ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অবরোধের আগুনে রেহাই পাচ্ছে না শিক্ষার্থীরা

প্রকাশিত: ০৬:২৭, ১৯ জানুয়ারি ২০১৫

অবরোধের আগুনে রেহাই পাচ্ছে না শিক্ষার্থীরা

বিভাষ বাড়ৈ ॥ কথিত ‘শান্তিপূর্ণ’ হরতাল-অবারোধের নামে বিএনপি-জামায়াত জোটের জঙ্গীরূপে চালানো নাশকতায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে দেশের সাড়ে চার কোটি শিক্ষার্থীর পরিবারে। দৃশ্যমান কোন আন্দোলন না করে সাধারণ মানুষের ওপর জঙ্গীদের মতো বিএনপি-জামায়াত ক্যাডারদের একের পর এক সহিংস আক্রমণে সন্তানদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠাতে সাহস পাচ্ছেন না অভিভাবকরা। আক্রমণ থেকে রক্ষা পাচ্ছেন না শিক্ষকরাও। বছরের প্রথম দিন নতুন পাঠ্যবই হাতে পেলেও বিদ্যালয়ে যেতে সাহস পাচ্ছে না শিশুরা। এদিকে সড়কে-মহাসড়কে গাড়িতে আগুন, চোরাগোপ্তা হামলা, পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ ও ককটেল বিস্ফোরণে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের হতাহতের ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী অভিভাবকদের মাঝে। ক্ষুব্ধ অভিভাবকরা অপরাধীদের কঠোর হস্তে দমনের আহ্বান জানিয়েছেন। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার প্রতি অভিভাবকদের প্রশ্নÑ আন্দোলনের নামে এভাবে নাশকতা আর কতদিন? ভুক্তভোগী শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষাবিদরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন, আমাদের নেতানেত্রীরা ভুলে গেছেন নতুন প্রজন্মের কোটি কোটি শিক্ষার্থী কোন দলের সন্তান নয়, এরা পুরো জাতির সন্তান। এভাবে লাগাতার হরতাল-অবরোধ আবার তার মাঝে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের ওপর পেট্রোলবোমা হামলা চালিয়ে নেতানেত্রীরা কি অর্জন করতে চান? এভাবে লাগাতার শিক্ষাবিরোধী এ ধ্বংসাত্মক কর্মসূচী ডাকা যুক্তিহীন, দায়িত্বহীন, জ্ঞানহীন ও অবিবেচকের কাজ। অপরাজনীতির নামে কোটি কোটি শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন ধ্বংস করা হচ্ছে। অভিভাবকরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন, আন্দোলনের নামে এভাবে চলতে থাকলে সন্তানদের জন্য জীবন রক্ষায় তাদের রাজপথে নামা ছাড়া উপায় থাকবে না। এর আগে মহাসমাবেশের অনুমতি না পাওয়ার অজুহাতে ৫ জানুয়ারি বিকেলে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া দেশজুড়ে অনির্দিষ্টকালের অবরোধের ডাক দিয়েছিলেন। এরপর থেকে দৃশ্যমান কোন রাজনৈতিক কর্মসূচী নেই এ জোটের। নেতারা বের হন না ঘর থেকে। গ্রেফতারের ভয়ে পিঠ বাঁচাতে নেতারা আয়েশে জীবনযাপান করে বেড়াচ্ছেন। আর আন্দোলনের নামে সারাদেশে চালাচ্ছেন জ্বালাও-পোড়াওসহ নাশকতা। ইতোমধ্যেই এক শিক্ষক ও দুই শিক্ষার্থীকে পেট্রোলবোমা হামলা চালিয়ে হত্যা করেছে কথিত আন্দোলনকারীরা। এর মধ্যেই রবিবার জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় দিনে-দুপুরে একটি বাসে পেট্রোলবোমা ছুড়ে আগুন দেয়া হয়েছে, যাতে আহত হয়েছেন ইডেন কলেজের চার শিক্ষার্থী। এদের মধ্যে সাথী আক্তার (১৯) ও যুথি আক্তার (১৯) নামে দুজন দগ্ধ হয়েছেন। তাঁদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছে। বাস থেকে নামার হুড়োহুড়িতে পায়ে আঘাত পেয়েছেন মাইমুনা বেগম (১৮) ও মুক্তি (১৯) নামের অপর দুই শিক্ষার্থী। তাঁরা চারজনই ইডেন কলেজের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। প্রথম বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষার ফরম পূরণ করে তাঁরা মিরপুরে বাসায় ফিরছিলেন। চার শিক্ষার্থীর আহত হওয়ার খবর পেয়ে ঢাকা মেডিক্যালে ছুটে যান শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ। তিনি বলেন, বোমাবাজ-জঙ্গীবাজরা শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করছে। পশু এবং অমানুষরাই এ ধরনের কাজ করতে পারে। অবরোধ সমর্থনকারীদের প্রতি প্রশ্ন রেখে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, শিক্ষাথীরা স্কুল-কলেজে যাচ্ছে বলেই কি তাদের পোড়াতে হবে! বাসে অগ্নিসংযোগ করে তাদের শরীর ঝলসে দিতে হবে? তিনি বলেন, জনগণের কল্যাণে ও অধিকারের কথা বলে যারা অবরোধ করছেন, যদি সত্যিই বিষয়টি তা হতো, তবে মানুষ মেরে তাঁরা আন্দোলন করতেন না। শিক্ষামন্ত্রী আরও বলেন, দেশে সকল পরীক্ষার তারিখ আগে থেকেই নির্ধারণ করা থাকে। ছয় বছর ধরে একইভাবে কলেজে ফরম পূরণের তারিখ নির্ধারণ করা হচ্ছে। আজ ইডেন কলেজের ওই ছাত্রীরা ফরম পূরণের জন্যই কলেজে যায়। এ সময় তারা অগ্নিদগ্ধ হলো। গত বছরও নতুন বই দেয়ার সময় আমাদের শিক্ষার্থীদের ওপর এ রকম হামলা হয়েছে। এবারও তাই হচ্ছে। যারা নাশকতাকারী তারা পরিকল্পনা করেই এমনটা করে, যাতে দেশ ও জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার জানিয়েছেন, হরতাল-অবরোধে আতঙ্কের ক্যাম্পাসে পরিণত হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। টানা অবরোধের ১৪ দিনে এ পর্যন্ত ক্যাম্পাস ও এর আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় প্রায় দুই শতাধিক ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। তবে এ সব ঘটনায় জড়িতদের কাউকে আটক করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। এতে চরম নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। রবিবার সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক-কেন্দ্রসহ ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গার চায়ের দোকানসহ ভাসমান বাহারি পণ্যের দোকান বন্ধ করে দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা জোরদার করার লক্ষ্যে এ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাধারণত সন্ধ্যার পরপরই এ সব ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে। কিন্তু ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে ককটেল নিক্ষেপকারীরা। ফলে সন্ধ্যার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থানে ও আড্ডার জায়গাগুলোতে জনউপস্থিতি খুবই কম লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গত ৫ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের আশপাশের এলাকায় প্রায় ১০টি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটে। এরপর গত ১১ জানুয়ারি মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৯তম সমাবর্তন চলাকালে কলা ভবন থেকে অবিস্ফোরিত ৪টি ককটেল উদ্ধার করে শাহবাগ থানা পুলিশ। একই সন্ধ্যায় পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সামনে বিস্ফোরণ ঘটে আরও তিনটি ককটেলের। এর আগের দিন ১০ জানুয়ারি সোমবার কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে হাকিম চত্বরে পরপর চারটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটে। এতে রিক্সাচালকসহ তিনজন আহত আহত হন। গত ১৬ জনুয়ারি শুক্রবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে কার্জন হলের সামনে একটি রিক্সাকে লক্ষ্য করে হঠাৎ একটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এতে সামান্য আহত হন সংবাদ সংস্থা ইউএনবির এক সাংবাদিক। লাগাতার আক্রমণে শিক্ষা পরিবারে ব্যাপক ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়লেও পথে জীবন অনিশ্চত হয়ে পরায় অভিভাবকরা সন্তানকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠাতে সাহস পাচ্ছেন না। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল এ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ড. শাহান আরা বেগম বলেন, অবরোধের সময় শিক্ষার্থীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসতে নিরাপত্তহীনতায় থাকে। এ কারণে উপস্থিতির হার কম থাকে। এখনও তাই হচ্ছে। ধানম-ি গভর্মেন্ট ল্যাব্রেটরি উচ্চ বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক বলেন, অবরোধ আতঙ্কে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি খুব কম। অভিভাবকরাও হরতাল-অবরোধে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সন্তানদের নিয়ে বাসা থেকে বের হন না। তাই অবরোধের দিন খোলা থাকলেও শিক্ষার্থীদের কোলাহল নেই। মতিঝিল ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুলের অভিভাবক রুকসানা আক্তার বলছিলেন, তাঁর ছেলে নবম শ্রেণীতে উঠেছে। বাসাবো থেকে রাস্তা পার হয়ে স্কুলে পৌঁছতে খুব ঝুঁকি মনে হয়। এ জন্য স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। তিনি বলেন, যেভাবে বোমা হামলা চালানো হয় তাতে ঘর থেকে বের হওয়াই ভয়ের। তেজগাঁও সরকারী বিজ্ঞান কলেজ সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ছে দিলীপ সরকার। বাসা লালমাটিয়া। তার বাবা সুব্রত সরকার রবিবার জনকণ্ঠ অফিসে ফোন করে ক্ষোভের সঙ্গে বলছিলেন, এভাবে হরতাল অবরোধ আর কতদিন চলবে? ভাই আপনাদের কাছে কোন তথ্য আছে বিএনপি নেত্রী কী করতে চান? আমাদের সন্তানরা বিদ্যালয়ে যেতে পারে না। গেলে পথে বোমা হামলা চালান কর্মীদের দিয়ে। নিজেদের সন্তানদের তো দেশের বাইরে নিরাপদে রাখেন। এই অভিভাবকের প্রশ্ন, এর নাম কি আন্দোলন? কোন নেতা মিছিল মিটিং করেন না। ঘরে বসে সন্ত্রাসীদের দিয়ে আমাদের মতো সাধারণ মানুষকে হত্যা করছেন। হরতাল-অবরোধে শিক্ষা কার্যক্রমে মহাসমস্যার সৃষ্টি হয় উল্লেখ করে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক শেখ একরামুল কবীর বলেন, দেশের স্বার্থের কথা বিবেচনায় এনেই সরকার বছরের শুরুতে একটা শিক্ষা ক্যালেন্ডার দিয়েছে এবং সে অনুসারেই পুরো শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। শৃঙ্খলা ভেঙ্গে এর একটিতে ব্যাঘাত সৃষ্টি হলেই সঙ্কটে পড়ে আমাদের লাখো সন্তান। জাতীয় শিক্ষক-কর্মচারী ফ্রন্টের সমন্বয়কারী মোহম্মদ আজিজুল ইসলাম বলেছেন, দেশব্যাপী এভাবে আন্দোলনের নামে নাশকতা কোনক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়। শিক্ষার্থীদের জিম্মি করার অধিকার কোন রাজনৈতিক দলেরই নেই। কিন্তু সরকার কেন বসে আছে? অবিবেচক হরতাল-অবরোধ প্রত্যাহারে প্রায় চার কোটি কোমলমতি শিক্ষার্থীর রাস্তায় নেমে আসা ছাড়া কোন বিকল্প নেই। বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যক্ষ এম এ সাত্তার হতাশা প্রকাশ করে বলেন, এটা কি কোন আন্দোলন? এটা তো সন্ত্রাসী কর্মকা-।
×