ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

যে কোন সময় বড় ধরনের ভূমিকম্প

প্রকাশিত: ০৭:২৭, ১৭ জানুয়ারি ২০১৫

যে কোন সময় বড় ধরনের ভূমিকম্প

শাহীন রহমান ॥ দেশের অধিকাংশ এলাকাই ভূমিকম্প ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, আগামী দিনগুলোয় এ ঝুঁকি আরও বাড়বে। বিশেষ করে ১৯৬০ সালের পর থেকেই দেশে ভূমিকম্পের হার বেড়েছে। মাত্রা না বাড়লেও এ সময়ের মধ্যে স্বল্পমাত্রায় অনেক বেশি ভূমিকম্প সংঘঠিত হয়েছে। দেশ যে বড় ধরনের ভূমিকম্পের সম্মুখীন এ বিষয়ে কোন বিশেষজ্ঞের দ্বিমত নেই। যে কোন সময় ৮ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে। আর এটা হলে বড় ধরনের বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হবে মূলত অবকাঠামোগত কারণে। ফলে এখন থেকে ভূমিকম্প মোকাবেলায় প্রস্তুতি নিতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের চারপাশে ভারতের আসাম, বিহার ও মিয়ানমারের বর্মা এলাকা ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা হওয়ায় সারা বাংলাদেশই কোন না কোনভাবে ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। তবে সাম্প্রতিককালে বুয়েট কর্তৃক প্রণীত ম্যাপে বাংলাদেশের ৪৩ ভাগ এলাকাকে উচ্চ ভূমিকম্পন ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ ম্যাপে দেশের ৪১ ভাগ এলাকাকে মধ্যম ঝুঁকি এবং মাত্র ১৬ ভাগ এলাকাকে ভূমিকম্পের নিম্ন ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই ম্যাপে দেশের সিলেট অঞ্চলকে সবচেয়ে ভূমিকম্প ঝুকিপূর্ণ এলাকা বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। এছাড়াও পঞ্চগড়, রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, জামালপুর, শেরপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট, হবিগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও কক্সবাজারের অংশবিশেষ উচ্চ ঝুঁকির তালিকায় চিহ্নিত করা হয়েছে। রাজশাহী, নাটোর, মাগুরা, মেহেরপুর, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফেনী এবং ঢাকাকে মধ্যম ঝুঁকি এলাকা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া বরিশাল, পটুয়াখালী এবং সব দ্বীপ ও চর এলাকাকে নিম্ন ঝুঁকি এলাকা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু দেশের কোন এলাকাকে ভূমিকম্প ঝুঁকিমুক্ত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়নি। অথচ ১৯৯৩ সালে প্রণীত ভূমিকম্পের যে জোনিং ম্যাপ তৈরি করা হয় সেখানে দেশের মাত্র ২৬ ভাগ এলাকাকে উচ্চ ভূমিকম্প ঝুঁকিপ্রবণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ম্যাপে ৩৮ ভাগ এলাকাকে মধ্যম ঝুঁকি এবং ৩৫ ভাগ এলাকাকে নিম্ন ঝুঁকি তালিকায় স্থান দেয়া হয়। কিন্তু ১৯৬০ সালের পর ভূমিকম্প বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের ঝুঁকিপ্রবণ এলাকা বেড়ে গেছে বলে বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন। আগামী দিনে এ ঝুঁকি আরও বাড়বে বলে তারা উল্লেখ করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ন আকতার বলেন, বাংলাদেশ যে অধিক ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তিনি বলেন, ভূমিকম্প হলো এমন এক দুর্যোগ যার কোন আগাম পূর্বাভাস নেই। এ কারণে সব সময় ঝুঁকি মোকাবেলায় প্রস্তুতি থাকতে হবে। তিনি বলেন, ঢাকা শহরের যে ধরনের অবকাঠামো রয়েছে তাতে দেশের অভ্যন্তর যে কোন চ্যুতিরেখা থেকে একবার বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। এ কারণে ঢাকার ভবনগুলোকে ঝুঁকিমুক্ত করতে রেক্টফিটিং পদ্ধতি ব্যবহার করে ঝুঁকিমুক্ত করতে হবে। তা না হলে বিপর্যয় ঠেকানো যাবে না বলে উল্লেখ করেন তিনি। দেশের ভেতরে ও পার্শ্ববর্তী এলাকার বিগত প্রায় ২শ’ ৫০ বছরের ভূমিকম্পের নথিভুক্ত তালিকায় দেখা গেছে, ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে ২০০৪ পর্যন্ত বাংলাদেশে সংঘটিত হয়েছে ১শ’রও বেশি ভূমিকম্প। এরমধ্যে ৬৫টিরও বেশি ঘটেছে ১৯৬০ সালের পরে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী জানুয়ারি ২০০৬ থেকে মে ২০০৯ পর্যন্ত চার বছরে রিখটার স্কেলে ৪ মাত্রার ৮৬টি ভূকম্পন নথিভুক্ত করা হয়। এই সময়ের মধ্যে ৫ মাত্রার চারটি ভূকম্পনও ধরা পড়ে। আবহাওয়া অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী মে ২০০৭ থেকে জুলাই ২০০৮ পর্যন্ত কমপক্ষে ৯০টি ভূকম্পন নথিভুক্ত করা হয়। এরমধ্যে নয়টিরই রিখটার স্কেলে মাত্রা ছিল ৫-এর উপরে। সেগুলোর ৯৫ ভাগের উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকা শহরের ৬০০ কিলোমিটারের মধ্যে। অতীতের এসব রেকর্ড থেকে দেখা যায়, ভূমিকম্পের মাত্রা না বাড়লেও ১৯৬০ সালের পর থেকে ভূমিকম্প সংঘটনের হার বেড়েছে। অর্থাৎ ঘন ঘন স্বল্পমাত্রার ভূমিকম্প বেশি ঘটছে। মতবিরোধ থাকলেও অনেক ভূতাত্ত্বিক ছোট ছোট ভূমিকম্প সংঘটনকে বড় ধরনের ভূমিকম্পের পূর্বাভাস বলে উল্লেখ করেছেন। অতীতের এসব রেকর্ডকে প্রাধান্য দিয়ে বিশেষজ্ঞ ও গবেষকরা একটি বিষয়ে একমত যে, যে কোনো সময় দেশে রিখটার স্কেলে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে। ভূমিকম্পের রেকর্ডে দেখা গেছে, বিগত শতাব্দীতে দেশের অভ্যন্তর থেকে বড় মাত্রার বেশকিছু ভূমিকম্প উৎপত্তি হয়েছে। সে সময়ে ভূমিকম্পের ফলে ভূপ্রকৃতিগতভাবে ক্ষতি সাধিত হলেও দেশে অবকাঠামোগত উন্নতি না হওয়ায় বড় ধরনের বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়নি। কিন্তু বর্তমানের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এ কারণে ঝুঁকি বাড়ছে। ভূমিকম্পের এসব রেকর্ডে দেখা গেছে, ১৮৮৫ সালের জুলাইয়ে ৭ মাত্রার বেশি ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। এ ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল মানিকগঞ্জের কাছে। এরপর ১৯১৮ সালের ৮ জুলাই দেশের শ্রীমঙ্গল এলাকা থেকে আরেকটি বড় মাত্রার ভূমিকম্প সংঘটিত হয়, রিখটার স্কেলে যার মাত্রা ছিল ৭.৬। ১৯৩০ সালের ২ জুলাই আসামের ধুবড়ি এলাকা থেকে আরেকটি বড় মাত্রার ভূমিকম্প সংঘটিত হয়, যারা মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৭। ১৯৩৪ সালে ভারতের বিহারে ৮.৩ মাত্রার ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। একই বছরের ৩ জুলাই আসামে আরও একটি ভূমিকম্প হয়, যার মাত্রা ছিল ৭.১। ১৯৫০ সালের ১৫ আগস্ট আসামে ৮.৩ মাত্রার আরেকটি ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। ১৯৯৭ সালের ২২ নবেম্বর বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে উৎপত্তি হয় ৬ মাত্রার ভূমিকম্প। ১৯৯৯ সালে মহেশখালী থেকে ৫.২ মাত্রার ভূমিকম্প রেকর্ড করা হয়। এছাড়াও ২০০২ সালে দেশের চট্টগ্রাম অঞ্চলে ছোটখাটো প্রায় ৪০ বার ভূমিকম্প হওয়ার রেকর্ড রয়েছে তালিকায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চল ভূমিকম্পজনিত কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে। কারণ সিলেট-সুনামগঞ্জ ও ভারতের শিলংকে বিভক্ত করেছে ডাওকি নদী। আর এই ডাওকি নদী ডাওকি চ্যুতি বরাবর অবস্থান করছে। আর ভূতাত্ত্বিক চ্যুতিগুলোই বড় ধরনের ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল। সিলেটের সীমান্ত এলাকাবর্তী এ ধরনের চ্যুতিগুলোর কোন কোনটিতে সাব-ডাউন ফল্ট রয়েছে, যেগুলো থেকে ভূমিকম্প ঘটালে বড়লেখার পাথারিয়া পাহাড় সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ডাউকি চ্যুতি রেখার বিস্তৃতি পূর্ব-পশ্চিমে ৩শ’ কিলোমিটার। ডাউকির নামকরণ করা হয়েছে মেঘালয়ের একটি শহরের নাম থেকে। এছাড়া দেশের ভেতরে মধুপুর চ্যুতিরেখা, চট্টগ্রাম মিয়ানমার সাবডাকশন ভূচ্যুতিসহ বেশকিছু চ্যুতিরেখা সক্রিয় রয়েছে। অন্যান্য চ্যুতিরেখার মধ্যে রয়েছেÑ বগুড়া চ্যুতি এলাকা, রাজশাহীর তানোর চ্যুতি এলাকা, ত্রিপুরা চ্যুতি এলাকা, সীতাকু--টেকনাফ চ্যুতি এলাকা, হালুয়াঘাট চ্যুতির ডাওকি চ্যুতি এলাকা, ডুবরি চ্যুতি এলাকা, চট্টগ্রাম চ্যুতি এলাকা, সিলেটের শাহজীবাজার চ্যুতি এলাকা এবং রাঙ্গামাটির বরকলে রাঙ্গামাটি চ্যুতি এলাকা। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশ ভারতীয়, ইউরেশীয় এবং বার্মার (মিয়ানমার) টেকটনিক প্লেটের মধ্যে অবস্থান করছে। ভারতীয় এবং ইউরেশীয় প্লেট দুটি দীর্ঘদিন যাবত হিমালয়ের পাদদেশে আটকা পড়ে আছে। ফলে অপেক্ষা করছে বড় ধরনের কম্পনের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব না হলেও পরিকল্পনা, প্রস্তুতি ও দক্ষতার মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমানো সম্ভব। দুর্যোগের ধরন ও বিস্তৃতির ওপর নির্ভর করে ক্ষতির পরিমাণ কম-বেশি হয়। এছাড়াও ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণের জন্য নিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর পর্যবেক্ষণের ওপরও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ভর করে। তাঁদের মতে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থা, রাস্তাঘাট, চিকিৎসা সুবিধাদি নিশ্চিত করতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিশেষ করে সুনামি ও ভূমিকম্পের ওপর মানুষকে দক্ষতা অর্জন করতে হবে। জাপানের টোকিও ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির সহায়তায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগ কর্তৃক পরিচালিত এক সাম্প্রতিক (২০১০) গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার ভূমিতে বিভিন্ন প্রকারের মাটি (লাল মাটি, নরম মাটি) রয়েছে। ঢাকার সম্প্রসারিত অংশে জলাশয় ভরাট করে গড়ে তোলা আবাসন এলাকা রয়েছে। ভূমিকম্পের সময় নরম মাটি ও ভরাট করা এলাকার মাটি ভূমিকম্পের কম্পন তরঙ্গকে বাড়িয়ে দেয়। ফলে ভূমিকম্পের তীব্রতা বাড়ে। মাটির বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে যোগ হয় ভবনের বা স্থাপনার কাঠামো। এই দুইয়ের সমন্বয়ে ভূমিকম্পের তীব্রতা ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ভর করে। গবেষকরা তাই ঢাকার বর্ধিতাংশের আলগা মাটিসমৃদ্ধ জনবসতিকে যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছেন। ভূমিকম্প মোকাবেলায় এখনই প্রস্তুতি না নিলে এ ধরনের দুর্যোগ রোধ করা কঠিন হয়ে পড়তে পারে বলে উল্লেখ করেন।
×