ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কারখানা ঘেরাও করে শিবির ক্যাডার পাকড়াও ;###;ছাত্রদলের ফ্যাক্টরিতে বিস্ফোরণে ছাত্রদল নেতা বাপ্পির কব্জির একাংশ উড়ে গেছে, আহত ৩

মালিকানায় শিবির ও ছাত্রদল ॥ দুই বোমা ফ্যাক্টরি

প্রকাশিত: ০৫:১৭, ২২ জানুয়ারি ২০১৫

মালিকানায় শিবির ও ছাত্রদল ॥ দুই বোমা ফ্যাক্টরি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সারাদেশে যৌথবাহিনীর চলমান অভিযানে রাজধানীর বনানী ও লালবাগ থানা এলাকার দুটি বাড়িতে বোমা তৈরির কারখানার সন্ধান মিলেছে। বনানীর কারখানাটি জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ছাত্র শিবিরের। আর লালবাগেরটি বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের। বনানীর কারখানা থেকে উদ্ধার হয়েছে ১৩০টি শক্তিশালী তাজা বোমা, কয়েক শ’ বোমা তৈরির বিস্ফোরক, গানপাউডারসহ নানা সরঞ্জাম এবং লালবাগের কারখানাটি থেকে উদ্ধার হয়েছে কয়েকটি তাজা বোমাসহ বোমা তৈরির প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। বনানীর বোমা তৈরির কারখানা থেকে গ্রেফতার হয়েছে বনানী থানা ছাত্রশিবিরের সভাপতিসহ দলটির ৫ নেতাকর্মী। গ্রেফতারকৃতরা শিবিরের প্রশিক্ষিত পেশাদার বোমা প্রস্তুতকারক। তারা বোমা তৈরির পাশাপাশি মজুদ, সরবরাহ ও বোমা হামলায় পারদর্শী। তৈরিকৃত বোমাগুলো বিএনপির ডাকা দেশব্যাপী টানা অবরোধে ঢাকায় নাশকতা চালানোর জন্য তৈরি করা হয়েছিল। বনানীর কারখানাটি থেকে উদ্ধার হয়েছে বোমাবাজদের চাঁদা প্রদানকারী জামায়াত-শিবিরের কয়েক শ’ নেতা ও অর্থদাতার তালিকা। তালিকাভুক্তরা ২ হাজার থেকে ২৫-৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত মাসিক হারে চাঁদা দিয়ে থাকে। আর লালবাগে ছাত্রদলের বোমার তৈরির কারখানায় বোমা তৈরিকালে বিস্ফোরণে আহত হয়েছে এক শিশুসহ চারজন। ঢাকা মহানগর ছাত্রদলের নিউমার্কেট থানার সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ বাপ্পীর ডান হাত উড়ে গেছে। আহতদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। বাড়ির মালিক আবুল কাশেমকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। মঙ্গলবার রাত চারটার দিকে যৌথবাহিনী গোপন সংবাদের ভিত্তিতে রাজধানীর বনানী মডেল থানাধীন মহাখালী টিবি গেট এলাকার চ ব্লকের ১৩৩/১ নম্বর আমিনুল ইসলাম ভিলা নামের পাঁচতলা বাড়িতে অভিযান চালায়। অভিযানে বাড়িটির লিফটের দ্বিতীয় তলায় (তৃতীয় তলা) অবস্থিত ছাত্র শিবিরের একটি মেস থেকে উদ্ধার হয় ১৩০টি শক্তিশালী তাজা বোমা, পেট্রোলবোমা তৈরির জন্য মজুদ রাখা দুই লিটার পেট্রোল, ১০ কেজি পাথরের কুচি, এক কেজি গানপাউডার, ১২টি নতুন স্কচটেপ, ৩ কেজি প্যারেক, ৩ বান্ডেল তুলা, ৪৮টি বোমা তৈরির কৌটা, জর্দা, ১২টি ম্যাগাজিন, জিহাদী বই, ২৭টি খাকি খাম ও চাঁদা প্রদানকারী জামায়াত-শিবির নেতাকর্মী এবং অর্থদাতাদের নাম সংবলিত ছোট-বড় চারটি রেজিস্টার। পুলিশ জানায়, রেজিস্টারে কে কত টাকা মাসিক বা সাপ্তাহিক বা দৈনিক চাঁদা দেন তাদের নামসহ প্রদান করার চাঁদার পরিমাণ লেখা রয়েছে। যার সংখ্যা অন্তত কয়েক শ’। এর মধ্যে জামায়াতের কেন্দ্রীয় ও ঢাকা মহানগর নেতা ছাড়াও বিভিন্ন ইউনিটের নেতা এবং জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে জড়িত অনেক ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দও রয়েছেন। মেস থেকে গ্রেফতার করা হয় ছাত্র শিবিরের বনানী থানা শাখার সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান (২৩)। তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষ সম্মান শ্রেণীর শিক্ষার্থী। পিতা হারুনুর রশীদ। বাড়ি গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ থানা এলাকায়। শিবির কর্মী জয়নাল আবেদিন (২০) বেসরকারী প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এলএলবির তৃতীয় সেমিস্টারের ছাত্র। আরিফুজ্জামান আরিফ (১৮) রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানা এলাকায় অবস্থিত ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের আর্কিটেকচার বিভাগের দ্বিতীয় সেমিস্টারের ছাত্র। আতিয়ার রহমান (২২) মহাখালী সরকারী তিতুমীর কলেজের ইংরেজী বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র। তার বাড়ি গাইবান্ধায়। আর খালিদ সাইফুল্লাহ (২০) সদ্য এইচএসসি পাস করে তিতুমীর কলেজে ভর্তির অপেক্ষায় ছিলেন। তার বাড়ি ঝিনাইদহ জেলায়। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, মাসিক ১৫ হাজার টাকায় গত বছরের ডিসেম্বরে ভাড়া নেয় গ্রেফতারকৃতরা। জানুয়ারি থেকে তারা বাসায় বসবাস শুরু করে। ভাড়া নিয়েই তারা মেসটিতে বোমা তৈরির কারখানা স্থাপন করে। মহাখালীর আমতলী, টিবি গেট, বনানী মোড়, মহাখালী ওভার ব্রিজের নিচে প্রায়ই জামায়াত-শিবির ও নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাহ্্রীর ঝটিকা মিছিল করে। মিছিলকারীরা প্রায়ই যানবাহনে বোমা হামলা ও পেট্রোবোমা মেরে আগুন ধরিয়ে দিত। পুরো প্রক্রিয়াটি বনানীর এই শিবিরের বোমা তৈরির কারখানা থেকে নিয়ন্ত্রিত হতো। চলমান টানা অবরোধে ঢাকায় নাশকতা চালাতে বোমাগুলো তৈরি করে মজুদ করা হয়েছিল। এ ব্যাপারে বনানী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ভূঁইয়া মাহবুব হাসান জনকণ্ঠকে জানান, গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে। গ্রেফতারকৃতদের অর্থ ও বিস্ফোরক সরবরাহকারীদের তালিকা অনুযায়ী গ্রেফতারে সাঁড়াশি অভিযান চালানো হচ্ছে। আর বাড়ি ভাড়া আইন অমান্য করে ভাড়া দেয়ায় বাড়ি মালিকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এদিকে বুধবার দুপুর আড়াইটার দিকে রাজধানীর লালবাগ থানাধীন ঢাকেশ্বরী এলাকার ৩১/২ নম্বর পাঁচতলা বাড়িতে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণের পরেই চিৎকারে গোটা বাড়িতে শোরগোল পড়ে যায়। বাড়িসহ আশপাশের এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। বাড়ির মানুষ আতঙ্কে চিৎকার করতে থাকেন। বাড়ির বাসিন্দারা প্রাণভয়ে দৌড়ে নিচে নামতে গেলে হুড়োহুড়িতে শিশুসহ অন্তত ১০ জন আহত হয়। এ সময় আশপাশের মানুষ দ্রুত ওই বাড়িতে যায়। খবর পেয়ে পুলিশ সেখানে হাজির হয়। পরে স্থানীয়রা ও পুলিশ মিলে বাড়িটির দ্বিতীয় তলা থেকে আহত অবস্থায় হ্যাপি (১৪), রিপন (৬), বাপ্পী (২০) ও রিপনের মা ঝুমুর বেগমকে (২২) উদ্ধার করে। আহতদের দ্রুত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এদের মধ্যে রিপনের মা ঝুমুর বেগম সামান্য আহত হন। অন্য তিনজনের মধ্যে বাপ্পীর ডানহাতের কব্জির কিছু অংশ উড়ে গেছে। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে বোমার বিস্ফোরণের আলামত উদ্ধার করেছে। জব্দকৃত আলামতের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। বাড়িটির ওই তলায় বোমা তৈরি করে মজুদ করে রাখা ছিল। বোমা বিস্ফোরণের ফলে তৈরিকৃত বোমাগুলোও বিস্ফোরিত হয়। ফলে বিস্ফোরণ ভয়াবহ আকার ধারণ করে। ডিএমপির লালবাগ বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশানার মফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, বাড়িতে বসে বোমা তৈরির সময় বিস্ফোরণ ঘটে। এতে করে কয়েকজন আহত হয়। ঘটনাটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আহতদের কাছ থেকে পাওয়া প্রাথমিক তথ্যের বরাত দিয়ে পুলিশ জানায়, মাত্র দুই মাস আগে বাড়িটি ঢাকা মহানগর ছাত্রদলের নিউমার্কেট থানা শাখার সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ বাপ্পী পরিবারসহ বসবাসের কথা বলে ভাড়া নেন। ভাড়া নেয়ার পর থেকেই ফ্ল্যাটটিতে বোমা তৈরির কারখানা স্থাপন করা হয়। দীর্ঘদিন ধরেই বোমা তৈরি করে ওই ফ্ল্যাটে মজুদ করা হচ্ছিল। বুধবারও বোমা তৈরি করছিল আহত ছাত্রদল নেতা বাপ্পী। বোমার তৈরির সময় একটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণের ফলে সেখানে থাকা তৈরিকৃত সব বোমা বিস্ফোরিত হয়ে যায়। আর তাতেই ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনাটি ঘটে। ডিএমপির লালবাগ বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার এসএম মুরাদ আলী জনকণ্ঠকে জানান, আহত বাপ্পী ঢাকা মহানগর ছাত্রদলের নিউমার্কেট থানা শাখার সাধারণ সম্পাদক। তার পিতার নাম আব্দুল মান্নান। বাড়ি নোয়াখালী জেলায়। তবে বাপ্পী জন্মসূত্রে রাজধানী ঢাকার কাঁটাবনে বড় হয়েছেন। ছাত্র রাজনীতির পাশাপাশি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। এ ব্যাপারে লালবাগ থানার দায়িত্বরত কর্মকর্তা আব্দুল হান্নান জনকণ্ঠকে জানান, বিস্ফোরণের ঘটনায় মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বাড়ির মালিক আবুল কাশেমকে থানায় রাখা হয়েছে। তবে তাকে গ্রেফতার বা আটক দেখানো হয়নি। মামলা দায়েরের পর এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। প্রসঙ্গত, গত ৫ জানুয়ারি বড় ধরনের নাশকতার আশঙ্কায় সমাবেশ করার অনুমতি না পেয়ে পরদিন থেকেই দেশব্যাপী লাগাতার অবরোধের ডাক দেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। অবরোধে সারাদেশে ভাড়াটে বোমাবাজদের দিয়ে চোরাগোপ্তা হামলা চালানো হচ্ছে। ইতোমধ্যে ৩০ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত ১৭ জানুয়ারি রাজধানীতে মৎস্য ভবনে পুলিশভ্যানে বোমা হামলা করে ১৪ পুলিশকে আহত করে অবরোধকারীরা। এদের মধ্যে কনস্টেবল শামীমকে বিদেশ পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সমাজের সব পেশাজীবী শ্রেণী মানুষই নাশকতার শিকার হয়েছেন। শত শত আহত ও দগ্ধদের অনেকেই মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে যাচ্ছেন। ভাংচুরসহ অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে হাজারখানেক যানবাহনে। নাশকতাকারীদের গ্রেফতারে সারাদেশে যৌথবাহিনীর অভিযান চলছে। চলমান অভিযানে রবিবার রাতে পুলিশ ভ্যানে বোমা হামলাকারীদের অন্যতম নড়াইল জেলার ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও জামায়াত নেতা প্রশিক্ষিত বোমাবাজ, বোমা তৈরি, মজুদ ও সরবরাহকারী ডজনখানেক মামলার আসামি ইমরুল কায়েস পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। আর সোমবার রাতে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে পুলিশভ্যানে বোমা হামলাকারী খিলগাঁও থানা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নুরুজ্জামান জনির মৃত্যু হয়। দুটি ঘটনাস্থল থেকেই বোমা, পিস্তল, বুলেটসহ পেট্রোলবোমা উদ্ধার হয়।
×