ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

খালেদা নমনীয় হলেও তারেক কঠোর

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ১৮ জানুয়ারি ২০১৫

খালেদা নমনীয় হলেও তারেক কঠোর

শরীফুল ইসলাম ॥ টানা অবরোধে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় নানামুখী চাপের মুখে বিএনপি। এখন পর্যন্ত দাবি আদায়ের ব্যাপারে সরকারের তরফ থেকে কোন আশ্বাস না পাওয়ায় উভয় সঙ্কটে পড়েছে দলটি। না পারছে কর্মসূচী স্থগিত করতে আবার জনরোষে পড়ার ভয়ে না পারছে বেশিদিন তা চালিয়ে যেতে। আর আন্দোলনের কৌশল নিয়ে কিছু সিদ্ধান্ত আসছে চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার কাছ থেকে আর কিছু সিদ্ধান্ত আসছে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছ থেকে। বাস্তবতার আলোকে খালেদা জিয়া কিছুটা নমনীয় হতে চাইলেও তারেক রহমানের কঠোর অবস্থানের কারণে তাকেও অবস্থান পরিবর্তন করতে হচ্ছে। তবে শেষ পর্যন্ত তারা কি করবে এ দু’জন ছাড়া দলের অন্য কেউ জানেন না। সূত্র মতে, বিএনপি মনে করেছিল টানা অবরোধ কর্মসূচী চালিয়ে গেলে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন মহলের চাপে সরকার বিএনপির প্রতি নমনীয় হয়ে ইতিবাচক কোন পদক্ষেপ নেবে। কিন্তু দিন যত যাচ্ছে সরকারও ততই কঠোর হচ্ছে। আর টানা অবরোধ কর্মসূচী পালন করতে গিয়ে দেশকে দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির সম্মুখীন করায় ইতোমধ্যেই বিভিন্ন মহল থেকে চাপের মুখে পড়েছে বিএনপি। আবার কর্মসূচী সফল করতে দলের সিনিয়র নেতারা মাঠে না থাকায় তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। তবে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান অনড় অবস্থানে থাকায় কেন্দ্রীয় নেতাদের মতো তৃণমূল নেতাকর্মীরা মাঠ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন না। এ পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়া নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন ইস্যুতে সরকারের কাছ থেকে আলোচনার আশ্বাস না পাওয়া পর্যন্ত অবরোধ কর্মসূচী চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত দলের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের জানিয়েছেন। তবে তারেক রহমানের সিদ্ধান্ত হচ্ছে প্রয়োজনে আরও কঠোর কর্মসূচী পালন করতে হবে। সূত্র মতে, তারেক রহমান তার অনুসারীদের জানিয়েছেন আন্দোলনে বিজয় অর্জনের জন্য অবরোধে কাজ না হলে লাগাতার হরতাল ও অসহযোগ কর্মসূচী পালন করতে হবে। ইতোমধ্যেই তারেক রহমান তার অনুসারীদের এ সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন। তবে বিভিন্ন মহলের চাপ সহ্য করে আর কতদিন বিএনপি কঠোর অবস্থানে থেকে আন্দোলন চালিয়ে যেতে পারবে এ ব্যাপারে দলের অনেক সিনিয়র নেতাই অন্ধকারে রয়েছেন বলে জানা গেছে। জানা যায়, আজ বিশ্ব এজতেমা শেষে বিএনপির আন্দোলনে মোড় ঘুরতে পারে। সরকারের তরফ থেকে আলোচনার উদ্যোগ অথবা সভা-সমাবেশে আর বাধা দেবে না এমন আশ্বাস পেলে আপাতত কঠোর অবস্থান থেকে সরে এসে পরে আবার দুর্বার আন্দোলনে যেতে চান খালেদা জিয়া। বিএনপিপন্থ’ী বুদ্ধিজীবীরাও খালেদা জিয়ার এ অবস্থানের পক্ষে। আর তারেক রহমান চান সরকারকে আর সময় না দিয়ে নির্দলীয় সরকারের দাবিকে একদফা দাবিতে পরিণত করতে। সে ক্ষেত্রে জানমালের ক্ষয়ক্ষতির দায় নিজেরা না নিয়ে সরকারের ওপরই চাপানোর কৌশলও নিতে চান তিনি। দলের তারেক অনুসারীরাও তার পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়েছেন। প্রসঙ্গত, ৫ জানুয়ারিকে ‘গণতন্ত্রের জন্য কালো দিবস’ হিসেবে পালন করতে ওইদিন রাজধানীতে সমাবেশ করতে চেয়েছিল বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। কিন্তু সরকার নিষেধাজ্ঞা জারি করায় সমাবেশ করতে পারেনি তারা। আর আগে বের না হলে ৫ জানুয়ারি খালেদা জিয়াকে গুলশানের বাসা থেকে বের হতে দেবে না এমন আশঙ্কা থেকে ২ দিন আগে অর্থাৎ ৩ জানুয়ারি রাতেই গুলশানের দলীয় কার্যালয়ে অবস্থান নেন তিনি। কিন্তু সমাবেশ করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারির পর ৫ জানুয়ারি বিকেলে বের হওয়ার জন্য গাড়িতে চড়ে বসলে গুলশান কার্যালয় থেকেও পুলিশ বের হতে দেয়নি খালেদা জিয়াকে। এক পর্যায়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে থাকা মহিলা দলের নেতাকর্মীরা সরকারবিরোধী সেøাগানে মুখরিত হয়ে লাথি মেরে তালাবদ্ধ গেট ভাঙ্গার চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের ওপর পিপার স্প্রে মারে। এর কিছুক্ষণ পর খালেদা জিয়া গাড়ি থেকে নেমে ওখানে দাঁড়িয়েই ৬ জানুয়ারি থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য অবরোধ কর্মসূচীর ডাক দেন। এরপর থেকে অবরোধ কর্মসূচী চলাকালে প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও প্রাণহানি ঘটার পাশাপাশি বোমা বিস্ফোরণ, যানবাহন ভাংচুর ও জ্বালাও-পোড়াওসহ নাশকতামূলক কর্মকা- হচ্ছে। সূত্র মতে, দলের অনেক সিনিয়র নেতা আন্দোলন পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে বলতে না পারলেও তারেক অনুসারীরা অন্য নেতাকর্মীদের কাছে বলছেন প্রয়োজনে রাজধানীসহ সারাদেশে আরও কঠোর আন্দোলন। টানা কয়েক মাস রাজপথে থেকে হলেও দলের জন্য কিছু অর্জন করেই মাঠ ছাড়তে হবে। তাদের মতে, বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগও ৯৬ সালে হরতাল-অবরোধের ধারাবাহিক কর্মসূচী পালন করেছিল। তারা বঙ্গভবনের অক্সিজেনও বন্ধ করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আন্দোলনে বিজয়ের পর আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় গিয়েছে তখন জনগণ এসব ভুলে গেছে। গত ১৩ দিনের অবরোধ কর্মসূচীতে কেন্দ্রীয় নেতারা মাঠে না থাকলেও কোন কোন কেন্দ্রীয় নেতা বিদেশী কূটনীতিকদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে বিএনপির দাবি ও আন্দোলনের পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করছেন। সম্প্রতি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খানের বাসায় ৯ দেশের কূটনীতিকদের জড়ো করে দলের নেতারা তাদের কাছে বিএনপির অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। এ সময় দলের নেতা ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান ও রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু ছিলেন। আর বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করে দলের নেতা ড. ওসমান ফারুক ও সাদেক হোসেন খোকা বিভিন্ন মহলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। এদিকে অবরোধ কর্মসূচী সফল করতে কেন্দ্রীয় নেতারা মাঠে না থাকলেও কিছু তৃণমূল নেতাকর্মী ঠিকই জীবন বাজি রেখে রাজপথে নামছেন। এজন্য বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া গুলশান কার্যালয়ে অবস্থান করেই প্রতিদিন ফোনে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাদের উৎসাহ দিচ্ছেন বলে জানা গেছে। আর লন্ডন থেকে ফোনে তারেক রহমানও তার কিছু অনুসারীর মাধ্যমে আন্দোলন চাঙ্গা করার চেষ্টা করছেন। তবে এবারের আন্দোলনে সরাসরি খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের খোঁজখবর রাখার বিষয়টি ইতিবাচক ফল বয়ে নিয়ে এসেছে বলে জানা গেছে। উল্লেখ্য, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর মার্চ ফর ডেমোক্রেসি কর্মসূচী পালনের ঘোষণা দিলেও শেষ পর্যন্ত তা করতে পারেনি বিএনপি। বিএনপির সিনিয়র নেতারা আত্মগোপনে চলে যাওয়া এবং খালেদা জিয়া নিজে গুলশানের বাসায় আটকে পড়ায় তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা নিজ নিজ জেলায় কর্মসূচীর পক্ষে অবস্থান নিলেও রাজধানীর রাজপথ নেতাকর্মী শূন্য থাকায় সেবার আন্দোলন মাঠে মারা যায়। সেই অভিজ্ঞতার আলোকেই এবার বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া আগেভাগেই বাসা থেকে বের হয়ে দলের গুলশান কার্যালয়ে অবস্থান নিয়েছেন। আর গুলশান অফিসে থেকেই তিনি প্রতিদিন আন্দোলনের মাঠে থাকা দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। আর তৃণমূল নেতাকর্মীদের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আশ্বাসের প্রেক্ষিতেই খালেদা জিয়া এখনও অনড় অবস্থান ধরে রাখতে পেরেছেন। তবে এজতেমা শেষে সরকার আরও কঠোর অবস্থানে গেলে আন্দোলনের ভবিষ্যত কি হবে তা নিয়েও খালেদা জিয়ার ভাবনার শেষ নেই বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। অবরোধে সহিংসতার ফলে জানমালে যে ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে সেটিও খালেদা জিয়াকে ভাবনায় ফেলেছে বলে জানা গেছে। এ জন্যই মানুষের প্রাণহানির ঘটনায় প্রতিদিন বিএনপি পক্ষ থেকে শোক ও সমবেদনা জানানো হচ্ছে। সম্প্রতি গণমাধ্যমে পাঠানো বিএনপির এক বিবৃতিতে বলা হয়, অবরোধ-আন্দোলনে মানুষের কষ্ট, দুর্ভোগ ও ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপারে বিএনপি সহানুভূতিশীল ও সজাগ। তবে সরকারের নেতিবাচক কর্মকা- অবসানের জন্য ধৈর্য ধরে সাময়িক কষ্ট স্বীকারের জন্যও দলের পক্ষ থেকে দেশবাসীকে অনুরোধ জানানো হয়। এ ব্যাপারে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া বলেন, বিএনপি কতদিন মাঠে থাকবে তা নির্ভর করছে সরকারের ওপর। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। বিএনপির আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান বলেন, আন্দোলন-সংগ্রাম গণতান্ত্রিক অধিকার। সরকার দাবি মেনে নিলে আমাদের আর আন্দোলনের প্রয়োজন পরে না।
×