ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মানবপাচারের হোতা চার দেশের ১১ জন

প্রকাশিত: ০৭:০৮, ১৭ জানুয়ারি ২০১৫

মানবপাচারের হোতা চার দেশের ১১ জন

দীপন বিশ্বাস, উখিয়া ॥ মালয়েশিয়ায় ভাল চাকরি ও বেশি টাকা কামানোর প্রলোভন দেখিয়ে সাগরপথে মানবপাচারে জড়িত চক্রটি চালায় মালয়েশিয়া প্রবাসী বাংলাদেশীসহ চার দেশের ওরা ১১জন। থাইল্যান্ডে বসে নেতৃত্ব দিচ্ছেন মানাকিং নামের মালয়েশিয়ার এক মহিলা। বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেন মংমং সেন রাখাইন। এ চক্রটির সঙ্গে আছেন চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের ২৬ হুন্ডি ব্যবসায়ী। মানবপাচার রোধকল্পে গঠিত কমিটির অনুসন্ধানে এ তথ্য পাওয়া গেছে। এমন আরও তথ্য অনুসন্ধানের পাশাপাশি কমিটি মানব পাচাররোধে ৮টি সুপারিশও করেছে, তাতে বলা হয়েছেÑ চক্রটির সদস্যদের আইনের আওতায় আনা গেলে মানব পাচাররোধ করা সম্ভব হবে। কমিটি চক্রের এসব সদস্যকে শনাক্ত করেছে বলে জানা গেছে। তারা বাংলাদেশ, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার নাগরিক। চিহ্নিত ২জনের মধ্যে ১জন মানাকিং, যিনি মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে বসে নেতৃত্ব দেন। অন্যজন মংমং সেন রাখাইন, যিনি বর্তমানে কারাগারে। প্রতিবেদনের অংশবিশেষ থেকে জানা গেছে, মূল চক্রটির সঙ্গে জড়িত চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের ২৬ হুন্ডি ব্যবসায়ীর কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে। এ তালিকায় ১৭ নম্বরে আছেন মোঃ ইসলাম (৩৩)। সে টেকনাফ সদরের বাসিন্দা এবং উখিয়া-টেকনাফের সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদির ছোটভাই মুজিবুর রহমানের প্রধান সহযোগী। হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ লেনদেনকারীদের কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে। তারা হলেনÑটেকনাফের জাফর আলম ওরফে টিপি জাফর (৩৫), জাফর সাদেক (৩০), শাহপরী দ্বীপের হেলাল উদ্দিন (৩৫), মোঃ ফায়সাল (৩০), আব্দুল্লাহ (৩০), মোঃ জামাল (২৮), সাবরাং এলাকার মোঃ হারুন (৪৫), আব্দুস শুক্কুর (৩৩), হামিদ হোসেন (৩৬), মুফিজুর রহমান (৪২), আবু বক্কর (৬৫), নুরুল আবছার (২৫), জুবাইর হোসেন (৪০), পিচ্ছি আনোয়ার (৪০), চট্টগ্রাম খুলশি থানার ইসলাম ও কক্সবাজারের আব্দুল্লাহ। প্রতিবেদনে স্বাক্ষর করেন কমিটির আহ্বায়ক চট্টগ্রাম নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম এ্যান্ড অপারেশন) বনজ কুমার মজুমদার, কক্সবাজার জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তোফাইল আহমদ, চট্টগ্রাম অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ নাঈমুল হাছান ও নগর পুলিশের সহকারী কমিশনার নিয়াজ মোহাম্মদ। পাচারের শুরু, শুরুতে পাচারকারী ব্যক্তি শনাক্ত, বর্তমানে কারা-কিভাবে পাচার করছে, কোন্ কোন্ দেশের নাগরিক পাচারে জড়িত, বাংলাদেশী নাগরিকদের কিভাবে অত্যাচার করা হচ্ছে, তাদের স্বজনদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করা হচ্ছে-এসব অনুসন্ধান করেছে কমিটি। শেষে পাচারের বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপন এবং পাচাররোধে ৮টি সুপারিশ করে পুলিশ সদর দফতরে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বসে পাচারে নেতৃত্ব দিচ্ছেন মংমং সেন রাখাইন। এ মংমং সেন রাখাইন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত শীর্ষ ৭জনের মধ্যে ৩ নম্বরে থাকা ইয়াবা কারবারি। গত ১৩ ডিসেম্বর কক্সবাজার পুলিশ তাকে ইয়াবাসহ গ্রেফতার করে। মমসি নামে পরিচিত এ কারবারি বর্তমানে কক্সবাজার কারাগারে। মমসি সম্পর্কে জানতে চাইলে, টেকনাফ থানা থেকে সদ্য বদলি হওয়া ওসি মোকতার হোসেন বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় থাকা ৭ শীর্ষ ইয়াবা কারবারির মধ্যে মমসি আছে ৩ নম্বরে। ওসি জানান, গত এপ্রিল-মে মাসে ইয়াবা কারবারিদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চালানো হলে মমসি মিয়ানমারে পালিয়ে যান। তিনি আরও জানান, মমসি মূলত মিয়ানমারের নাগরিক। কিন্তু তিনি এপারের টেকনাফে এসে কয়েক বছর আগে থেকে বসবাস শুরু করেন। এখানকার ভোটার হয়ে নাগরিকত্ব লাভ করেন। বাবার বিয়ে সূত্রে মমসি সংসদ সদস্য বদির খালাত ভাই। প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কিছু মানুষ সরল বিশ্বাসে অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্নে মালয়েশিয়া যেতে চায়। এসব মানুষকে লক্ষ্য করে মালয়েশিয়া প্রবাসী কিছু লোক দেশের প্রভাবশালী লোকদের ছত্রছায়ায় প্রতারণামূলক চক্র তৈরি করেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রোহিঙ্গা নাগরিকও। অর্থ বিনিয়োগকারী ও লোক সংগ্রহকারী এ ২টি স্তরে অন্তত ২৩৫জন জড়িত বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ২ স্তরের দালালরাই মূলত লোক সংগ্রহ করে। মালয়েশিয়া প্রবাসী বাংলাদেশী, থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারের নাগরিক নিয়ে চক্রটিকে সহযোগিতা করছে বাংলাদেশী পাচারকারীরা। পাচারকারীরা ১০-২০হাজার টাকা নিয়ে পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়া শত শত মানুষকে পাচার করে দিচ্ছে। এছাড়া অনেক ক্ষেত্রে অপহরণের মাধ্যমেও পাচার করে থাকে। দেশের বিভিন্নস্থান থেকে লোক সংগ্রহ করে উপকূলীয় এলাকায় অবস্থানরত ট্রলারে তুলে দেয় তারা। সেখান থেকে গভীর সমুদ্রে নিয়ে পাচারে ব্যবহৃত মূল ট্রলারে তুলে দেয়া হয়। এর অবস্থান সেন্টমার্টিনের অদূরে মিয়ানমারের আকিয়াব এলাকায়। পাচারের সময় ট্রলারে পাচারকৃত ব্যক্তিকে তোলা হয় বস্তায় ভরে। জাহাজে পণ্য তোলা হচ্ছে এমনটা বোঝাতেই এ ধরনের কৌশল অবলম্বন করা হয়। এছাড়া, পাচারের সময় পাচারকৃত মানুষের বাহুতে অমোচনীয় কালি দিয়ে নামের আদ্যক্ষর লিখে দেয়া হয়। মানব পাচার রোধে কমিটি ৮টি সুপারিশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, পাচাররোধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও এ্যাটর্নি জেনারেলের প্রতিনিধির সমন্বয়ে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা আবশ্যক। একই সঙ্গে জেলা ও মহানগর পর্যায় এবং উপকূলীয় এলাকায় বিশেষ মনিটরিং সেল গঠন, মানব পাচার আইনে দায়ের করা মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে হস্তান্তর করা এবং টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপ এলাকায় পুলিশের তদন্ত কেন্দ্র স্থাপন করা।
×