ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মোগল ইতিহাসে দু’দণ্ড

প্রকাশিত: ০৩:০৬, ২১ জানুয়ারি ২০১৫

মোগল ইতিহাসে দু’দণ্ড

ভারতের শিক্ষামন্ত্রী স্মৃতি ইরানি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঐচ্ছিক তৃতীয় ভাষা হিসেবে এতকাল চলে আসা জার্মান ভাষার বদলে সংস্কৃত ভাষা শেখার বিধান জারি করেছেন। জার্মান ও সংস্কৃত দুটোই ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর সদস্য। পার্থক্য, গুরুত্বের দিক থেকে জার্মান ভাষা এখন পৃথিবীতে তৃতীয় বা চতুর্থ স্থানে রয়েছে। আর সংস্কৃত মৃত। রামায়ণ, মহাভারত বা কালিদাসের সাহিত্যকর্মের স্বাদ নিতে সংস্কৃত জানা অবশ্যই বাড়তি যোগ্যতা। মূল ভাষায় পড়লেই যে কোন সাহিত্যের আসল রস আস্বাদন করা য়ায়- তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই বলে এখনকার বাস্তবতায় জার্মানের জায়গায় সংস্কৃত প্রতিস্থাপন কতটা যৌক্তিক তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ভারতের এখনকার শাসক ও তাদের ধর্মীয় পৃষ্ঠপোষকদের কিছু সিদ্ধান্ত ও আচরণ দেখে অনেকেই কৌতুক করছেন- ভারতের ঘাড়ে ভূত চেপেছে তাই উল্টোদিকে হাঁটছে। উল্টোদিকে হাঁটা আর ইতিহাসের কাছে যাওয়া এক নয়। ইতিহাস শিকড়ের সন্ধান দেয়। বর্তমান দাঁড়িয়ে আছে যার ওপর তার ধারাবাহিকতার বর্ণনা দেয়। ভারত ইতিহাসের আকর। উড়িষ্যার সূর্য মন্দিরের সামনে দাঁড়ালে ইতিহাসের একটি অধ্যায় নিজে থেকেই উন্মোচিত হয়। অনেক প্রশ্ন, অনেক বিস্ময় নিয়ে যায় উৎসের দিকে। দিল্লী ও আগ্রার মোগল স্থাপনা খুলে দেয় ইতিহাসের আরেক অধ্যায়। ॥ দুই ॥ আমরা সিঁড়ি,/তোমরা আমাদের মাড়িয়ে/প্রতিদিন অনেক উঁচুতে উঠে যাও/ তারপর ফিরেও তাকাও না পিছনের দিকে;/ তোমাদের পদধূলি ধন্য আমাদের বুক/ পদাঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায় প্রতিদিন।/ তোমরাও তা জানো,/ তাই কার্পেটে মুড়ে রাখতে চাও আমাদের বুকের ক্ষত/ ঢেকে রাখতে চাও তোমাদের অত্যাচারের চিহ্নকে/ আর চেপে রাখতে চাও পৃথিবীর কাছে/ তোমাদের গর্বোদ্ধত, অত্যাচারী পদধ্বনি।/ তবুও আমরা জানি,/ চিরকাল আর পৃথিবীর কাছে/ চাপা থাকবে না।/ আমাদের দেহে তোমাদের এই পদাঘাত।/ আর সম্রাট হুমায়ুনের মতো/ একদিন তোমাদেরও হতে পারে পদস্খলন ॥ ‘সিঁড়ি’ কবিতায় সুকান্ত ভট্টাচার্যÑ যাকে হুমায়ুনের পদস্খলন বলেছেন। তাই আসলে তাঁর মৃত্যুর কারণ। বিশাল লাইব্রেরী ছিল হুমায়ুনের। একদিন লাইব্রেরী থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামছেন, ঠিক সে সময় আযানের সুর ভেসে আসে। আযানের সময় হুমায়ুন বোঁ করার মতো মাথা নিচু করে আযানের প্রতি সম্মান জানাতেন। অভ্যাসবশত সেদিনও তাই করতে গিয়ে চরম ঘটনাটি ঘটল। পা পিছলে সিঁড়ি থেকে পড়ে মাথায় প্রচ- আঘাত, তাতেই মৃত্যু। হুমায়ুনের সমাধির খাড়া সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে উঠতে ঐতিহাসিক এ তথ্য মনে পড়ছিল। হুমায়ুনের কবর ছাড়া ও শ্বেতপাথরে বাঁধানো আরও বেশ ক’টি কবর রয়েছে এখানে। ইসলামে সম্ভবত কবরের মাটির ওপর কারুকাজ করার বিধি নেই। হয়ত সে কারণে মূল কবর বরাবর একতলা সমান উঁচুতে কারুকাজ করা শ্বেতপাথর দিয়ে কবরের আদল তৈরি করা হয়েছে। এরপর বিস্তৃত পরিসরে সৌধ। অপূর্ব নির্মাণশৈলী। পনেরো শ’ ঊনসত্তর সালে এর নির্মাণ শেষ হয়েছিল। সমরখন্দে তৈমুর লংয়ের সমাধির প্রভাব রয়েছে এ সৌধে। ঐতিহাসিক বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়, মোগলরা ভারতে চিত্র ও স্থাপত্য শিল্পের যে নৈপুণ্য দেখিয়েছেন তার মূল রয়েছে পারস্যে। তৈমুর বংশের সম্রাটদের হাতে যে শিল্পের উৎকর্ষ, মোগলরা তাকেই ভারতে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ভারতের আবহাওয়া উপযোগী করে। জনগণের শিক্ষা বিস্তারে উদাসীনতা থাকলেও নিজেরা পড়াশোনা করতেন। হুমায়ুনের বিশাল লাইব্রেরী ছিল। আকবরও দিল্লী, আগ্রাসহ অন্যান্য জায়গায় লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। অনেক দুর্লভ বইয়ের সংগ্রহ ছিল তাঁর। তিনি শুধু বই সংগ্রহই করেননি, প্রচুর টাকা খরচ করে তাতে অলঙ্করণও করিয়েছিলেন। জাহাঙ্গীর, শাহজাহান ও আওরঙ্গজেব এসব লাইব্রেরীতে আরও বই সংযোজন করে একে আরও সমৃদ্ধ করেছিলেন। মোগল সম্রাটদের মধ্যে আকবর নিরক্ষর ছিলেন। নিরক্ষর ছিলেন তবে অশিক্ষিত ছিলেন না। শ্রুতির মাধ্যমে তিনি ফার্সি ও তুর্কি ভাষাসাহিত্য ভালভাবে আয়ত্ত করেছিলেন। ফার্সির বিশাল সাহিত্যভা-ার থেকে নিয়মিত পাঠ শুনতেন তিনি। রাহুল সাংকৃত্যায়নের দেয়া তথ্য থেকে জানা যায়, ফেরদৌসীর ‘শাহনামা’ তাঁর খুব প্রিয় ছিল। শাহনামায় প্রাচীন ইরানের গৌরবগাথার বর্ণনা শুনে তাঁর মনে ভারতের প্রাচীন সাহিত্য সম্পর্কে কৌতূহল জাগে। জানতে পারেন ভারতের শাহনামা না থাকলেও মহাভারত রয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে মহাভারত ফার্সিতে অনুবাদ করার আদেশ দেন। আগ্রহের তীব্রতা এতই ছিল যে প-িতের মুখে অর্থ শুনে নিজেই ফার্সিতে অনুবাদ করে তা লেখাতে শুরু করেন। শুধু তাই নয়, মহাভারত ও রামায়ণের অলঙ্করণও করিয়েছিলেন তিনি। রামায়ণের অনুবাদ ও অলঙ্করণ করাতে সে সময় খরচ হয়েছিল তিন লাখ টাকা। মহাভারত ও রজমনামা (রাজপুত্রদের মহাকাব্য) অনুবাদ ও অলঙ্করণ করে প্রকাশ করতে খরচ হয়েছিল ছয় লাখ টাকা। ফতেপুর সিক্রি আকবরের অনবদ্য সৃষ্টি। আগ্রা থেকে তেইশ মাইল পশ্চিমে ছোট পাহাড়ের ওপর ফতেপুর সিক্রি। ওয়ার্ল্ড হেরিটেজে অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় সিক্রিতে কিছুটা হলেও যতেœর ছাপ রয়েছে। সিক্রি নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছিল পনেরোশ ঊনসত্তর সালে। শেষ হয় পনেরো শ’ আশি সালে। খুবই পরিকল্পিত নগর ফতেপুর সিক্রি। এখানে বিখ্যাত যোধাবাঈ মহল ছাড়াও আকবরের নবরতেœর একজন বীরবলের জন্য আলাদা করে রয়েছে বীরবল মহল। আর তানসেনের রেওয়াজ করার আসন এখনও চারদিকে পানি দিয়ে ঘেরা। কল্পনায় প্রায় পাঁচ শ‘ বছর আগে ফিরে গিয়ে সবাই যেন আছন্ন হচ্ছিলাম মিয়া তানসেনের বিশুদ্ধ ভারতীয় সুরে। ফতেপুর সিক্রি দেখলে মনে হয় জীবনকে বড় ভালবাসতেন আকবর। এ দেশের মানুষের মধ্যে বেঁচে থাকতে চেয়েছিলেন, মিশে যেতে চেয়েছিলেন- হয়ত সে জন্যই প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন দীন-ই-ইলাহী। ফতেপুর সিক্রির স্থাপনা সম্পর্কে ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ বলেছেন, “ফতেপুর সিক্রির মতো নির্মাণ আগে কেউ করেনি, পরেও কেউ পারবে না। এই পাষাণময় অদ্ভুত ঘটনা, আকবরের বিচিত্র স্বভাবের ক্ষণিক চিন্তা-ভাবনার মূর্ত রূপ। তাঁর সেই মেজাজ (সড়ড়ফ) থাকতে থাকতে তিনি দ্রুতগতিতে শুরু করে এ কাজ সম্পূর্ণ করে গেছেন। দিল্লী, আগ্রার পর আমাদের গন্তব্য ছিল জয়পুর। ইতিহাসের আরেক অধ্যায়। জয়পুর ও অপূর্ব স্থাপনার শহর। দৃষ্টি নন্দন রাজকীয় দুর্গ, প্যালেসে চোখ জুড়িয়ে যায়। অনেক বীরত্ব গাথা ছড়িয়ে আছে সেসবে। এ স্বল্প পরিসরে তা লেখা সম্ভব নয়।
×