ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

জোট হয়ত থাকবে কিন্তু ভোট থাকবে তো?

প্রকাশিত: ০৩:০৭, ২১ জানুয়ারি ২০১৫

জোট হয়ত থাকবে কিন্তু ভোট থাকবে তো?

সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো এখন সক্ষম তরুণদের হাতে সেই অস্ত্রটা তুলে দিয়েছে। এর সঙ্গে যদি নির্বাচন ব্যবস্থার সক্ষমতা যোগ হয় তাহলে আগামী নির্বাচনে মানুষকে ধর্ম দিয়ে, অর্থ দিয়ে, শক্তি প্রয়োগ করে ভোলানোটা খুব একটা সহজ কাজ হবে না। জামায়াতে ইসলামীর যুদ্ধাপরাধের কলঙ্ককে মানুষ ভুলে যাবে? বড় ধরনের কোন নোংরামি না করলে নির্বাচনে মানুষ জামায়াতী প্রার্থীকে এ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবেই। তারেক জিয়ার অর্থনৈতিক দুর্নীতি, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি এবং বঙ্গবন্ধুকে অসম্মান করার কারণ জানতে চাইবে ভোটাররা দেশের পরিস্থিতি কি? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতেই পরবর্তী প্রশ্নের অবতারণা হয়, এরপর কী হবে বলুন তো? টকশোয় আলোচকগণ যাঁরা উপস্থিত হন তাঁরা প্রতিদিনকার ঘটনাবলীই বিশ্লেষণ করেন। বিএনপির পক্ষে যাঁরা কথা বলেন তাঁরা শুরু করেন ২০০৪ সালে তৎকালীন শেরাটন হোটেলের সামনে গানপাউডার দিয়ে দোতলা বাসে আগুন দেয়ার ঘটনাবলী দিয়ে। এর উত্তরে আওয়ামী লীগের হয়ে যিনি কথা বলেন, তিনি বলেন, আমরা সে ঘটনার নিন্দা জানাই। কিন্তু আপনি বলুন তো, তারপর তো বিএনপি আরও দু’বছর ক্ষমতায় ছিল, তাহলে তারা সে সময় সে ঘটনার বিচার করেনি কেন? তখন বিএনপি পক্ষীয় ব্যক্তিটি আমতা আমতা করেন কিংবা প্রসঙ্গান্তরে যান। ওদিকে উপস্থাপক তখন অপেক্ষা করেন পরবর্তী প্রশ্নের জন্য। তাকে তো নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই অনুষ্ঠান শেষ করতে হবে, তাই না? এভাবে একেবারে শেষের দিকে যখন উপস্থাপক দু’পক্ষের কাছেই প্রশ্ন করেন, আচ্ছা এর শেষ কোথায় বলতে পারেন? তখন বিএনপি পক্ষীয়জন বলেন, যতদিন পর্যন্ত বিজয় অর্জিত না হবে ততদিন এ রকম চলতেই থাকবে, সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। আর আওয়ামী লীগ সমর্থক বলেন, তার মানে কি আপনারা এভাবে মানুষ পুড়িয়ে হত্যাকাণ্ড চালিয়েই যাবেন? এর মাঝেই শেষ হয়ে যায় অনুষ্ঠান। কোন কোন চ্যানেলে উপস্থাপক শেষ করেন এই বলে যে, আমরা আশা করি অতি দ্রুততম সময়ের মধ্যে দু’পক্ষের সমঝোতায় দেশে শান্তি ফিরে আসবে। সবাই ভাল থাকবেন, শুভ রাত্রি। এর পর একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে ঘুমানো খুব সহজ ব্যাপার নয়। কারণ, তার পরদিনই তাকে জীবনের তাগিদে কাজে বেরুতে হবে। তার সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে হবে। তার ভেতরে প্রশ্ন, পরদিন সন্ধ্যায় আবার এই টকশো দেখার সুযোগ তাদের ভাগ্যে জুটবে তো? নাকি দিনের কোন অংশে রাস্তায় তাকে পুড়ে কয়লা হতে হবে? এই যে অনিশ্চয়তা, এই যে ভয়ঙ্কর অবস্থা; একজন সাধারণ মানুষকে ক্রমশ করে তুলছে রাজনীতিবিমুখ এমনকি গণতন্ত্রবিমুখও। আর এই সুযোগটিই হয়ত চাইছেন তাঁরা, যাঁরা বড় দুই রাজনৈতিক দলের বাইরে ওঁৎ পেতে বসে আছেন। কখন শক্তিশালী অস্ত্রধারীরা এগিয়ে আসবে, কখন সুযোগ হবে তাদের হাত ধরে ক্ষমতার ভাগ পাওয়ার। মোটামুটি দেশের পরিস্থিতি এই মুহূর্তে এ রকমটাই। আওয়ামী লীগ বা সরকার বিগত এক বছর দেশকে একটি কাঠামোর ওপর দাঁড় করিয়ে এনেছিল। যে কাঠামোর মূল আসলে একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর প্রোথিত। এভাবে অনেক দিকই আলোচনায় আসতে পারে এ বিষয়ে আলোকপাত করতে হলে। কিন্তু সেটি সাধারণ মানুষের বোধেরও বিষয়, সাধারণ মানুষ বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারে বলেই এখন পর্যন্ত জনমত জরিপে আওয়ামী লীগ অনেকটা এগিয়ে বিএনপির তুলনায়। সম্প্রতি ঢাকা ট্রিবিউন যে জরিপটি চালিয়েছে তাকে কেউ খ-াতে পেরেছে বলে শোনা যায়নি। এমনকি আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে এ পর্যন্ত আন্তর্জাতিকভাবে দলটিকে যে কোন ছুঁতোয় সবচেয়ে বেশি সমালোচনাকারী দ্য ইকোনমিস্ট পর্যন্ত একথা স্বীকার করেছে যে, শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে বিগত এক বছরে একটি অবস্থানে আনতে পেরেছেন, যাকে পত্রিকাটি বলতে চাইছে এই সুফল সূচনা হিসেবে। একথা দেশের মানুষ বুঝতে বা উপলব্ধি করতে পারেনি, সে রকমটি ভাবা বোধকরি সঠিক হবে না। যদি বুঝতে না পারত তাহলে বিএনপি-জামায়াতের এই নিকৃষ্টতম কর্মকা-ে তারা সমর্থন জানাত এবং এতদিনে সরকার হিসেবে আওয়ামী লীগের হয়ত ক্ষমতায় থাকাটা সম্ভবপর হতো না। আর জনগণকে সম্পৃক্ত করতে পারছে না বলেই, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ফেস বুক পাতায় খুব স্পষ্টভাবেই জনগণকে জঘন্য ভাষায় গালি দিয়ে বলেছে, ক্ষমতায় গেলে এই জনগণকে দেখিয়ে দেবে এবং কদর্য ভাষায় জনগণের ওপর প্রতিশোধের ভয় দেখানো হয়েছে। সমস্যাটি এখানেই, কোন আন্দোলনই আন্দোলন নয়, যদি না তাতে জনসমর্থন থাকে। মানুষ পুড়ে মরতেও রাজি আছে, যদি মানুষ বুঝতে পারে যে, এই পুড়ে মরার মাধ্যমে আরও লক্ষ মানুষকে বাঁচিয়ে দেয়া যাবে। কিন্তু মানুষ যদি বুঝতে পারে যে, আজকে যাদেরকে পুড়িয়ে মেরে তাদের কয়লার ওপর দিয়ে যারা ক্ষমতায় যেতে চাইছে তারা তো আসলে দেশের জন্য নয়, জনগণের জন্য নয়, নিজেদের বাঁচার জন্য, নিজেদের কারাদ- থেকে বাঁচানোর জন্য, ক্ষমতায় ফিরে দেশকে গোরস্তান বানানোর জন্য এই খা-বদাহন শুরু করেছে; তাহলে কেন মানুষ নিজেকে এই দহনযজ্ঞে সম্পৃক্ত করবে, বলতে পারেন? মানুষের চাওয়া বা পাওয়ার গ-ি খুবই সীমাবদ্ধ এদেশে (কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া)। এই সীমাবদ্ধতার কারণেই সরকার যদি সামান্য কিছু করে তাহলে তাকে মানুষ সাধারণত অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করে না। হ্যাঁ, নির্বাচনে সব সময় বিকল্পকে বেছে নেয়ার একটা প্রবণতা এদেশে রয়েছে ঠিকই, সে হিসেবে বিগত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নিয়ে বেগম জিয়া তথা বিএনপির ক্ষমতায় আসার সুযোগ অবশ্যই ছিল। কিন্তু সে সুযোগ গ্রহণ না করাটা বিএনপি-জামায়াতের নিজস্ব সিদ্ধান্ত ছিল। ৫ জানুয়ারি পরবর্তী সরকার মানুষের ভেতরে যদি কোন ক্ষোভ থেকেও থাকে তা প্রশমিত করেছিল উপরে উল্লেখিত শান্তি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের বাস্তবতা দিয়ে। মানুষের সীমিত চাওয়া পূরণ হওয়ার ইঙ্গিত মানুষকে উদ্দীপিত করেছে এবং মানুষ সামনের দিনগুলো সম্পর্কে পরিকল্পনা করতেও শুরু করেছে। কিন্তু এখন দেখতে পাচ্ছে যে, সেখানে আগুন ধরিয়েছে রাজনীতির নামে ভয়ঙ্কর এক অপশক্তি। স্বপ্ন পুড়িয়ে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষকেও পুড়িয়ে দিচ্ছে তারা। প্রশ্ন হলো, আজকে না হয় বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য এতটাই পাগলপারা হয়ে উঠেছে যে, তাদেরকে কোনভাবেই থামানো যাচ্ছে না। কিন্তু ক্ষমতায় যেতে হলে তো তাদেরকে নির্বাচন নামের অগ্নিপরীক্ষার ভেতর দিয়ে যেতে হবে। আগের মতো তো আর জিয়াউর রহমান নেই; বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে, চার নেতাকে হত্যা করে বন্দুকের নল দেখিয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করার মতো আজকের বিএনপি-জামায়াতও নির্বাচন ছাড়াই ক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হবে। এখন নির্বাচন ব্যবস্থাও অনেকটাই পরিবর্তিত, ছবিসহ ভোটার তালিকা হয়েছে, হয়ত পরবর্তী নির্বাচনের আগে ইলেক্ট্রনিক আইডি কার্ডও মানুষ পেয়ে যাবে। সুতরাং, ২০০১ সালের মতো নির্বাচন জালিয়াতিও সম্ভবপর হবে না। তাহলে সেই নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জনগণের কাছে কোন্ মুখ নিয়ে যাবে? জনগণের মুখ তো তারা ইতোমধ্যেই পুড়িয়ে দিয়েছে, নিজেদের এই গোলাপি লিপস্টিক আর শিফন শাড়িতে মোড়ানো তরতাজা চেহারার আড়ালে যে পেট্রলবোমা নিক্ষেপকারীর চেহারা লুকিয়ে আছে, জনগণ তো সেটা ধরে ফেলেছে ইতোমধ্যেই। জনগণ যদি প্রশ্ন করে যে, আমাকে পুড়িয়ে মেরে আবার আমার কাছেই ভোট চাইতে এসেছেন কোন্্ মুখে? তখন বিএনপি-জামায়াত নেতারা কী উত্তর দেবেন? তারা হয়ত ভাবছেন, এ রকম প্রশ্ন করার সাহস এদেশের জনগণের কোনদিনই হবে না। সে রকম ক্ষমতাবান জনগণের সঙ্গে বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির আসলে পরিচয়ই নেই। বিএনপি-জামায়াত সেসব জনগণকে চেনে, যারা কোন প্রশ্ন ছাড়াই ধর্মবিশ্বাসের মতো বেগম জিয়া, নিজামী, সাকা চৌধুরী, মুজাহিদদের ভোট দেবে। কিন্তু আওয়ামী লীগের বিগত ছয় বছরের শাসনকালে যে জনগণের ভেতর অধিকারবোধটুকু জাগ্রত হয়েছে সে অধিকারে কিন্তু জনগণ আজকাল আওয়ামী লীগকেও প্রশ্ন করতে শুরু করছে যে, আমাদের কাক্সিক্ষত সুশাসন কোথায়? কথা দিয়েছিলেন যে, যুদ্ধাপরাধের বিচার করবেন, কেন তাতে বিলম্ব হচ্ছে? সরকারের অর্থমন্ত্রী একটাকা দু’টাকার নোট বাজার থেকে তুলে দেয়ার যে ঘোষণা দিয়েছেন তাতে সর্বস্তরের মানুষ প্রশ্ন তুলছেন এবং অর্থমন্ত্রী তাঁর কথা ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন। মোটকথা জনগণের ভেতরে খানিকটা হলেও আগের তুলনায় সচেতনতা বেড়েছে এবং জনগণ অন্ততপক্ষে এতটুকু সক্ষমতা অর্জন করেতে পেরেছে, যার ফলে তারা প্রয়োজনীয় প্রশ্নটা উত্থাপন করতে পারছে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো এখন সক্ষম তরুণদের হাতে সেই অস্ত্রটা তুলে দিয়েছে। এর সঙ্গে যদি নির্বাচন ব্যবস্থার সক্ষমতা যোগ হয় তাহলে আগামী নির্বাচনে মানুষকে ধর্ম দিয়ে, অর্থ দিয়ে, শক্তি প্রয়োগ করে ভোলানোটা খুব একটা সহজ কাজ হবে না। জামায়াতে ইসলামীর যুদ্ধাপরাধের কলঙ্ককে মানুষ ভুলে যাবে? বড় ধরনের কোন নোংরামি না করলে নির্বাচনে মানুষ জামায়াতী প্রার্থীকে এ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবেই। তারেক জিয়ার অর্থনৈতিক দুর্নীতি, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি এবং বঙ্গবন্ধুকে অসম্মান করার কারণ জানতে চাইবে ভোটাররা। সেই সঙ্গে এখন যুক্ত হবে পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া প্রায় অর্ধশতাধিক লাশ এবং শত শত মানুষকে বার্ন ইউনিটে দেয়া অমানবিক যন্ত্রণার প্রশ্নটিও। ধরে নিচ্ছি নির্বাচন পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোটটি অটুট থাকছে, কিন্তু এসব প্রশ্নের উত্তর না দিতে পারলে, জনগণ এই জোটকে তার মূল্যবান ভোটটি দেবে তো? বাংলাদেশে ভবিষ্যত রাজনীতি নিয়ে কোন পক্ষই খুব একটা ভাবে বলে মনে হয় না। আওয়ামী লীগকেও সামনে ভোটের রাজনীতির মুখোমুখি হতে হলে বেশ কিছু কঠিন প্রশ্নের উত্তর তৈরি করে তারপর নির্বাচকদের সামনে যেতে হবে। একজন আমেরিকান রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর (এই মুহূর্তে তার নামটি মনে করতে পারছিনে) মতে, রাজনীতির দর্শক ভাবেন প্রতিদিনকার রাজনীতি নিয়ে; কিন্তু একজন রাজনৈতিক নেতা ভাবেন পরবর্তী প্রজন্ম নিয়ে, যাদের কাছে তিনি পরবর্তী নির্বাচনে ভোট চাইতে যাবেন। আমি জানি না, আমাদের কোন রাজনৈতিক দলই কি বিষয়টি নিয়ে ভাবে? মনে হয় না। ঢাকা ॥ ১৯ জানুয়ারি, সোমবার ॥ ২০১৫ [email protected]
×