ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জামায়াত-বিএনপি আইনজীবীরাও স্বতঃস্ফূর্ত যোগ দিলেন প্রধান বিচারপতির সংবর্ধনায়

খায়রুল হক, মোজাম্মেল হোসেন যা পাননি সিনহা তা পেলেন

প্রকাশিত: ০৬:২৯, ১৯ জানুয়ারি ২০১৫

খায়রুল হক, মোজাম্মেল হোসেন যা পাননি সিনহা তা পেলেন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহা বলেছেন, সুপ্রীমকোর্টের পরামর্শ ছাড়া নিম্ন আদালতে বদলি ও বাধ্যতামূলক অবসর হতে দেয়া হবে না। তিনি বলেন, বিচার বিভাগকে আরও গতিশীল করা হবে, যাতে বিচার ব্যবস্থা নিয়ে জনগণের মধ্যে কোন হতাশা না থাকে। মামলা জট নিরসনসহ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও মর্যাদা রক্ষায় দৃঢ়প্রত্যয়ও ব্যক্ত করেছেন নবনিযুক্ত এ প্রধান বিচারপতি। রবিবার সুপ্রীমকোর্টের ১ নম্বর বিচারকক্ষে সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতি এবং এ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ের দেয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতি এ সব কথা বলেন। নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতির প্রথম কর্মদিবস উপলক্ষে রবিবার সকাল পৌনে ১১টার দিকে রেওয়াজ অনুসারে তাঁর সংবর্ধনা সভা শুরু হয়। সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ও বিচারপতি মোঃ মোজাম্মেল হোসেনের দায়িত্বগ্রহণ ও বিদায়ের দিনে বিএনপি-জামায়াত সমর্থক আইনজীবীরা উপস্থিত না থাকলেও নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার সংবর্ধনা সভায় তাঁদের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। আইনজীবীদের উপস্থিতিতে কানায় কানায় পূর্ণ সভায় প্রধান বিচারপতি ছাড়াও বক্তব্য রাখেনÑ এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা খন্দকার মাহবুব হোসেন। সভায় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেনÑ আপীল বিভাগ ও হাইকোর্টের বিচারপতিগণ, প্রবীণ আইনীবী ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, এম আমীর-উল ইসলাম, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, আজমালুল হোসেন কিউসি, সাবেক এ্যাটর্নি জেনারেল এ জে মোহাম্মদ আলী, সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ও বিএনপির যুগ্মমহাসচিব এম মাহবুব উদ্দিন খোকন ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতাদের অন্যতম আইনজীবী এ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম প্রমুখ। প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নিয়োগ রাষ্ট্র্রীয় ইতিহাসের জন্য বিরাট অর্জন উল্লেখ করে অনুষ্ঠানে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, এ নিয়োগের মাধ্যমে সংবিধানের একটি মুলস্তম্ভ অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষতার বাস্তব প্রতিফলন ঘটছে। বর্তমান বিশ্বে সভ্যতার মাপকাঠি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতাও বিবেচিত হয়। বিচারপতিদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে মাহবুবে আলম বলেন, বর্তমানে বিচারপ্রার্থীদের নিষ্পত্তিকৃত মামলার রায় পেতে অবর্ণনীয় সমস্যার সš§ুখীন হতে হচ্ছে। এমনও দেখা গেছে একটি সাধারণ মামলা নিষ্পত্তির পর ২-৩ বছরেও মামলার রায়ের সইমহুরি কপি পাওয়া যায় না। তিনি নিষ্পত্তির ১-২ সপ্তাহের মধ্যে যাতে সইমহুরি পাওয়া যায়, সে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রধান বিচারপতির কাছে অনুরোধ করেন। খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, জ্যেষ্ঠতা ও মেধারভিত্তিতে প্রধান বিচারপতি হিসেবে আপনার এ নিয়োগে আমরা গর্বিত ও আনন্দিত। হাইকোর্ট ও আপীল বিভাগের বিচারক হিসেবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ রায়ের মধ্য দিয়ে আপনার অসাধারণ মেধা ও প্রজ্ঞা প্রকাশ পেয়েছে। বিচারপ্রার্থী জনগণের আস্থা অর্জন এবং বার ও বেঞ্চের মধ্যে সমন্বয় সাধনে প্রধান বিচারপতি সচেষ্ট থাকবেন বলেও প্রত্যাশা করেন তিনি। অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি আরও বলেন, উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে ভারতে আইন আছে। আমাদের সংবিধানে এ বিষয়ে যে বিধান আছে আলাপ-আলোচনা করে আরও স্বচ্ছ কিছু করা যায় কিনা, তা দেখা হবে। নিম্ন আদালতের বিচারক নিয়োগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও স্বাধীন। সুপ্রীমকোর্টের বিচারক এবং বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিয়োগ পরীক্ষার খাতা দেখেন। এ প্রক্রিয়া চুল পরিমাণ ফাঁক নেই। এ ক্ষেত্রে প্রশ্নপত্র ফাঁসের উদাহরণও নেই, ভবিষ্যতেও হবে না। প্রধান বিচারপতি বলেন, নিম্ন আদালত মোটামুটি সুপ্রীমকোর্টের নিয়ন্ত্রণে এসে পড়েছে। আমরা (জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন) সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছিÑ বিচারক নিয়োগ যেমন আমাদের অধীনে তেমনি কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের বিষয়টিও পিএসসি থেকে যেন আমাদের অধীনে দেয়া হয়। আর সুপ্রীমকোর্টের অনুমোদন ছাড়া বিচারিক আদালতের কোন বিচারক বদলি করা যাবে না। এটলিস্ট আমি হতে দেব না। আদালতের অবকাশকালীন ছুটি কমানোর বিষয়ে এ্যাটর্নি জেনারেলের প্রস্তাব প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতি বলেন, বিষয়টি অনুভব করছি। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে দেখব, যাতে একটি সৌহার্দপূর্ণ পথ বেরিয়ে আসে। ঔপনিবেশিক আইন বদলে গণতান্ত্রিক করার আহ্বান ব্রিটিশ আমলে করা ঔপনিবেশিক আইনগুলো পরিবর্তন করে গণতান্ত্রিক সমাজের উপযোগী করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি এ আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আমরা এমন একটি পরিবর্তনশীল জটিল সমাজে বাস করি, যেখানে মানুষের আচরণ ও জীবনযাত্রায় বিজ্ঞান প্রযুক্তির প্রভাব রয়েছে। এর সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের বিরোধ ও অপরাধের ঘটনা ঘটছে। প্রধান বিচারপতি বলেন, দেওয়ানি বিরোধ নিষ্পত্তি ও অপরাধ সংগঠনকারীদের চিহ্নিত করতে দেশে প্রসিডিউরাল ও সাবস্টানশিয়াল আইন চালু করা দরকার। আমার মতে, তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক আধুনিক সমাজের প্রয়োজন অনুসারে আইনে নতুন ডাইমেনশন থাকা উচিত। একটি জীবন্ত অঙ্গের মতো এর একটি গতিশীল ভূমিকা থাকা উচিত। তিনি আরও বলেন, আইন প্রতœতত্ত্বের মতো তুলে রাখার, প্রশংসা করা বা সেলফে রাখার বিষয় নয়। বরং এটা এমন একটা গাছের মতো, যা মূল ইতিহাসে প্রোথিত, যা সময়ের সঙ্গে নতুন পত্রপল্লবে সুশোভিত হয় এবং মরা ডালপালা ঝেড়ে ফেলে। প্রধান বিচারপতি বলেন, এ ডিজিটাল সময়ে আমরা বিচার বিভাগের প্রতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন করতে পারব না, যতক্ষণ টেকসই ও সাশ্রয়ী তথ্যপ্রযুক্তিকে এখানে সমন্বিত না করব। বিদ্যমান আইন অনুসারে আমাদের আদালত ব্যবস্থা কোন ডিজিটাল প্রমাণ বা ইলেকট্রনিক যোগাযোগকে প্রমাণ হিসেবে স্বীকার করে না। আমার মতে, আমাদের আইন ব্যবস্থার উপযোগী এবং সামর্থ্যরে মধ্যে থাকা একটি আইসিটি অবকাঠামো গড়ে তোলার সময় এসেছে। আদালতে বিচারিক ও প্রশাসনিক কাজ করতে বিশেষায়িত সফটওয়্যার চালু করতে হবে। তিনি বলেন, এ সব লক্ষ্য বাস্তবায়নে আমাদের বিদ্যমান সেকেলে আইন ও বিধিগুলোকে নিয়ে চলতে পারব না, যার মধ্যে দেওয়ানি কার্যবিধি, ফৌজদারি কার্যবিধি, সাক্ষ্য আইন, দ-বিধি, আর্মস আইন প্রভৃতি। খুঁটিনাটি পরীক্ষার পর এ আইনগুলো করা উচিত। তিনি আরও বলেন, আমরা জানি, এ সব আইন ঔপনিবেশিক আমলে করা হয়েছে। এ কারণে এই দেশের বিদ্যামান আইনে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতিফলন নেই। এর মধ্যে একটি গণতান্ত্রিক জাতি হিসেবে আমরা ৪৩ বছর অতিক্রম করে ফেলেছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রয়োজনীয় আইনগুলোকে গণতান্ত্রিক জাতির উপযোগী করে তুলতে পারি নাই। সুতরাং আমি এ জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। তিনি বলেন, এটা দেখা গেছে যে, ফৌজদারি মামলায় অপরাধী দ- প্রদানে একই মাপকাঠি অনুসরণ করা হয় না। আমাদের প্রতিবেশী দেশে ইতোমধ্যে দ-ের বিধি রয়েছে। আমি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবিলম্বে এ বিধি করতে আহ্বান জানাচ্ছি। সকল ধরনের সন্ত্রাস দমনে আহ্বান প্রধান বিচারপতির ॥ সকল ধরনের সন্ত্রাস দমনে সকলকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা। আইনজীবীদের দেয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি এ আহ্বান জানান। এসকে সিনহা বলেন, সত্যিকারের অপরাধীদের ন্যূনতম সময়ে শাস্তি নিশ্চিত করার ব্যবস্থা না করা গেলে সন্ত্রাস দমন করা যাবে না। তিনি বলেন, অভিযুক্তের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনে প্রয়োজনীয় প্রমাণ ও উপকরণ সংগ্রহে আমাদের তদন্তকারী সংস্থাগুলোকে যথাযথভাবে দক্ষ এবং প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হিসেবে পাওয়া যাচ্ছে না। সম্প্রতি কিছু স্পর্শকাতর মামলায় এটা আমার কাছে মনে হয়েছে, প্রয়োজনীয় প্রমাণ ও উপকরণের অভাবে দ-িতের দ- বহাল রাখা যাচ্ছে না। যেগুলো তদন্ত পর্যায়ে সংগ্রহ করার কথা ছিল। তিনি বলেন, প্রমাণ সংগ্রহের পরিবর্তে ফৌজদারি তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মধ্যে পত্রিকায় খবর প্রকাশে অধিক প্রবণতা আমি লক্ষ্য করেছি। এটা অধিকাংশ মামলার বিচারকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। উপযুক্ত আদালতে একটি স্বচ্ছ বিচারের আগে আইনগত কাউকে অপরাধী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া যায় না। প্রচার এড়িয়ে পেশাদার হতে দৃষ্টিভঙ্গিগত পরিবর্তন আনতে আমি আইনশৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনীর সব সদস্যের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র। ইতোমধ্যে এই দেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে সুখ্যাতি অর্জন করেছে। আমরা জানি, অধিকাংশ সময় উন্মত্ত সন্ত্রাসী কার্যক্রমের শিকার হয় নিষ্পাপ সাধারণ মানুষ। সকল ধরনের সন্ত্রাস দমনে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। প্রধান বিচারপতি বলেন, যদি কোন কোন সন্ত্রাসী কার্যক্রম নিন্দা করা হয়, আর অন্য কোন সন্ত্রাসী কার্যক্রমকে যদি সহ্য করা হয় এবং ন্যায্যতা দেয়া হয়, তাহলে সন্ত্রাস দমন অসম্ভব হয়ে যাবে। তিনি বলেন, বিদ্যমান নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে এবং আইনজীবী ও বিচারকদের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করতে আইনজীবী সমিতির সদস্যসহ সকলের সঙ্গে বসতে আমি পরিকল্পনা করছি। নিরাপত্তার স্বার্থেই সুপ্রীমকোর্টের প্রবেশপথে বিধিনিষেধ আরোপ করা প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেন তিনি। গত ১৭ জানুয়ারি বঙ্গভবনে দেশের ২১তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে বিচারপতি এস কে সিনহাকে শপথ পড়ান রাষ্ট্র্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। গত ১২ জানুয়ারি নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতিকে নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি।
×