ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সাতক্ষীরায় ল্যাকটেটিং মাদার সহায়তা প্রকল্প

তদারকি না থাকায় সরকারী সাহায্যের সুফল মিলছে না

প্রকাশিত: ০৭:১২, ১৭ জানুয়ারি ২০১৫

তদারকি না থাকায় সরকারী সাহায্যের সুফল মিলছে না

মিজানুর রহমান, সাতক্ষীরা ॥ শিশু ও গর্ভবতি মায়েদের অপুষ্টি রোধে সরকারের নেয়া ‘কর্মজীবী ল্যাকটেটিং মাদার সহায়তা প্রকল্পে’ আর্থিক সাহায্য পাওয়ার পরও এসব মায়েদের শিশুরা অপুষ্টিতে ভুগছে। দুই বছর ধরে সরকারী সহায়তা পেলেও এসব মায়েদের শিশুরা অপুষ্টিতে আক্রান্ত হয়ে ভুগছে নিমুনিয়া, জন্ডিস, সর্দি জ্বরসহ নানা রোগে। আর্থিক সহায়তা পরবর্তী কোন মনিটরিং ব্যবস্থা না থাকায় এসব পরিবারের শিশুরা কেমন থাকছে, এমন কোন তথ্য নেই সরকারী ও সংশ্লিষ্ট এনজিও দফতরে। অনেক পরিবারে সহায়তা পাওয়া এসব টাকা সংসারের প্রয়োজনে স্বামীর হাত দিয়ে খরচ হচ্ছে অন্য খাতে। এনজিওদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এসব মায়েদের স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়লেও সহায়তা পরবর্তী তদারকির ব্যবস্থা না থাকায় সরকারের এই প্রকল্পের শতভাগ সুফল মিলছে না। দরিদ্র মা ও শিশু স্বাস্থ্য পুষ্টির উন্নয়ন এবং সমাজিক নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলার জন্য সরকারের নেয়া সামাজিক নিরাপত্তামূলক কার্যক্রমের মধ্যে কর্মজীবী ল্যাকটেটিং মাদার সহায়তা তহবিল প্রকল্পটি সাতক্ষীরা পৌর এলাকায় চালু হয় জুন ২০১০ থেকে। প্রতি ২ বছর মেয়াদী এই প্রকল্পে মোট ৮শ’ ৫০ জন মাকে এই সহায়তার আওতায় নেয়া হয়। মা ও শিশুর মৃত্যুর হার হ্রাস, মাতৃদুগ্ধ পানের হার বৃদ্ধি, গর্ভাবস্থায়, প্রসব ও প্রসবোত্তর সেবা বৃদ্ধি জীবিকার মান উন্নয়ন, পুষ্টি সহায়তা প্রদানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে এই প্রকল্প চালু করা হয়। সরকারের এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে মহিলা বিষয়ক অধিদফতর। জেলা পর্যায়ে এই প্রকল্পে ল্যাকটিং মাদের নির্বাচনের জন্য নির্ধারিত ৬ সদস্যের কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক। প্রতি অর্থবছওে পৌর এলাকায় মোট ৯টি ওয়ার্ডে ৮শ’ ৫০ জন মাকে এই সহায়তার জন্য নির্বাচন করা হচ্ছে। প্রকল্পের নীতিমালা অনুযায়ী সহায়তা পাওয়ার জন্য নির্বাচিত ল্যাকটেটিং মায়ের বয়স কমপক্ষে ২০ বছর বা তার উপরে হতে হবে। কর্মজীবী হিসেবে তার মাসিক উপার্জন সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা বা তার কম হতে হবে। দরিদ্র কর্মজীবী গর্ভবতি বা দুগ্ধদায়ী মা প্রথম বা দ্বিতীয় গর্ভের সন্তান গর্ভাবস্থায় থাকাকালীন বা সন্তান প্রসব হতে সর্বোচ্চ ২৪ মাসের জন্য জীবনে একবার এই ভাতা পাওয়ার জন্য বিবেচিত হবেন। মাঠ পর্যায়ে চলমান এই প্রকল্পের শতভাগ সুফল মিলছে না এমন তথ্যের বিষয়ে জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা তারাময়ী মুখার্জী জনকণ্ঠকে বলেন, সুবিধাপ্রাপ্ত মায়েদের এনজিওর মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেয়ার বিষয়টি শুধু মনিটরিং করা হয়। প্রকল্পে সাহায্য পরবর্তী মনিটরিং বিষয়ে কোন সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা না থাকায় কম ওজনের বাচ্চা হচ্ছে কিনা এবং গর্ভবতি মায়েদের পুষ্টি ও স্বাস্থ্য বিষয়টি কেমন থাকছে এ বিষয় ফলোআপ করা হয় না বলে তিনি জানান। ২০১২-১৩ অর্থবছরে এই প্রকল্পে সহায়তা পাওয়া পৌর সভার কয়েকটি এলাকায় মায়েদের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া যায় সফলতার দুর্বল চিত্র। ৬নং ওয়ার্ডের ইটাগাছা এলাকার রাজমিস্ত্রি মনিরুলের স্ত্রী মোহসেনার (২০) মেয়ের বয়স এখন ৩ বছর ২ মাস। বাচ্চা হওয়ার ১ বছর পরে তিনি ভাতা পেয়েছেন। তার মেয়ে মনিরা প্রায়ই বিভিন্ন রোগে ভুগছে। সংশ্লিষ্ট এনজিও থেকে পুষ্টি ও পরিষ্কার পরিচ্ছনতা বিষয়ে প্রশিক্ষণ পেলেও ভাতার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে তাদের সম্পর্কে আর কেউ খোঁজখবর নেয়নি। প্রকল্পের সহায়তা পাওয়া এই মা অকপটে স্বীকার করে বলেন, তৃতীয় কিস্তিতে পাওয়া সম্পূর্ণ টাকাই বিশেষ প্রয়োজনে তুলে দিতে হয় স্বামীর হাতে। নিউমোনিয়ায় ভুগছে সহায়তা পাওয়া ইটাগাছা গ্রামের হাফিজা খাতুনের ৩ বছরের মেয়ে ফরিদা। গত ২ বছর ধরে শিশুটি নানা রোগে ভুগছে। স্বামী ছাত্তার মোল্যা পেশায় ভ্যানচালক। মেয়ের ১ বছর বয়সে তিনি সরকারী সহায়তা পেয়েছেন। তবে মেয়ের সর্দি, জ্বর, কাশি আর নিউমোনিয়ার চিকিৎসা করাতে গত ১ বছরে তার খরচ হয়েছে প্রায় ১০ হাজার টাকা। সরকারী সহায়তা পেয়েছেন ২ বছরে মোট ৯ হাজার টাকা। মেয়ের দুধ, পথ্য আর ওষুধ কিনতে এই টাকার সঙ্গে আরও টাকা চলে গেছে। গাড়ি ড্রাইভার রবিউলের স্ত্রী সুমাইয়ার মেয়ে ছোঁয়ার বয়স এখন ২ বছর। অপুষ্টিতে আক্রান্ত ছোঁয়া জ্বর আর খিঁচুনি রোগে ভুগছে গত ১ বছর ধরে। সরকারী সহায়তা মিলেছে ২ বছরে ৪ কিস্তিতে ৯ হাজার টাকা। মাসিক কত টাকা হারে বরাদ্দ ছিল এ বিষয়টি তার জানা নেই। ব্যাংক থেকে ৬ মাস অন্তর এই টাকা তিনি উত্তোলন করে প্রথম দুই দফা ২১শ’ টাকা এবং পরবর্তী ২ কিস্তিতে ২৪শ’ টাকা হারে তিনি টাকা পেয়েছেন। এসব মায়েরা জানান, তালিকাভুক্তি ও সহায়তা পাওয়ার সময় দায়িত্বপ্রাপ্ত বেসরকারী সংস্থা সিডোর পক্ষ থেকে তাদের পরিষ্কার পরিচ্ছনতা এবং পুষ্টিকর খাবার তৈরি ও খাওয়ার বিষয়ে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। সহায়তা পরবর্তী সময়ে এই এনজিও, সরকারী দফতর আর পৌর কাউন্সিলরদের পক্ষ থেক্ষে তাদের কোন খোঁজখবর নেয়া হয়নি। মায়েদের তালিকা প্রণয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত পৌরসভার প্যানেল চেয়ারম্যান সফিক উদ্দৌলা সাগর বলেন, বিষয়গুলো দেখার দায়িত্ব প্রশিক্ষণ দেয়ার দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্ট এনজিওদের। প্রশিক্ষণের দায়িত্বে থাকা দুটি এনজিও সিডো ও ভূমিষ্টের নির্বাহী পরিচালকরা বলেন, তালিকাভুক্ত মায়েদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিষয়ে তারা প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন। এর বাইরে তাদের আর কোন দায়িত্ব নেই। প্রকল্পের জেলা কমিটির সভাপতি সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক নাজুমুল আহসান জনকণ্ঠকে বলেন, প্রকল্পের সুবিধাভোগী মায়েদের সহায়তা পরবর্তী বিষয়টি যাতে মনিটরিং ও ফলোআপ করা হয় সে বিষয়টি তিনি নিজ উদ্যোগে দেখবেন।
×