ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ঢামেক বার্ন ইউনিটে দগ্ধ রোগী ও স্বজনদের কান্না হাহাকার আহাজারি চলছেই

সিএনজি চালক সিদ্দিকের সংসার এখন ছারখার

প্রকাশিত: ০৩:৪৮, ২১ জানুয়ারি ২০১৫

সিএনজি চালক সিদ্দিকের সংসার এখন ছারখার

নিখিল মানখিন ॥ অবরোধে নাশকতার আতঙ্কে কয়েকদিন সিএনজি অটোরিক্সা রাস্তায় নামাননি ময়মনসিংহ সদরের সিদ্দিকুর রহমান। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তিনি। সংসারে দেখা দেয় আর্থিক সঙ্কট। স্ত্রী-সন্তানদের দু’মুঠো ভাত যোগান দিতে অবরোধ উপেক্ষা করে তিনি ময়মনসিংহ সদর রাস্তায় নামান সিএনজি অটোরিক্সা। রাতে বাসায় ফেরার পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাঁর পকেটে ছিল বাজার তালিকা। অপেক্ষায় ছিলেন পরিবারের সদস্যরা। কিন্তু পেট্রোল বোমার আঘাতে পরিবারটি তছনছ হয়ে পড়ে। গত ৫ জানুয়ারি বিকেলে ময়মনসিংহ শহরের জেলা স্কুল মোড়ে দুর্বৃত্তদের ছোড়া পেট্রোলবোমায় দগ্ধ হন সিদ্দিকুর রহমান। বর্তমানে তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন আছেন। শুধু সিদ্দিকুর রহমান নন, অবরোধের নাশকতার শিকার হয়ে আরও অনেকে এই হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। আহতদের কেউ কেউ চলে গেছেন না ফেরার দেশে। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া গত ৫ জানুয়ারি সারাদেশে লাগাতার অবরোধের ডাক দেয়ার পর প্রতিদিনই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গাড়ি ভাংচুর, বোমা হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটছে। এতে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে। সোমবার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিট সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, অবরোধের আগুনে দগ্ধ রোগী ও তাদের স্বজনদের চিৎকার, হাহাকার ও আহাজারি থেমে থেমে চলছেই। কারও সান্ত¡নাতেই তা থামছে না। অবরোধের আগুনে দগ্ধ হয়ে নিরীহ এসব সাধারণ মানুষ মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। বর্তমানে ১৬ জন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে দুঃসহ যন্ত্রণায় ছটফট করছেন। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের ডাকা হরতাল-অবরোধের সহিংসতায় দগ্ধ হয়েছেন তারা। এদের মধ্যে চারজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। অবরোধের নাশকতার শিকার হয়ে ইতোমধ্যে ৩৪ জন বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা নিয়েছেন। সোমবারও বিভিন্ন ওয়ার্ডে ভর্তি দগ্ধ এসব রোগীর আহাজারিতে বার্ন ইউনিটের পরিবেশ ভারি হয়ে উঠেছে। চলমান রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার হয়ে এখানে ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে প্রাইভেটকার চালক আবুল কালাম হাওলাদার, ট্রাকের হেলপার যশোরের মুরাদ মোল্লা ও রংপুরের তছিরন বেগম পাড়ি জমিয়েছেন না ফেরার দেশে। ফলে অন্য রোগী ও স্বজনদের মধ্যেও এখন আতঙ্ক বিরাজ করছে। সোমবার ঢামেক বার্ন ইউনিট সরেজমিনে ঘুরে আরও দেখা গেছে, হাসপাতালের বিছানায় যন্ত্রণায় ছটফট করছেন সিদ্দিক আলী। গত ১৫ জানুয়ারি রাতে সিরাজগঞ্জের বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম পাশে কোনাবাড়ী এলাকায় পণ্যবাহী একটি ট্রাকে পেট্রোলবোমা ছোড়ে দুর্বৃত্তরা। এতে ওই ট্রাকচালক সিদ্দিক আলী (৪০) দগ্ধ হন। তাকে প্রথমে স্থানীয় একটি ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে পাঠানো হয়। আগুনে সিদ্দিকের শরীরের ১৫ শতাংশ পুড়ে গেছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। পেট্রোল বোমায় দগ্ধ সিএনজি অটোরিক্সা চালক সিদ্দিকুর রহমানের বিছানার পাশে বসে চোখের জল ফেলছেন স্ত্রী শারমিন আক্তার। সিদ্দিকুর রহমানের শরীরের ১৭ ভাগ পুড়লেও মুখম-ল ও কণ্ঠনালী পুড়ে যাওয়ায় তাঁর অবস্থাও গুরুতর। বার্ন ইউনিটের আইসিইউতে রাখা হয়েছে তাঁকে। তিন সন্তানের জনক সিদ্দিকের রোজগার দিয়েই চলত পুরো পরিবার। ছোট ভাই শাহাদাত হোসেনকে বানিয়েছেন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু আগুনে সব স্বপ্ন পুড়ে গেছে পরিবারটির। সোমবার বার্ন ইউনিটের দোতলায় আইসিইউতে অগ্নিদগ্ধ অটোরিক্সা চালক সিদ্দিকের স্ত্রী শরীফা আক্তার বলেন, ৭ থেকে ৮ মাস আগে শাশুড়ি, আমি ও আমার স্বামী ৩ জন মিলে উল্লাস সমবায় সমিতি থেকে ১ লাখ ৪৭ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে অবরোধের সময় জ্বলে যাওয়া অটোরিক্সাটি কিনেছিলাম। তিন সন্তান আমাদের। বড় মেয়ে সানজিদা আক্তার স্থানীয় স্কুলে ৪র্থ শ্রেণীতে পড়ে এবং দুই ছেলে সানজিদুল সামি ও সাজেদুল রামিম এখনও স্কুলে ভর্তি হয়নি। সিদ্দিক অটো চালিয়ে যা রোজগার করতেন সেটা দিয়ে চলছিল তাদের পরিবার। বয়সের ভারে নতজানু আবু তাহের স্ত্রী মাহেরা বেগমকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি পাবনার কাজির হাটে থাকেন। ৪ ছেলে ও ৩ মেয়ে রয়েছে এ দম্পতির। কয়েকদিন আগে স্ত্রীর পা ভেঙ্গে যায়। ভাঙ্গা পায়ের চিকিৎসা করাতে ছেলেরা মাকে ঢাকা নিয়ে আসেন। দেখাশোনা করার কেউ না থাকায় বাবা তাহের ও মা মাহেরা বেগমকে নিয়ে দুই ছেলে পাবনা থেকে অবরোধের মধ্যেই ঢাকায় রওনা দেন। ব্রাদার্স পরিবহনের বাসটি মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ ভাঙ্গা মসজিদের সামনে এলেই দুটি পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ করে দুর্বৃত্তরা। এ সময় দুই ছেলেসহ তিনি দগ্ধ হন। তার শরীরের ১৪ শতাংশ পুড়ে যায়। গত শনিবার রাতে বৃদ্ধ তাহেরের মতোই দুর্ভাগ্যের শিকার হন পুলিশের গাড়িচালক কনস্টেবল মোরশেদ আলম। শাহবাগ বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ও বারডেম হাসপাতালের সামনে দায়িত্বে থাকা ৩০ থেকে ৩৫ জন পুলিশ সদস্যদের নিয়ে রাজারবাগে যাচ্ছিলেন তিনি। এ সময় মৎস্য ভবনের কাছে এলে দুর্বৃত্তরা পেট্রোলবোমা ছুঁড়ে দেয়। এ সময় তিনি দগ্ধ হন। তার শরীরের ৮ ভাগ পুড়ে যায়। নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন। তার মাথার চুল ও বাঁ হাত আগুনে পুড়ে গেছে। মুখম-ল পুড়ে যাওয়ায় বাঁ চোখ খুলতেই পারছেন না তিনি। মোরশেদের স্ত্রী মাহমুদা নাজনীন আক্তার ২ ছেলে নাফিজ ও নাবিলকে নিয়ে ময়মনসিংহে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গেছেন। স্বামীর এই দুর্ভাগ্যের খবর পেয়েছেন তারা। কিন্তু হরতাল-অবরোধের কারণে ঢাকায় ফিরতে পারছেন না। রায়েরবাজারের বাসিন্দা নূরজাহান। গত শনিবার রাতে মোহাম্মদপুরে পেট্রোলবোমা ছুঁড়ে মারা ওই বাসের যাত্রী ছিলেন তিনিও। দশম শ্রেণীতে পড়া মেয়ে ঋতু ও দেড় বছরের ছেলে রিফাতকে নিয়ে ওই বাসে যাচ্ছিলেন নূরজাহান। ছেলেমেয়েরা ভাল থাকলেও মা নূরজাহানের সারা মুখ পুড়ে গেছে। মায়ের পাশে বসা কিশোরী ঋতুর চোখেমুখে আতঙ্ক। চিকিৎসাধীন দগ্ধ লেগুনাচালক সেলিমের স্ত্রী হাসি বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে জনকণ্ঠকে জানান, স্বামী ছাড়া তাদের আর কেউ নেই। দুই সন্তানকে নিয়েই সংসার তাদের। ছেলে হাসিব (৭) মদীনাবাগ কিন্ডারগার্টেন প্রথম শ্রেণীতে পড়ে আর সাড়ে ৩ বছরের মেয়ে শিখা। তার স্বামী সেলিমই তাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। অবরোধে নাশকতার শিকার হতে পারেন জেনেও সংসারের প্রয়োজনে লেগুনা নিয়ে তার বের হয়েছিলেন তিনি। আর দগ্ধ হয়ে এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের আবাসিক সার্জন চিকিৎসক পার্থ শংকর পাল বলেন, অবরোধ চলাকালীন অগ্নিদগ্ধ ৪ জনের অবস্থা গুরুতর। তাদের ভেতর দু’জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাদের আইসিইউতে রাখা হয়েছে। শ্বাসনালীজনিত পোড়ার কারণে তাদের অবস্থাও সঙ্কটাপন্ন। বার্ন ইউনিটের প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ সামন্ত লাল সেন এবং বিভাগীয় প্রধান প্লাস্টিক সার্জন অধ্যাপক ডাঃ আবুল কালাম জানান, অবরোধে নাশকতার শিকার হয়ে চিকিৎসাধীন রোগীদের শরীর ৬ থেকে ৩৭ ভাগ পর্যন্ত পুড়ে গেছে। পোড়া রোগীদের কষ্ট ও যন্ত্রণা সেই শুধু বুঝে যে আগুনে পোড়ার শিকার হয়। ইউনিটের জুনিয়র চিকিৎসকরা বলেন, পোড়া রোগীদের চিকিৎসাকালে তাদের যন্ত্রণা দেখে আমরাও কান্না ধরে রাখতে পারি না। চাহিদা অনুযায়ী বিছানা না থাকায় বারান্দা, করিডরে যত্রতত্র বিছানা পেতে পোড়া রোগীদের চিকিৎসা দিতে হচ্ছে।
×