ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

উন্নয়ন প্রকল্প প্রতিবন্ধক ॥ পরামর্শকই বাধা

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ১৯ জানুয়ারি ২০১৫

উন্নয়ন প্রকল্প প্রতিবন্ধক ॥ পরামর্শকই বাধা

হামিদ-উজ-জামান মামুন ॥ উন্নয়নে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে পরামর্শক। এ সংক্রান্ত জটিলতায় বাধাগ্রস্ত হচ্ছে প্রকল্পের বাস্তবায়ন। দেশী ও বিদেশী উভয় ক্ষেত্রেই রয়েছে এই সমস্যা। তবে বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট প্রকল্পে এ সঙ্কট প্রকট। এক্ষেত্রে পরামর্শক নিয়োগে দেরি করা এবং অযোগ্য পরামর্শক নিয়োগ দেয়া বা মনের মতো পরামর্শক নিয়োগ না দিলে অর্থায়নে জটিলতার সৃষ্টিসহ দাতাদের পক্ষ থেকে নানা অযুহাতে সমস্যার সৃষ্টি করা হয় বলে জানা গেছে। এ কারণে অনেক ক্ষেত্রেই প্রকল্প ব্যয় ও সময় উভয়েই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা গচ্চা যাওয়ার পাশাপাশি প্রকল্প গ্রহণের প্রকৃত উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক মূল্যায়নে এমনই চিত্র উঠে এসেছে। এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, ভাল পরামর্শক তো পেতে হবে। এখন দ্রুত পরামর্শক নিয়োগ দিতে গিয়ে যদি ভাল পরামর্শক নিয়োগ না দেন, তাহলেও তো প্রকল্পের বাস্তবায়ন দেরি হবে। যে মানের পরামর্শক দরকার তা যদি দেশে পাওয়া না যায় তাহলে বিদেশ থেকে আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে নিতে হয়। এক্ষেত্রে মূল বিষয়টি হচ্ছে যেহেতু আমরা টাকা দেই সরকারকে, তাই পরামর্শক নিয়োগও দেয় সরকার। দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে শুধু ক্লিয়ারেন্স নিতে হয়। এটা শুধু পরামর্শকই নয়, বৈদেশিক সহায়তা অর্থে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পের যে কোন পণ্য ও সেবা ক্রয় করা হোক না কেন, দাতা সংস্থার ক্লিয়ারেন্স লাগে। এক্ষেত্রে কিছুটা সময় লাগে। তবে এ কথাও ঠিক ক্লিয়ারেন্সের ক্ষেত্রে একেক দাতার একেক রকম শর্ত থাকে। শুধু সরকারের ওপর দোষ চাপালেই হবে না, দাতাদের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আছে। যেমন ডিএফআইডির কিছু দাতা আছে তাদের শর্ত হচ্ছে কোন্ দেশ থেকে বা কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে কোন্ কোম্পানির কাছ থেকে পণ্য বা সেবা ক্রয় করতে হবে সেটিও তারা নির্ধারিত করে দেয়। এক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের তেমন কোন শর্ত নেই। কেননা বিশ্বব্যাংক যেহেতু আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা। এ বিষয়ে একে অপরকে দোষারোপ না করে পারস্পরিক সহাযোগিতার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা যায়। সূত্র জানায়, নেদারল্যান্ডসের পরামর্শক নিয়োগে কালক্ষেপণের কারণে বারবার পিছিয়ে যায় পানি সম্পদ রক্ষায় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ১০০ বছরের বদ্বীপ পরিকল্পনা (ডেল্টা প্ল্যান) তৈরির কাজ। তিন দফা সময় পিছিয়েছিল দেশটি। ফলে গুরুত্বপূর্ণ এ পরিকল্পনাটি তৈরির মূল কাজ শুরু করতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষার প্রহর গুনতে হয়েছিল সাধারণ অর্থনীতি বিভাগকে (জিইডি)। ২০১২ সালের জুলাই মাসে এটি তৈরির জন্য পরামর্শক নিয়োগ দেয়ার কথা ছিল নেদারল্যান্ডসের। কিন্তু পরবর্তীতে কোন কারণ ছাড়াই সেটি পিছিয়ে বলা হয়েছিল অক্টোবর মাসে নিয়োগ দেয়া হবে। সেটিও করা হয়নি। পরবর্তীতে ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে নিয়োগ দেয়ার কথা ছিল। সেটিও হয়নি। শেষমেশ নতুন করে সময় দেয়া হয় ফেব্রুয়ারি মাসের ১ তারিখ। এভাবে কয়েক দফা সময় পিছিয়ে পরামর্শক নিয়োগ দেয় নেদারল্যান্ডস। আর এভাবে শুরুতেই গুরুত্বপূর্ণ এ পরিকল্পনা তৈরির প্রক্রিয়া হোঁচট খেয়েছিল। এ বিষয়ে ডেল্টা প্ল্যান তৈরির দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য ড. শামসুল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, পরামর্শক নিয়োগে দেরি হওয়ার কারণে পরিকল্পনা তৈরিতে দেরি হয়েছিল। অবশেষে দেশটির পরামর্শক নিয়োগ দেয়ায় এখন কাজ চলছে। অন্যদিকে পরামর্শক সংক্রান্ত জটিলতায় চরম ভোগান্তিতে পড়েছিল দেশের সর্ববৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্প পদ্মা সেতু। বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতি হয়েছে আর যোগাযোগ মন্ত্রণালয় বলেছিল তাদের পছন্দমতো পরামর্শক নিয়োগ না দেয়ায় তারা এই অযুহাত দাঁড় করিয়েছে। ২০০৯ সালে সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। এ সেতু নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল ২ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে ২০১১ সালের ২৮ এপ্রিল ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার অর্থায়নে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এছাড়া অন্যান্য দাতা সংস্থার মধ্যে ওই বছরের ১৮ মে জাপানের সঙ্গে ৪০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ প্রদান বিষয়ক চুক্তি করে সরকার। ২৪ মে ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের সঙ্গে ১৪ কোটি মার্কিন ডলার সহায়তাবিষয়ক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ৬ জুন এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) সঙ্গে ৪ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকা (৬১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) ঋণ চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এর মধ্য দিয়ে সেতু নির্মাণে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সরকারের সঙ্গে সব উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার ঋণ চুক্তি স্বাক্ষরের প্রক্রিয়া শেষ হয়। এই পর্যায় পর্যন্ত সব চলছিল ঠিকটাক। কিন্তু তারপরই শুরু হয় জটিলতা। পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ এনে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন বাতিল করেছে। পরবর্তীতে নানা শর্তে আবারও ফিরে আসে সংস্থাটি। কিন্তু শর্ত পূরণের নামে কালক্ষেপণ করায় স্বপ্নের এ সেতু নির্মাণ প্রায় অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এ প্রেক্ষাপটে সরকার নিজে থেকেই বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বাতিল করে বর্তমানে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজ চলছে। কাজ শুরু করতে দেরি হওয়ায় বেড়েছে বাস্তবায়ন ব্যয়। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রাক্তন সচিব হাবিব উল্লাহ মজুমদার জনকণ্ঠকে বলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরামর্শ নিয়োগে দেরি হয়। এক্ষেত্রে প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল এবং সময়সাপেক্ষ। দাতারাও বিদেশী পরামর্শক নিয়োগে বিলম্ব করে। অনেক সময় প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা সময় থাকতে পরামর্শক নিয়োগের দরপত্র আহ্বান করে না। এসব নানা কারণে প্রকল্পের বাস্তবায়ন পিছিয়ে যায়। ব্যয় ও সময় উভয়ই বেড়ে যায়। আইএমইডির সর্বশেষ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উন্নয়ন প্রকল্পে বিশেষ করে কারিগরি দিকগুলোর বিষয়ে সমীক্ষা পরিচালনা এবং পরামর্শ দেয়ার জন্য অনেক প্রকল্পে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি নিয়োগের প্রয়োজন হয়। সে অনুযায়ী উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) সংস্থান রাখা হয়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই পরামর্শক নিয়োগে বিলম্বের কারণে প্রকল্প বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হয়। প্রতিবেদন প্রকাশের সময় বলা হয়েছিল পরামর্শক নিয়োগে জটিলতার কারণে কয়েকটি প্রকল্প অর্থছাড় ও ব্যয় নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম হয়েছে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্প (দ্বিতীয় পর্যায়)। শুধুমাত্র পরামর্শক নিয়োগে দেরি হওয়ার কারণে প্রকল্পটির বাস্তবায়নকাল শেষ পর্যায়ে এলেও গুরুত্বপূর্ণ নির্মাণ কাজ শুরু করা যায়নি। ফলে প্রকল্প সংশোধন করতে হয়েছে এবং বাস্তবায়ন ব্যয়ও বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া আরও যেসব প্রকল্পের ক্ষেত্রে এ রকম ঘটনা ঘটেছে সেগুলো হচ্ছে, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ প্রকল্প, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ইমার্জেন্সি ২০০৭ সাইক্লোন রিকভারি এ্যান্ড রেস্টোরেশন প্রজেক্ট, স্থানীয় সরকার বিভাগের ঢাকা পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন প্রকল্প ও আরবান পাবলিক এ্যান্ড হেল্থ সেন্টার ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট ও টেকনিক্যাল এ্যান্ড ভোকেশনাল এডুকেশন এ্যান্ড ট্রেনিং রিফর্ম ইন বাংলাদেশ প্রজেক্ট, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের এস্টাবলিশমেন্ট অব সাসেক ইনফরমেশন হাইওয়ে প্রজেক্ট এবং ডেভেলপমেন্ট অব ন্যাশনাল আইসিটি ইনফ্রা-নেটওয়ার্ক ফর বাংলাদেশ প্রজেক্ট। তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্প-১ম পর্যায় ১৯৮০ থেকে ১৯৯৮ সময়ে বাস্তবায়িত হওয়ায় রংপুর, নীলফামারী ও দিনাজপুর জেলার ১২টি উপজেলায় ১ লাখ ৫৪ হাজার হেক্টর এলাকা সেচের অন্তর্ভুক্ত হয়। পরবর্তীতে কমান্ড এরিয়া উন্নয়ন নামে আরও একটি প্রকল্প ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত বাস্তবায়িত হওয়ার ফলে ১৯৯৩ সাল থেকে সীমিত সেচ সুবিধাসহ হালনাগাদ ৯১ হাজার ২৬৬ হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা দেয়া সম্ভব হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্প (দ্বিতীয় পর্যায়) গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ের এ প্রকল্পটি তিনটি ইউনিটে বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নেয়া হয়। এর মধ্যে প্রথম ইউনিটকে প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করে ২০০৬ সাল থেকে ২০১০ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ অংশের ব্যয় ধরা হয় ২২৭ কোটি ২১ লাখ টাকা। ২০০৩ সালের ১২ জুলাই এটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় (একনেক) অনুমোদন লাভ করে। তার পর প্রকল্পের ব্যয় ও মেয়াদ বৃদ্ধি করে প্রথম সংশোধন করা হয়। ২০০৯ সালের ২৬ জানুয়ারি সংশোধন প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। এ পর্যায়ে বাস্তবায়নকাল ছিল ২০১১ সালের জুন পর্যন্ত। পরবর্তীতে আবারও দ্বিতীয় সংশোধনীর উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল বলে জানা গেছে। এ প্রকল্পটি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নানা সমস্যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পরামর্শক নিয়োগে অস্বাভাবিক বিলম্ব। প্রকল্পের আওতায় বেশিরভাগ সেচ খাল ও সেকেন্ডারি সেচ খালের এলাইনমেন্ট নির্ধারণ, অবকাঠামো ডিজাইন প্রণয়নসহ ইত্যাদি কাজের জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গাণিতিক মডেল স্টাডি ও টপোগ্রাফিক্যাল সার্ভে ফলাফলের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু এই কাজের জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগে অস্বাভাবিক সময় লেগে যায়। পরামর্শক জটিলতা সম্পর্কে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য ড. শামসুল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, দেশী পরামর্শক নিয়োগের ক্ষেত্রে জটিলতা হলে তা সমাধান করা সহজ হয়। কিন্তু বিদেশী পরামর্শকের ক্ষেত্রে সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকে না। দাতারা পরামর্শক নিয়োগ বিষয়ে নানা টালবাহানা করে। কোন কারণ ছাড়াই এটি করে। অনেক সময় তারা বলে থাকে, তাদের দেশের পার্লামেন্টে এ বিষয়ে অনুমতি নিতে হবে। এ রকম নানা কথা বলে। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়ন পিছিয়ে যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা যায় প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষর হয়েছে তারপরই দাতারা বলছে এটা পরিবর্তন করতে হবে, ওটা পরিবর্তন করতে হবে। তখন হতবাক হওয়া ছাড়া কিছুই করার থাকে না। এ রকম নানা জটিলতা রয়েছে।
×