ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

এখন দুর্লভ

ছুঁয়ে দিলেই লাজে মরি- রোমান্টিক লজ্জাবতী

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ১৮ জানুয়ারি ২০১৫

ছুঁয়ে দিলেই লাজে মরি- রোমান্টিক লজ্জাবতী

মোরসালিন মিজান ॥ সে কী লজ্জা! একটু ছুঁয়ে দিলেই হলো। একটু। অমনি মূর্ছা যায়। ভেঙে পড়ে যেন। নতুন বউয়ের মতো গুটিয়ে নেয় নিজেকে। এ জন্য গাছটির নাম লজ্জাবতী। ছোটরা তো বটেই, বড়রাও এর পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় আলতো করে ছুঁয়ে দেন। এর পর শুধু তাকিয়ে থাকা কাজ। হ্যাঁ, চোখের সামনেই লাজে মরে লজ্জাবতী। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে মোটামুটি মাটির সঙ্গে মিশে যায়। অদ্ভুত রোমান্টিক লজ্জাবতী এক সময় সারাদেশে দেখা যেত। এখন দুর্লভ। লজ্জাবতীর ইংরেজী নাম মিমোশা। কাকতালীয়ভাবে হলেও সত্য, মিমোশা মেয়েদের নাম। কেউ ভাবতেই পারেন, লজ্জাবতী এ কারণেই মেয়েদের মতো লাজুক স্বভাবের। আসলে গাছের এটি বৈশিষ্ট্য। উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মিমোশা প্রায় ৪শ’ প্রজাতির গুল্ম ও লতার একটি গণ (জেনাস)। এটি লেগিউম জাতীয় ফ্যাবায়েসি পরিবারের এবং মিমোসয়ডিয়া উপ-পরিবারের সদস্য উদ্ভিদ। লজ্জাবতীর সবচেয়ে পরিচিত প্রজাতিটির নাম মিমোশা পুডিয়া। লজ্জাবতীর আদি নিবাস মধ্য আমেরিকায়। বহুকাল ধরে বাংলাদেশে আছে। প্রায় সকল লজ্জাবতীর কান্ড- সরু কাঠির মতো। অপেক্ষাকৃত শক্ত। এর অনেক শাখা-প্রশাখা। পাতা যৌগিক। দুই সারি পত্রক বিদ্যমান। দেখতে অনেকটা তেঁতুল পাতার মতো। অক্টোবর থেকে ফুলও আসে। গোলাপি এবং সাদা রঙের ফুল দেখতে খুবই সুন্দর। ধীরে ধীরে সে ফুল থেকে এক ধরনের ফল হয়। লজ্জাবতী শুধু মানুষের স্পর্শে নয়, যে কোন ধরনের স্পর্শে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। একটির সঙ্গে বিপরীত পাশেরটি আঠার মতো লেগে যায়। আলিঙ্গনের মুহূর্ত শেষ হতে সময় লাগে কয়েক মিনিট। এ রহস্যের কারণেই গাছটিকে বলা হয় লজ্জাবতী। লজ্জাবতীর লজ্জার রহস্য জানতে চাইলে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক পরিমল কান্তি বিশ্বাস বলেন, লজ্জাবতী মারাত্মক অনুভূতিপ্রবণ। মূলত এ কারণেই ছুঁয়ে দিলে এত কা- ঘটে যায়। লজ্জাবতী গাছের পাতার গোড়ার অংশের কোষগুলো পানিতে পূর্ণ থাকে। এ কারণে সেগুলো বেশ ফোলা দেখায়। কিন্তু ডাঁটাগুলো হয় সরল ও সোজা। আঙুল দিয়ে পাতা সামান্য ছুঁয়ে দিলে গাছের পুরো শরীরে মৃদু তড়িত প্রবাহ ছড়িয়ে পড়ে। এর প্রভাবে পাতার গোড়ার ফোলা অংশ থেকে পানি বেরিয়ে বোঁটার দিকে নেমে যায়। আর পাতার কোষগুলোয় জলের পরিমাণ কমে যাওয়ার কারণে তা কুঁচকে যায়। নুয়ে পড়ে। তাপের প্রভাবে ও সন্ধ্যার পর নিজেকে গুটিয়ে নেয় লজ্জাবতী। মজার ব্যাপার হচ্ছে, লজ্জায় মরি মরি গাছের প্রাণ বড় শক্ত। আগাছার মতো হওয়ায় অনেকে একে পায়ে মাড়িয়ে যান। কিন্তু গাছটি সহজে মরে না। বরং নিশ্চিহ্ন অবস্থা থেকেও যৌবনে প্রবেশ করতে জানে। একইভাবে অনেক প্রতিকূল পরিবেশে এটি জন্মাতে পারে। কোন রোগ বা পোকা একে কাবু করতে পারে না। উদ্ভিদবিদ দ্বিজেন শর্মা জানান, দেশে লজ্জাবতীর দু’টি জাত রয়েছে। একটি দেশীয়। অন্যটি থাই লজ্জাবতী। দেশীয় লজ্জাবতীর বৃদ্ধি কম। এটি ৩ থেকে ৭ ফুট লম্বা হয়। গায়ে সূক্ষ্ম কাঁটার অস্তিত্ব দেখা যায়। অন্যদিকে থাই লজ্জাবতী গাছে কোন কাঁটা হয় না। এটি দ্রুত বাড়ে। গাছ প্রায় ৩ থেকে ১০ ফুট লম্বা হয়। গাছ নরম ও রসালো বলে দ্রুত পচে যায়। ফলে এ জাতীয় লজ্জাবতী থেকে প্রচুর জৈবসার পাওয়া যায়। এই জৈবসার থেকে পুষ্টি সংগ্রহ করতে পারে অন্য গাছ। বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায়, থাই লজ্জাবতীতে ২.০৩ থেকে ২.৬ ভাগ নাইট্রোজেন, ০.১৭৫ থেকে ০.২৩ ভাগ ফসফরাস এবং ১.২৩৭ থেকে ১.৭৪১ ভাগ পর্যন্ত পটাশিয়াম থাকে। এসব কারণে জমিতে জৈবসারের গুরুত্বপূর্ণ উৎস ভাবা হয় থাই লজ্জাবতীকে। ফসলের জমিতে এ সার ব্যবহার করে ভাল ফল পাওয়া সম্ভব। বিদেশে ভুট্টা ও বাজরার জমিতে এই জৈব সার ব্যবহার হয়। বাংলাদেশেও লজ্জাবতী থেকে জৈবসার তৈরি ও ব্যবহারের কাজ শুরু হয়েছে। জমিতে সবুজ সার হিসেবে ব্যবহৃত ধৈঞ্চার পরিবর্তে লজ্জাবতী গাছ সবুজসার হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে বলেও জানা যায়। এ ছাড়া বাণিজ্যিক আম বাগানের জমিতে লজ্জাবতীর গাছ লাগিয়ে ঢেকে ফেলতে পারলে আর ক্ষতিকর আগাছা জন্মাতে পারে না। লজ্জাবতী গাছের শিকড়ে জন্মানো লালচে রঙের নডিউল বা গুটি বাতাস থেকে নাইট্রোজেন সঞ্চয় করে আম বাগানের মাটিতে সরবরাহ করে। এর ফলে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়। ধানি জমির ফসল ঘরে তোলার পর মার্চ- এপ্রিল মাসে একটি চাষ দিয়ে লজ্জাবতীর বীজ ছিটিয়ে দেয়া যায়। বীজ গজানোর পর বৃষ্টি পেয়ে গাছ দ্রুত বাড়তে থাকে। এক সময় জমিকে ঢেকে ফেলে। ফুল বা কুঁড়ি আসার আগ পর্যন্ত যে কোন সময় এ নরম গাছ কুচি কুচি করে কেটে জমিতে আবার চাষ দিয়ে মিশিয়ে দিলে জমির জৈবসারের চাহিদা পূরণ করে। তবে লজ্জাবতীর বেলায় আর সব আলোচনা যেন গৌন। বৃথা। লজ্জাবতী যেহেতু, ঘুরে-ফিরে আসে লজ্জার প্রসঙ্গটি। লজ্জা মানে, লাজ। এমন অদ্ভুত লাজ-বিরল রোমান্টিকতা আর কোন গাছ ধারণ করে না। এ শুধু লজ্জাবতী জানে।
×