ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বেকায়দায় খালেদা ॥ অফিস ছাড়ছেন না নিরাপত্তা তুলে নেয়ার পরেও

প্রকাশিত: ০৮:৩৭, ২১ জানুয়ারি ২০১৫

বেকায়দায় খালেদা ॥ অফিস ছাড়ছেন না নিরাপত্তা তুলে নেয়ার পরেও

শরীফুল ইসলাম ॥ বিএনপি চেয়ারপার্সনের গুলশান কার্যালয় থেকে পুলিশের বিশেষ নিরাপত্তা বেষ্টনী তুলে নেয়ার তিনদিন পরও গ্রেফতার আতঙ্কে থাকায় আপাতত খালেদা জিয়া বাসায় যাচ্ছেন না। এদিকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে বলে এতদিন অজুহাত দিলেও গুলশান কার্যালয়ের সামনে থেকে পুলিশের বিশেষ নিরাপত্তা বেষ্টনী তুলে নেয়ার পরও বাসায় না যাওয়ায় এখন বেকায়দায় পড়েছেন খালেদা জিয়া। উল্লেখ্য, ৫ জানুয়ারি রাজধানীতে বড় ধরনের সমাবেশ করার টার্গেট নিয়ে ৩ জানুয়ারি রাতে বাসা ছেড়ে গুলশান কার্যালয়ে অবস্থান নেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। ওখান থেকে কোথাও যেতে মানা নেই বলে সরকারের তরফ থেকে জানানো হলেও বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, জলকামানসহ পুলিশের বিশেষ নিরাপত্তা বেষ্টনীর মাধ্যমে খালেদা জিয়াকে গুলশান কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে ১৮ জানুয়ারি রাতে খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ের সামনে থেকে জলকামান ও পুলিশ ভ্যানসহ বিশেষ নিরাপত্তা বেষ্টনী তুলে নেয়া হয়। ১৯ জানুয়ারি ছিল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ৭৯তম জন্মবার্ষিকী। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া বরাবরই এ দিনে জিয়ার মাজারে গিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। কিন্তু ওই দিন বাসা থেকে বের হওয়ার ব্যাপারে কোন নিষেধাজ্ঞা কিংবা বাসার সামনে পুলিশের কোন নিরাপত্তা বেষ্টনী না থাকলেও তিনি জিয়াউর রহমানের মাজারে যাননি। দলের তৃণমূল পর্যায়ের কিছু নেতাকর্মী জিয়ার মাজারে গিয়ে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করলেও খালেদা জিয়া না যাওয়ায় দলের অন্য সিনিয়র নেতারাও সেখানে যাননি। জিয়াউর রহমানের জন্মদিনে তাঁর মাজারে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে না গেলেও ১৯ জানুয়ারি সন্ধ্যায় বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া গুলশান কার্যালয়ে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যদের নিয়ে দীর্ঘ বৈঠক করেছেন। বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলন করে তিনি অবরোধ কর্মসূচী চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। এ সময় তাকে প্রশ্ন করা হয়- এখনতো আপনার অফিসের সামনে পুলিশের বিশেষ বেষ্টনী নেই তাহলে বাসায় যাবেন কি-না। জবাবে খালেদা জিয়া বলেন, অফিসে আমার কাজ আছে। এখানেই আমি কাজ করব। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যদি যখন যেখানে খুশি যেতে পারি তখন বুঝব আমাকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়নি। তবে সংবাদ সম্মেলনে দেয়া এ বক্তব্যের পর এখনও খালেদা জিয়া বাসায় যাওয়ার চেষ্টা করেননি। জলকামানসহ পুলিশের বিশেষ বেষ্টনী তুলে নেয়ার পরও খালেদা জিয়া এখন কেন বাসায় যাচ্ছেন না জানতে চাওয়া হলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, গুলশান কার্যালয় থেকে বের হলেই সরকার খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করবে এমন তথ্য তাদের কাছে রয়েছে। আর এ কারণেই তিনি আপাতত গুলশান কার্যালয় ছেড়ে বাসায় যাচ্ছেন না। একই কারণে জিয়ার মাজারে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে যাওয়ার বিষয়টিকেও তিনি নিরাপদ মনে করেননি। তবে গুলশান কার্যালয়ে থেকেই তিনি আন্দোলন কর্মসূচীতে নেতৃত্ব দেয়ার পাশাপাশি সরকার কী করতে চাচ্ছে সে ব্যাপারে গভীর পর্যবেক্ষণ করছেন। সেই সঙ্গে দলের নেতাকর্মীসহ দেশী-বিদেশী বিভিন্ন মহলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। বিএনপির আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, খালেদা জিয়া এখন দলের গুলশান কার্যালয়কেই বেশি নিরাপদ মনে করছেন। কারণ, এখানে ৩ জানুয়ারি থেকে তার সঙ্গে সার্বক্ষণিকভাবে রয়েছেন দলের নেতাকর্মী, ব্যক্তিগত স্টাফ ও নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত সিএসএফসহ (চেয়ারপার্সন স্পেশাল ফোর্স) অন্তত ৫০ জন। আর এখানে থাকা-খাওয়ারও তেমন কোন সমস্যা নেই। ওয়ান ইলেভেনের পর থেকে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার দুই ছেলে ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা বিদেশে অবস্থান করায় বাসায়ও খালেদা জিয়া একাই থাকেন। কাজের মেয়ে কুলসুমও এখন খালেদা জিয়ার সঙ্গেই গুলশান কার্যালয়ে থাকেন। আর দলীয় কার্যালয়কে বেশি নিরাপদ ভাবার আরেকটি কারণ হচ্ছে- সরকারের নির্দেশে পুলিশ ওখানে গিয়ে তাকে গ্রেফতার করতে চাইলেও এত সহজে তা পারবে না। আর যদি দলীয় কার্যালয় থেকে গ্রেফতার করতেও চায় তাহলে বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ হবে। আর বাসায় গেলে যদি তাকে গৃহবন্দী করে সরকার তার কারণ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দিতে পারে। সেক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদের বিষয়টি তেমন জোরালো হবে না। আর খালেদা জিয়ার বাসায় দলের নেতাকর্মীদের থাকা-খাওয়ার মতো তেমন সুবিধা নেই। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অবরোধ কর্মসূচী শুরুর পর সারাদেশে জানমালের যে ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে সরকারের তরফ থেকে তার দায়ভার ২০ দলীয় জোটের নেতা হিসেবে খালেদা জিয়ার ওপরই বর্তানো হয়েছে। আর খালেদা জিয়া জোটের নেতা হওয়ায় তার কাঁধে বন্দুক রেখে অন্যকেউ নাশকতা করলে তার দায় চাপানোর যৌক্তিকতাও থেকে যায়। এছাড়া জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার শুনানিতে অংশ নিতে ৭ ও ১৫ জানুয়ারি আদালতে না যাওয়ার বিষয়টিকেও সরকার ভাল চোখে দেখেনি। আর এ কারণেই সরকারী দলের নেতারা খালেদা জিয়ার প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রয়োজনে তাকে গ্রেফতারের কথা বলছেন। এসব কিছুর আলোকেই মূলত খালেদা জিয়া গ্রেফতার আতঙ্কে ভুগছেন বলে কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে। এদিকে কূটনীতিক পাড়ায় রাজনৈতিক কার্যালয় না রাখতে ইতোমধ্যেই বিভিন্ন মহল থেকে দাবি তোলা হয়েছে। গুলশান-বারিধারা এলাকা থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ও বিএনএফের চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদও সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলন করে কূটনীতিক এলাকা থেকে রাজনৈতিক কার্যালয় তুলে নেয়ার দাবি করেছেন। এ পরিস্থিতিতে রবিবার রাতে জলকামান ও পুলিশ ভ্যানের ব্যারিকেড তুলে নেয়া হয়। এতে খালেদা জিয়াসহ দলের নেতাদের মধ্যে আরেকটি চিন্তার বিষয় সৃষ্টি হয়। আর তা হচ্ছে খালেদা জিয়া গুলশান কার্যালয় ত্যাগ করলে নয়াপল্টনের দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের মতো গুলশান কার্যালয়েও পুলিশ তালা লাগিয়ে দেয় কি-না। তাই নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায়ের বিষয়টিকে জোরালো করতে আপাতত তিনি গুলশান কার্যালয়েই থাকার কৌশল নিয়েছেন। ৫ জানুয়ারি বিকেলে মহিলা দলের কিছু নেতাকর্মীকে নিয়ে খালেদা জিয়া গুলশান কার্যালয় থেকে বের হওয়ার জন্য গাড়িতে চড়ে বসেন। কিন্তু পুলিশ গেট খুলে না দেয়ায় তিনি বের হতে পারেননি। একপর্যায়ে তার সঙ্গে থাকা মহিলা দলের নেতাকর্মীরা কালো পতাকা হাতে নিয়ে গেটে লাথি মেরে প্রতিবাদ জানাতে থাকলে পুলিশ তাদের ওপর পিপার স্প্রে মারে। এ সময় খালেদা জিয়া গাড়ির ভেতরে থাকলেও মহিলা দলের নেতাকর্মীরা পিপার স্প্রের কারণে অচেতন হয়ে যান। পরে সেখানে আগুন জ্বেলে পিপার স্প্রের ঝাঁজালো গন্ধ নিষ্ক্রিয় করা হয়। তখন খালেদা জিয়া গাড়ি থেকে নেমে ৬ জানুয়ারি থেকে অনির্দিষ্টকালের অবরোধ কর্মসূচী পালনের ঘোষণা দেন। কর্মসূচী ঘোষণার পর খালেদা জিয়া গুলশান কার্যালয়ের দ্বিতীয় তলায় তার কক্ষেই অবস্থান নেন। ওই দিন রাতেই খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা শওকত মাহমুদের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল গুলশান কার্যালয়ে গিয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত করেন। তবে সেখানে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে দফায় দফায় চিকিৎসকরা গিয়ে তাঁকে চিকিৎসা সেবা দেন। ৭ জানুয়ারি তাঁর উপদেষ্টা সাবিহ উদ্দিন আহমেদ গুলশান কার্যালয়ে গিয়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাত করেন । ১০ জানুয়ারি খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা এমএ হালিমের নেতৃত্বে সাবেক সচিব ১০ তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত করেন। ১১ জানুয়ারি দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া ও ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার তার সঙ্গে সাক্ষাত করেন। ১২ জানুয়ারি দলের সহ-সভাপতি মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ ও ১৩ জানুয়ারি উপদেষ্টা রিয়াজ রহমান সাক্ষাত করেন খালেদা জিয়ার সঙ্গে। ১৪ জানুয়ারি জাতীয়তাবাদী আইনজীবীরা এবং ১৬ জানুয়ারি ড্যাব নেতৃবৃন্দ ও জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম, ১৭ জানুয়ারি দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য এমকে আনোয়ার ও ১৮ জানুয়ারি জাতীয়তাবাদী আইনজীবী সমিতির যুক্তরাজ্য শাখার নেতারা খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাত করেন। আর ১৯ জানুয়ারি থেকে সাংবাদিকসহ খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ে নেতাকর্মীদের অবাধ যাতায়াত নিশ্চিত হয়। এদিকে খালেদা জিয়াকে গুলশান কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে বলে এতদিন বিভিন্ন মহল থেকে সরকারকে দোষারোপ করলেও এখন বইছে উল্টা স্রোত। এখন সেই মহলগুলো থেকেই বলা হচ্ছে, পুলিশী বেষ্টনী তুলে নেয়ার পরও কেন খালেদা জিয়া বাসায় কিংবা অন্য কোথাও যেতে চাচ্ছেন না। এ ব্যাপারে বিএনপির পক্ষ থেকে কোন ব্যাখ্যাও দেয়া হচ্ছে না। তাই গুলশান কার্যালয়ে থাকার বিষয়টি নিয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া এখন বেকায়দায় পড়েছেন।
×