ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

নওগাঁর গঞ্জিকা- মাটি খুঁড়ে গুপ্তধন পাওয়া যায়নি

প্রকাশিত: ০৪:৫৪, ২২ জানুয়ারি ২০১৫

নওগাঁর গঞ্জিকা- মাটি খুঁড়ে গুপ্তধন পাওয়া যায়নি

বিশ্বজিৎ মনি, পোরশা থেকে ফিরে ॥ ‘‘দিন আষ্টেক আগে হামি একটা জিনিস পাইছিনু বাবু, কি নাম জানি না। হামার মরদে ওটা ৯ হাজার টাকায় বেচেছে। মামুন নামে ব্যাপাফর ওটা কিনে নিছে। সে নাকি জিনিসগুলা বিদেশে পাচার করে। দেখতে তসবীর লাকান। তার পর থেকে খুঁড়েই যাচ্ছি। পরে আর কিছু পাইনি বাবু।” টাকা দিয়ে কি করেছেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, টাকা তাকে তার স্বামী দেখায়নি। সে নিজেই খরচ করেছে। কথাগুলো বলছিলেন, নওগাঁর পোরশা উপজেলার নিতপুর ইউনিয়নের কুলাডাঙ্গা গ্রামের আদিবাসী গৃহবধূ মংলী পাহান। মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টায় ঘন কুয়াশা আর কনকনে শীতের মাঝেও অন্যদের সঙ্গে তিনি ও তার বৃদ্ধ মাকে নিয়ে মাটির নিচের মূল্যবান বস্তু পাবার আশায় উপজেলার পশ্চিম রঘুনাথপুর গ্রামের পুনর্ভবা নদীর তীরবর্তী জনৈক সেলিম শাহ্ ও ইসমাইল শাহ্র টেকঠা নামক ভিটায় মাটি খনন করতে যান। সেখানে নদীর পূর্বপার প্রায় অর্ধকিলোমিটারের মধ্যে যে কোন স্থান খনন করলেই নাকি মিলছে নানান ধরনের মূল্যবান সামগ্রী (!)। এমন গুজব ছড়িয়ে পড়লে প্রায় বছরখানেক আগে থেকে প্রতিদিন লোকজন সেখানে খেয়ে না খেয়ে পরিবারের সকল সদস্যকে নিয়েও মাটি খনন করছে। মাটির নিচে গুপ্তধন মিলছে এমন বিষয়টি সোম ও মঙ্গলবার কয়েকটি পত্রিকায় প্রকাশ হলে মানুষের যেন কৌতূহল বেড়ে যায়। মঙ্গলবার নওগাঁ জেলা সদর থেকে ৮০ কিঃমিঃ পশ্চিমে পোরশা উপজেলার ভারতীয় সীমান্তঘেঁষা পুনর্ভবা নদী তীরবর্তী পশ্চিম রঘুনাথপুর গ্রামের সেই টেকঠা ভিটায় সরজমিনে গিয়ে চোখে পড়ে মানুষের মাটি খোঁড়াখুঁড়ির হিড়িক। এদিন অন্তত ২০/৩০ জনকে মাটি খনন করে মূল্যবান বস্তু খোঁজাখুঁজি করতে দেখা যায়। তবে এদিন বিকেল ৪টা পর্যন্ত সেখানে অপেক্ষা করেও কাউকে কিছইু পেতে দেখা যায়নি। সেখানে স্থানীয় বিজিবির নায়েক সুবেদার সালেহ্ আহমেদকেও তার টহল দল নিয়ে বিষয়টি পরখ করতে দেখা যায়। তিনি তখন সংলগ্ন সীমান্তে বিএসএফের সঙ্গে একটি সৌজন্য পতাকা বৈঠক সেরে ওই পথেই ক্যাম্পে ফিরছিলেন। সালেহ আহমেদও মাটি খুঁড়ে লোকজন মূল্যবান সম্পদ পাচ্ছে, এমন খবর শুনেই তা দেখতে গিয়েছিলেন। স্থানীয় প্রশাসন থেকে মৌখিকভাবে ওই মাঠে খনন বন্ধ করার কথা বলা হলেও কে শোনে কার কথা। নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর আর যুবকদের যেন বিরাম নেই। খুঁড়ছে আর খুঁড়ছে। প্রতিদিন সকাল হলেই পার্শ্ববর্তী গ্রামের লোকজন যে যার মতো কোদাল, খুন্তি, শাবল, দা দিয়ে মাটি খোঁড়ার ও মাটির দলা ভেঙ্গে মূল্যবান বস্তু অন্বেষণে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সকল কাজকর্ম ছেড়ে একশ্রেণীর মানুষ মাটির নিচে পুরনো পয়সা, তাবিজ, তসবি, পাথর, রূপার কলম, ছোট বল আকারের বস্তু ইত্যাদি পাওয়ার আশায় খনন করেই চলেছে দিনভর। খননকারীরা জানান, এগুলোর একেকটির রং আবার একেক রকম। কোনটা লাল, কালো, সাদা, কমলা, সবুজ আবার কতক গোলাপি রঙের। কোন ছোট কিংবা বড় পাথর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিক্রি করে দেয়া হয়। ক্রেতারা সেখানে উপস্থিত থাকেন সর্বদাই। খননকারীরা বলছেন, সম্পদের গুণগত মান অনুযায়ী এখানে বিশ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৬০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে এসব বস্তু। কিন্তু সেই বস্তুগুলো কিসের তৈরি, এমন কথা কেউ বলতে পারেনি। সবাই বলে শুধু ‘মূল্যবান বস্তু’। এদিকে স্থানীয় ইটভাঁটি ম্যানেজার শাহিন, আতিবুল এবং স্থানীয় সাংবাদিকরা বিভিন্ন সময় মাটির নিচ থেকে পাওয়া তথাকথিত মূল্যবান বস্তুর ছবি ধারণ করে রেখেছেন। তাতে স্বর্ণের তৈরি তো নয়ই, মূল্যবান কোন বস্তু বলেও মনে হয়নি স্থানীয় সচেতন মহলের। ওই জমির মালিক পোরশার জোতদার সেলিম শাহ্ জানান, জমিটি দীর্ঘদিন আগে তিনি কিনে নিয়েছেন। ওই জমিতে তিনি আম বাগান করেছেন। হঠাৎ এলাকার গরিবশ্রেণীর লোকজন জমিতে খুঁড়ে খুঁড়ে নাকি পুরনো মূল্যবান বস্তু পাচ্ছে। তাদের নিষেধ করলেও শোনে না। তবে বাগানের গাছ যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে ব্যাপারে তাদের সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। স্থানীয় আমির উদ্দিন বাবু জানান, ওই গ্রামটিতে প্রায় ৫০ বছর আগে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন বসবাস করত বলে তিনি পূর্বপুরুষদের কাছে শুনেছেন। সেখানে একটি বড় কালীমন্দির ছিল। মন্দিরে নিয়মিত পূজাঅর্চনা করা হতো। ওই মন্দিরকে ঘিরে সেখানে হাট-বাজার বসত। দেশ বিভাগের সময় হিন্দুরা ভারতে চলে যায়। তারা হয়ত তাদের মূল্যবান অনেক জিনিসপত্র নিয়ে যেতে পারেনি। পরে তাদের ঘর-বাড়ি এবং মন্দিরগুলো ভেঙ্গে মূল্যবান জিনিসগুলো মাটির নিচে চাপা পড়ে যায়। যে নদীর পার্শ্বস্থ এলাকায় পাথর উঠছে ঠিক সেই জায়গায় হিন্দুদের কালীর মন্দির ছিল। ছিল শ্মশান। যার প্রমাণস্বরূপ কালীদহ বলে একটি কূপ আজও বিদ্যমান নদীতে। সেখানে তারা পুজো শেষে ‘কাীল-মায়ের’ মূর্তি বিসর্জন দিতেন। এলাকাবাসী আতিবুল হক ও রইচ উদ্দিন জানান, দীর্ঘদিন পূর্বে ওই এলাকায় হিন্দু পাল সম্প্রদায়ের লোকজন বাস করতেন। সংলগ্ন নদীর ধারেই ছিল তাদের শ্মশানঘাট। কোন মৃত ব্যক্তিকে সৎকারের সময় তার ব্যবহারী সকল সামগ্রী, জামা-কাপড়, তোষক-বালিশ সবই শ্মশানে ফেলে দেয়া হতো। যুগের পরিবর্তনে তা মাটিচাপা পড়ে যায়। এখন খননের ফলে সেগুলোই উঠে আসছে বলে ধারণা তাদের। এগুলো কোন গুপ্তধন নয় বলেও দাবি করেন তিনি। পার্শ্ববর্তী বিষ্ণুপুর ও রঘুনাথপুর গ্রাম থেকে আসা মিন্টু, ভাদু, শামীম, জুল্লু, ইটভাঁটি শ্রমিক হারুন, মংলী পাহান, মিলন, ইটভাঁটির ম্যানেজার শাহিন কামাল ও মনিরুল ইসলাম জানান, গত ৭ দিন থেকে তিনি মাটি খুঁড়ছেন। সেখানে জালিবল, তসবি, পটল আকৃতির বস্তু, বোতাম, পুরনো পয়সা ছাড়া আর কিছুই পাননি কেউ। নিতপুর থেকে আসা রুস্তম আলী চকচকে কাঁচের টুকরোর মতো একটা বস্তু পেয়েছেন। এছাড়া জহুরুল ইসলাম দুটি বোতাম ও একটি মার্বেল পেয়েছেন।
×