ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচার একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি

প্রকাশিত: ০৭:১৪, ১৯ জানুয়ারি ২০১৫

মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচার  একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি

৪৩ বছর আগে রৌদ্রকরোজ্জ্বল এক দিনের কথা মনে পড়ছে আজ। শহীদ মিনারে জড়ো হয়েছি আমরা অনেকে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে মাস দু’য়েক হলো। তারিখ ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২। আমাদের দাবি যুদ্ধাপরাধের বিচার, সমাবেশের উদ্যোক্তা জহির রায়হান ও শহীদুল্লা কায়সারের বোন নাফিসা কবির। তিনি থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে। শহীদুল্লা কায়সারের স্ত্রী পান্না কায়সার, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর স্ত্রী লিলি চৌধুরী, ডাঃ আলীম চৌধুরীর স্ত্রী শ্যামলী নাসরিন চৌধুরীসহ অনেকেই আছেন। আরও আছেন তরুণদের অনেকেই। নাফিসা কবিরের ভাই শাহরিয়ার কবিরও আছেন। ছিলাম আমিও। আমাদের বয়স তখন ২১-২২। সেই থেকে ২০১৫ পর্যন্ত কতটা পথ পেরিয়ে এলাম। যে আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল তাতে শহীদ পরিবারের সমর্থন ও অংশগ্রহণ অবশ্য ছিল, কিন্তু সক্রিয় ছিল কয়েকজন। তারপর ৪০ বছর আন্দোলনের পর শুরু হয়েছে বিচার প্রক্রিয়া। এ দীর্ঘপথ যাত্রায় আমাদের সঙ্গে অনেকেই ছিলেন, এখনও আছেন। ১৯৭৮ সালের ১১ জুলাই, গোলাম আযম অসুস্থ মাতাকে দেখার অজুহাতে পাকিস্তানী পাসপোর্ট নিয়ে ৩ মাসের ভিসায় ঢাকা আসেন। মাতাকে দেখতে আসাটা ছিল অজুহাত, পাকিস্তানের নির্দেশেই তিনি আসেন এবং নিশ্চয় জিয়াকে তা জানানো হয়েছিল, না হলে তিনি ভিসা পেতেন না। তিনি এসে জামায়াতে ইসলাম বাংলাদেশ পুনর্গঠন করেন। আব্বাস আলী খানকে ভারপ্রাপ্ত আমির করা হয়, তিনি ছিলেন ছায়া আমির। আর রাজাকার বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা এ কে ইউসুফকে জেনারেল সেক্রেটারি করেন। গোলাম আযম ভিসা শেষ হলেও থেকে যান। এর আগে ১৯৭৭ সালে আলবদর বাহিনীর কমান্ডাররা ইসলামী ছাত্রশিবির গঠন করে। সিভিল সমাজের ক্ষোভ এ সময় প্রকাশিত হয় সেক্টর কমান্ডার কর্নেল নুরুজ্জামান বীরউত্তমের মাধ্যমে। ১৯৮৪ সালে কাজী নুরুজ্জামান, শাহরিয়ার কবির, আহমদ শরীফ প্রমুখের উদ্যোগে গঠিত হয় ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশ কেন্দ্র।’ মূল লক্ষ্য ছিল ঘাতকদের পরিচয় নতুনভাবে তুলে ধরা। জাহানারা ইমামও তখন ধীরে ধীরে ‘শহীদ জননী’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন। ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয় তার ‘একাত্তরের দিনগুলি’ যা পাঠকদের আপ্লুত করে। চেতনা বিকাশ কেন্দ্র ১৯৮৭ সালের বইমেলায় প্রকাশ করে ‘একাত্তরের ঘাতকরা কে কোথায়’। সাত দিনে এই বইয়ের ৫০০০ কপি বিক্রি হয়। এরপর থেকেই সারাদেশে মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত বইপত্র প্রকাশের প্রবল উৎসাহ লক্ষ্য করা যায়। আর এসব মিলেই ঘাতকদের বিরুদ্ধে জনমত সংহত হতে থাকে। ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি কর্নেল নুরুজ্জামান, জাহানারা ইমাম ও শাহরিয়ার কবিরের উদ্যোগে গঠিত হয় ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’। জাহানারা ইমাম হন এর আহ্বায়ক। এর একমাস পর ১১ ফেব্রুয়ারি ৭২টি রাজনৈতিক/সাংস্কৃতিক সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত হয় ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল সমন্বয় কমিটি।’ একটি মাত্র লক্ষ্যই স্থির হয়Ñ জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা। আওয়ামী লীগ এ ক্ষেত্রে সর্বপ্রকার সাহায্য-সহায়তা প্রদান করে। সমন্বয় কমিটি তিনটি বড় কাজ করেছিলÑ ১. আদালতে গোলাম আযমের প্রতীকী বিচার (২৬ মার্চ, ১৯৯২) ২. গণতদন্ত কমিশনের দুটি প্রতিবেদন প্রকাশ (১৯৯৪, ১৯৯৫)। ৩. দেশজুড়ে যুদ্ধাপরাধী বিচারের দাবিতে জনমত সংগঠন। বিশেষভাবে গণআদালত সাফল্যম-িত হওয়ায় সারাদেশে জামায়াতবিরোধী এক প্রচ- আবেগের সৃষ্টি হয়। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি আজ ২৪ বছরে পা দিল। শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চে যারা প্রথমে গিয়েছিল তাদের অনেকের বয়স ছিল ১৮ থেকে ২২ এর মধ্যে। বাংলাদেশের সিভিল সমাজের আর দু’টি প্রতিষ্ঠান বোধহয় নির্মূল কমিটির বয়সী এবং সক্রিয়। এর একটি জাতীয় কবিতা পরিষদ, অপরটি সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। এরা পরস্পরের পরিপূরক; লক্ষ্য প্রায় একÑ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, স্বৈরাচার প্রতিরোধ, মৌলবাদ-জঙ্গীবাদ নির্মূল, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। এই তিনটি প্রতিষ্ঠানের শাখা ও সদস্য সংখ্যা বাংলাদেশের অধিকাংশ নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের চেয়ে বেশি। আজ তেইশ বছর পর মনে হচ্ছে, খুব কম দেশে এ ধরনের আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন শিল্পী-সাহিত্যিকরা। কবি শামসুর রাহমান দীর্ঘদিন আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। প্রবীণ শওকত ওসমানকে যখন ডেকেছি তখনই সাড়া দিয়েছেন। কাইয়ুম চৌধুরী, হাশেম খান বা রফিকুননবীর মতো বরেণ্য শিল্পীর কাছে যখন পোস্টার চেয়েছি নির্দ্বিধায় করে দিয়েছেন। বিচারপতি কেএম সোবহান তো আমাদের বয়সীই হয়ে গেছিলেন। মনে পড়ছে ব্যারিস্টার শওকত আলীর কথাও, সব সময় যিনি ছিলেন হাস্যোজ্জ্বল। বক্তা হিসেবে কামাল লোহানী, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর কখনই বিমুখ করেননি। কবীর চৌধুরী ও নির্মূল কমিটি তো একীভূত হয়ে গিয়েছিলেন। কলিম শরাফীর কথাও বা কীভাবে ভুলি? শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী বা সালমা হক, আবুল বারক আলভী ও মমতাজ লতিফকে আজ পর্যন্ত দেখিনি একটি সভা বা মিছিলে অনুপস্থিত থাকতে। এভাবে সবাই মিলে আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়েছে আজ প্রায় চার বছর হলো। যুদ্ধাপরাধের বিচার শুধু নির্মূল কমিটি চেয়েছে তা নয়। বাংলাদেশের অনেক সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবি করেছে। কিন্তু নির্মূল কমিটির বৈশিষ্ট্য হলোÑ এ আন্দোলনের পথ থেকে কখনও বিচ্যুত না হওয়া, বিরতি না দেয়া এবং তা জনদাবিতে পরিণত করতে পারা। যতদিন পর্যন্ত বিচারের ট্রাইব্যুনাল গঠিত না হয়েছে, ততদিন নির্মূল কমিটি জনমত জাগ্রত রেখেছে এবং ট্রাইব্যুনাল আইনসংক্রান্ত নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি ও শৈথিল্যের গঠনমূলক সমালোচনা করেছে। বিদেশে যখন জামায়াতের লবিংয়ের কারণে সরকার, ব্যক্তি, সংগঠন, ট্রাইব্যুনালের সমালোচনা করেছে তখন আমরা বার বার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এর একটি বিহিত করার জন্য অনুরোধ করেছি। জামায়াত নিষিদ্ধকরণের দাবি গত প্রায় তিন দশক ধরে নির্মূল কমিটি করে আসছে। প্রথমদিকে যখন এ দাবি করা হয় তখন সবাই এটি অবাস্তব দাবি বলে মনে করেছে। গত এক বছর ধরে জামায়াতের সহিংসতা এই দাবিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। আজ এটি বাস্তব সত্য যে, জামায়াত ধর্মকে পুঁজি করে একটি দানবীয় শক্তিতে পরিণত হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের প্রতিটি রায়ে জামায়াতকে অপরাধী সংগঠন বলা হয়েছে। একটি রায়ে এমনও মন্তব্য করা হয়েছে যে, জামায়াত আদর্শে বিশ্বাসী কেউ যাতে সরকারে প্রবেশপত্র না পায় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে বলেছে। জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে। আমাদের আন্দোলন অব্যাহত থাকলে সরকার অবশ্যই জামায়াত নিষিদ্ধ করতে বাধ্য হবে। জামায়াত নিষিদ্ধ করার দাবির সঙ্গে আমরা আরেকটি দাবি করছি; তা হলোÑ ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধান থেকে অপসারণ করা। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে। শোনা যাচ্ছে, জামায়াতের বিচারের জন্য আইন বদল হবে। সে কারণে, রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে খানিকটা আলোকপাত করতে হয়। আমরা সবসময় মনে করেছি, বিশেষ করে শাহরিয়ার এবং আমি যে, রাজনৈতিক সমর্থন ছাড়া আমাদের এ ধরনের আন্দোলন কার্যকর হবে না। এ কারণে আমাদের অনেকে আওয়ামীপন্থী বলতে পারেন, তাতে কিছু আসে যায় না। এটা তো আজ সবাই মেনে নিচ্ছেন যে, শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী না হলে বিচার হতো না। এই আন্দোলন যখন শুরু হয় তখন জামায়াতের মিত্র বিএনপি ক্ষমতায়। সে অবস্থায় এ ধরনের আন্দোলনের সূত্রপাত ব্ল্যাসফেমির মতো। যে কারণে গণআদালত সফল হলে উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার মামলা করতে দ্বিধা করেনি খালেদা সরকার। শুরু থেকেই আমরা বলেছিলাম, সিভিল সমাজ এ আন্দোলনের উদ্যোক্তা কিন্তু লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে রাজনৈতিক সমর্থন ও অঙ্গীকার দরকার। রাজনৈতিক দলগুলো, যাদের আমরা মিত্র ভাবি তারা সহায়তা করেছিল। জামায়াত যদি নিষিদ্ধ হয় তাহলে নতুন নামে তারা নতুন দল করবে। বিএনপিতে একটি অংশ একীভূত হয়ে যাবে। তার দরকষাকষির ক্ষমতা কমে যাবে। লাভ হবে বিএনপির। নির্বাচনে তাদের জামায়াতের সঙ্গে সিট ভাগাভাগি করতে হবে না। অনেক বিএনপি নেতা ফিসফাস করে বলছেন, সরকার এদের নিষিদ্ধ করে না কেন? জামায়াত নিষিদ্ধ হলেও বিএনপিতে ভোট দেবে। লাভবান হবে আওয়ামী লীগও। কারণ গোপন সংস্থা হিসেবে জামায়াত তেমন কার্যকর কর্মপন্থা নিতে পারবে না। যেমনটি হয়েছে হিযবুত তাহরীর ক্ষেত্রে। তবে, বিএনপিতে প্রবলভাবে অনুপ্রবেশের পর বিএনপিকে তারা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করবে। রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগ সবচেয়ে লাভবান হবে এবং এটি মধুর প্রতিশোধও হবে। বঙ্গবন্ধু জামায়াতকে নিষিদ্ধ করেছিলেন। রাজাকার বন্ধু জিয়া সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু কন্যার সময় [যদি রায় অনুকূল হয়] জামায়াত আবার নিষিদ্ধ হতে পারে। এতে এ কথা প্রমাণিত হবে যে, শেখ হাসিনা আদর্শের জায়গাটা আবার ফিরিয়ে আনতে যাচ্ছেন যা রাষ্ট্রের জন্য শুভ। তরুণদের সম্পূর্ণ সমর্থন আওয়ামী লীগ পাবে, যা হেফাজতের থেকে বেশি। সিভিল সমাজের এ ধরনের আন্দোলনে সর্বতোভাবে ১৪ দলের সাহায্য করা ফরজ। কারণ তাতে তাদের লোকসান নেই, লাভই বেশি। জীবনে জয়-পরাজয় বড় ব্যাপার নয়, লড়াই করে যাওয়াটাই আসল এবং লড়াই করে গেলে জয় আসবেই। কারণ, ইতিহাস আমাদের পক্ষে। ১৯ জানুয়ারি ২০১৫
×