা রেখেছে। সুতরাং, যুদ্ধাপরাধ ঠেকাতে নির্বাচনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে হবে এবং করা হয়েছেও। বিএনপি-জামায়াতের কৌশল ছিল নির্বাচন ইস্যুতে ব্যাপক সাড়া পাওয়া যাবে। নির্বাচন ঠেকানো যাবে। তারপর নির্বাচন কমিশন বদল ও লতিফুর টাইপের কাউকে প্রধান উপদেষ্টা বানিয়ে ২০০১ সালের মতো নির্বাচনে জেতা যাবে। এবং তখন মুক্তিযুদ্ধমনাদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়া যাবে। সুশীলদেরও তাতে সায় ছিল। কারণ, ঐ ধরনের শাসনে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় পদ পাওয়া সম্ভব এবং নিজেদের প্রভাবশালী করা সম্ভব। তারা কখনও ভাবেননি, এ কৌশল বৃথা যাবে বিশেষ করে আমেরিকার সমর্থন সত্ত্বেও। ২০১৪ সালের নির্বাচনের প্রধান বৈশিষ্ট্য; সমাজের সম্পূর্ণ মেরুকরণ যা পরে আলোচিত হয়েছে। আরেকটি বৈশিষ্ট্য প্রবল; হিংস্রতা, নিষ্ঠুরতা ও সন্ত্রাস। নির্বাচনে সাধারণত দুই পক্ষে সংঘর্ষ হয়। কিন্তু এখন পরিকল্পিতভাবে পুলিশ-আনসারদের হত্যা করা হয়েছে, নির্বাচনী অফিসার হত্যা করা হয়েছে, সাধারণ মানুষকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে, শিশুদেরও পুড়িয়ে মারা হয়েছে- এক কথায় কী হয়নি! এর রকম বর্বরতা এ আগে কখনও দেখা যায়নি। সুশীলরা, টকাররা সহিংসতা যে গণতন্ত্রের শত্রু তা মাঝে মধ্যে উল্লেখ করেছেন, সহিংসতা শরীর-স্বাস্থ্যের জন্য ভাল নয়, তাও কখনও কখনও উল্লেখ করেছেন কিন্তু কখনও প্রকাশ্যে জোরগলার বলেননি। এই সহিংসতা বিএনপি-জামায়াত করছে। এটি কাম্য নয়। এটি নিন্দনীয় এবং যে কোন আলোচনার পূর্বশর্ত সহিংসতা দমন। এ কথা এরা কখনও বলেননি। এ জন্যই তারা সুশীল বাটপাড়। কেন তারা সামান্য এই প্রতিবাদটুকুও করলেন না বরং বলতে লাগলেন- শেখ হাসিনা একতরফা নির্বাচন করতে চান। গণতন্ত্র হুমকির মুখে ইত্যাদি। তাদের ভ-ামিটা দেখুন, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন প্রচেষ্টা হচ্ছে একরতফা, একদলীয় নির্বাচন। প্রতিদিন মানুষ হত্যা, গাড়ি পোড়ানো যেন গণতন্ত্রের অংশ বা জামায়াত- বিএনপি নেত্রী খালেদার ভাষায়, ‘শান্তিপূর্ণ আন্দোলন’। ৪. নির্বাচন কেমন হয়েছিল দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচন কেমন হয়েছিল–এ প্রশ্নের সরল উত্তর পাওয়া যাবে না। নির্বাচনের আগেই পরিবার, পাড়া, সমাজ, দেশ দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। যদিও বলা হচ্ছিল নির্বাচনই দ্বন্দ্বের মূল কারণ। কিন্তু সেটা যে নয়, তা অচিরেই স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। নিছক নির্বাচন নিয়ে দ্বন্দ্ব হলে সে দ্বন্দ্ব অনেক আগে মিটে যেত। দ্বন্দ্ব ১৯৭৫ সাল থেকেই ছিল। পোশাকের আড়ালে যা লুকিয়ে রাখার চেষ্টা হচ্ছিল। যুদ্ধাপরাধ বিচার ও দ- কার্যকর করার পর দ্বন্দ্বটার আর কোন রাখঢাক নেই। এই দ্বন্দ্ব আদর্শগত। দুই আদর্শের লক্ষ্য ভিন্ন এবং সমান্তরাল, রেললাইনের মতো। জংশনে লাইন মিলতে পারে তখনই যখন লক্ষ্য হবে এক, পথ তখন ভিন্ন হলেও এ ধরনের দ্বন্দ্ব থাকবে না। এক পক্ষে নেতৃত্ব দিচ্ছে বিএনপি-জামায়াত। পুরনো মুসলিম লীগ, পিডিপি প্রভৃতি যারা করতেন তাদের উত্তরসূরিরা, ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত যারা সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন, আমলা, এই সময় বড় বড় হয়ে ওঠা দুটিতে বড় প্রজন্মের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ, এনজিও-মিডিয়াদের একটি বড় অংশ, এতিম বামপন্থীরা, বিভিন্ন বর্ণের রাজনীতিবিদরা বিএনপির সমর্থক। ১৯৭৫-৯৫ এই সময়ের মধ্যে বিএনপির অর্থের ভিত্তিটা শক্তিশালী হয়েছে। এরা প্রচ- আওয়ামীবিরোধী। এদের একটি বড় অংশ কথাবার্তায় খুব মার্জিত, বাংলাদেশের জন্য তারা উৎসর্গকৃতÑএ রকম একটা পোশাক পরেছিল, এখনও পরে এবং সাধারণকে বিভ্রান্ত করে না, এ কথা স্বীকার করা যাবে না। তারা বলবেন, জিয়া ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা ‘স্বাধীনতার ঘোষক’। কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধা আল বদর আবদুল আলীম বা আবদুল মান্নানকে ১৯৭১ সালের পর পরই মন্ত্রী করেন কিভাবে বা শাহ আজিজের মতো রাজাকারকে প্রধানমন্ত্রী? রাজাকার সবুর খান বা যাদু মিয়াকে তিনি কবর দেন জাতীয় সংসদে। সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়, কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে ২৪ ঘণ্টা পর পারলৌকিক রীতি প্রায় পালন না করতে দিয়ে টুঙ্গিপাড়ার মতো অজপাড়াগাঁয়ে পাঠিয়ে দেন। ধরা যাক। এসব কবর এখান থেকে সরাতে হবে। এ প্রস্তাব করলাম। কিন্তু উল্লিখিত সুশীলরা কি তা সমর্থন করে বিবৃতি দেবেন? দেবেন না। পার্থক্যটা এখানেই হয়ে যায়। নির্বাচনে যাতে ভোট না পড়ে এ জন্য জামায়াত-বিএনপি হত্যা থেকে নির্যাতন যা করার করেছে। সুশীলরা বিদেশীদের দরজায় অনবরত কড়া নেড়েছেন। মিডিয়া তার প্রচেষ্টা চালিয়েছে। যদি ভোটার সংখ্যা ১০ ভাগ হতো তা হলে তারা প্রমাণ করতে পারত যে সত্যিই এটি ‘প্রহসনের’ নির্বাচন। (চলবে)
×