ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

‘আহ! সুন্দরবন’- তেল বিপর্যয়ের পরেও সবুজের সমারোহ

প্রকাশিত: ০৩:৫৩, ২০ জানুয়ারি ২০১৫

‘আহ! সুন্দরবন’- তেল বিপর্যয়ের পরেও সবুজের সমারোহ

মোরসালিন মিজান ॥ সুন্দরবন সুন্দরের শুধু। বাংলাদেশের এটি ঐশ্বর্য। অমূল্য সম্পদ। বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী প্রশস্ত বনভূমি গোটা দুনিয়াকে আকৃষ্ট করে রেখেছে। ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার ম্যানগ্রোভ বন খুলনা-সাতক্ষীরা-বাগেরহাট-পটুয়াখালি ও বরগুনা জেলাজুড়ে বিস্তৃত। সামুদ্রিক স্রোতধারা, কাঁদা চর, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপ নিয়ে সুন্দরবন! এখানেই বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের বাস। আছে পাখি, চিত্রা হরিণ, কুমির, সাপ, সজারুসহ অসংখ্য প্রাণী। আরও বহু সুন্দর সুন্দরবনে আছে। এসব কারণে বাংলাদেশের বন এখন বিশ্ব ঐতিহ্য। ইউনেস্কো এ স্বীকৃতি দিয়েছে সুন্দরবনকে। এ পর্যন্ত নিঃসন্দেহে চমৎকার আলোচনা। তবে সাম্প্রতিক খবরটি মন্দ। যারপরনাই দুঃসংবাদ। গত ৯ ডিসেম্বর সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৬৬৪ লিটার জ্বালানি তেলসহ ডুবে যায় একটি ট্যাঙ্কার। মুহূর্তেই গোটা নদীতে তেল ছড়িয়ে পড়ে। ফার্নেশ অয়েলের মিশেলে বিষাক্ত হয়ে ওঠে পানি। জলে-স্থলে এর ক্ষতিকর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। এসব ক্ষয়ক্ষতির কথা প্রতিনিয়ত বলা হচ্ছে। তবে গত শুক্র ও শনিবার বিশেষ আয়োজন ছিল ছবিরহাটে। এখানে সমবেত হয়েছিলেন সুন্দরের একদল পূজারী। চিত্রশিল্পী-গায়ক-সাংবাদিক সবাই মিলে আয়োজন করেছিলেন বিশেষ এই প্রদর্শনীর। ছিল আরও কিছু আয়োজন। দুই দিনব্যাপী আয়োজনের শিরোনাম ছিল ‘আহ! সুন্দরন’। আয়োজকরা একে বলেছেন তেলবিপর্যস্ত বাদাবনের নির্ঘুম আখ্যান। দুই দিনব্যাপী আয়োজন থেকে সুন্দরবন ধ্বংস চেষ্টার প্রতিবাদ ও একে বুকে আগলে রাখার দাবি জানানো হয়। প্রতিবাদী অনুষ্ঠানমালার বড় অংশজুড়ে ছিল প্রদর্শনী। আলোকচিত্র, পেন্টিং, ডিজিটাল আর্ট, স্টেনসিল আর্ট, স্থাপনাশিল্প, কার্টুন ইত্যাদি দিয়ে সাজানো হয়েছিল ছবিরহাট। কিউরেটর ছিলেন আমিরুল রাজিব। প্রায় সব শিল্পকর্মে উঠে আসে আহত সুন্দরবন। বনের অজস্র ক্ষত। বিকৃতি। দেখে মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। দুর্ঘটনার পর সুন্দরবন ঘুরে ছবি তুলেছেন কায়সার আহম্মেদ, ফাইহাম ইবনে শরিফ, তানিম আশরাফ, রুবাইয়াৎ মোগলি ও খোরশেদ আলম রিংকু। তাঁদের ক্যামেরায় টুকরো টুকরো সুন্দরবন। একত্রিত করলে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়, অসুন্দরের থাবায় বিষন্ন সে। ফার্নেশ অয়েল পানির উপরিভাগে যেন দাঁত বসিয়ে দিয়েছে। এর থাবা থেকে নিজেকে বাঁচাতে ছুটে চলেছে শান্ত জলরাশি। কিন্তু মুক্তি মিলছে না। পেছন থেকে তাড়া করছে তেল। ফলে জলের রং বদলে কোথাও হলুদ, কোথাও নীল হয়েছে। আগুনে পুড়ে গেলে যেমন দেখায় তেমনি পানির রং। এই পানি তীরবর্তী সবুজকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। অমনি বিচ্ছিরি কালো রং ধারণ করছে গাছের জলছোঁয়া অংশ। নদীর তীরবর্তী নরম মাটির গায়েও দৃশ্যমান হচ্ছে বিচ্ছিরি কালো। আলোকচিত্রীরা কিছু প্রাণীর ছবি তুলেছেন। চেনাজানা প্রাণী। অথচ প্রথম দেখায় বোঝার উপায় নেই। সজারুর ছবি সজারুর মতো নয়। সাপ নেই সাপের চেহারায়। হাঁসের ছবিটিও বদলে গেছে। সবই একরকম কালো দেখতে। বীভৎস। নদী থেকে তেল অপসারণের দৃশ্যও ছিল একাধিক ছবিতে। না, উন্নত কোন প্রযুক্তির ব্যবহার সেখানে দেখা যায় না। স্থানীয়রা নিজের মতো করে তেল অপসারণ করছেন। অপসারণ না বলে সংগ্রহও বলা যায়। ড্রামে করে, ঘটি-বাটিতে করে তেল সংগ্রহ চলছে। উদ্দেশ্য, বিক্রি। একটি ছবিতে বিশালাকার গর্ত কাটা। ছোট পুকুরের মতো। নিচে পলিথিন বিছিয়ে নেয়া হয়েছে। এর উপরে জমানো হচ্ছে তেল। ছবিটি দেখে আঁতকে উঠতে হয়। অনুমান করা যায়, কত তেল নদীতে ছড়িয়ে পড়েছে। এই ক্ষতি নিরূপণ ও সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন আলোকচিত্রীরা। একই দাবিতে ছবি আঁকেন কামরুজ্জামান স্বাধীন। কার্টুন আঁকেন তন্ময়। মিতা মেহেদি গড়েন স্টেনসিল আর্ট। ছিল বেশ কিছু স্থাপনা শিল্প। এই ধারার কাজ করেন সালেহ মাহমুদ, নাঈম উল হাসান ও ফাহাদ হোসেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বিরাট সমালোচনার মুখে পড়া বাঘটিকেও রাখা হয়েছিল প্রদর্শনীতে। ছবি থেকে তৈরি করা হয়েছিল নতুন এই ছবি। তাতে দেখা যায়, বাঘের শরীরের অর্ধেক অংশ কালো। যেন আগুনে পোড়া। সুন্দরবনের ক্ষতি তুলে ধরতে এ ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়া হয়। কিন্তু প্রকৃত ছবি ফেসবুকে আসার পর শুরু হয় সমালোচনা। ময়লার ভাগাড়ে অর্ধেক ডুবে থাকা দেখানো হলেও, প্রকৃত ছবিতে বাঘটি ছিল সাবলীল। সুন্দর। এ অবস্থায় সুন্দরবনের ক্ষতির কথা বলতে গিয়ে কেউ কেউ মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছেন বলে অভিযোগ ওঠে। বিতর্ক জোরালো হয়। প্রদর্শনীতে এসে সে ছবির দিকে অনেকে তাই বিশেষ চোখে তাকিয়েছেন। তাদের কাছে বিষয়টি ব্যাখ্যা করে জুবায়ের কাওলিন খুব সম্ভবত বলতে চেয়েছেন, শিল্পী যে কোন মাধ্যমে তার মনের কথাটি বলতে পারেন। আমি ডিজিটাল আর্ট মাধ্যমে বলেছি। কোন বিকৃতি নয়। এটা প্রতীকী। শিল্পীর অন্তরচক্ষু দিয়ে দেখা ক্ষতিগ্রস্ত সুন্দরবন। নাটকের ভাষায়ও বলা হয়েছে সুন্দরবনের ক্ষয়ক্ষতির কথা। এভাবে দুইদিন চলার পর শেষ হয় আয়োজন। তবে সুন্দরবন বাঁচানোর আন্দোলন শেষ হয়নি। এ আন্দোলন অব্যাহত থাকবে বলে জানান আয়োজনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।
×