ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী আজ

প্রকাশিত: ০৬:৪৫, ১৭ জানুয়ারি ২০১৫

মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী আজ

গৌতম পা-ে ॥ বাংলা চলচ্চিত্রের মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী আজ শনিবার। গত বছরের এই দিনে জীবনাবসান বিশ্বখ্যাত এই অভিনেত্রীর। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসের একটি মহা অধ্যায়েরও সমাপ্তি হয়। মহানায়ক উত্তম সেনের সূত্র ধরেই এ নাম সকলের কাছে অতি প্রিয়। দীর্ঘ অসুস্থতার পর গত বছরের আজকের দিনে মৃত্যু সংবাদে সেদিন সকালে অনেকের ঘুম ভাঙ্গে। ভারতের গ-ি ছাড়িয়ে সেদিন বাংলাদেশের মিডিয়াতেও ছিল কেবলই সুচিত্রা সেন। আমাদের চোখ এখনও জলে ভিজে আছে। আমাদের রমাই তো এই সুচিত্রা সেন। তিনি কলকাতার নায়িকা হতে পারেন, বাংলাদেশের মেয়ে তো! আমাদের আবহাওয়াতেই তার বেড়ে ওঠা। বাংলাদেশের আলোতে তিনি জীবনে প্রথম চোখ মেলেছেন, বাংলাদেশের বাতাস থেকে তিনি প্রথম অক্সিজেন নিয়েছেন, বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শিখেছেন। শুধু সুচিত্রার শৈশব নয়, তার কৈশোরের গোল্লাছুট আর দুরন্তপণাও বাংলাদেশে। জীবনের প্রথম ষোলোটি বছর তার কেটেছে এই দেশে। তাই বলা যায়, সুচিত্রার জীবনের সবচেয়ে মধুর সময়টাই তিনি বাংলাদেশে কাটিয়েছেন। শুধু বাবার বাড়িই নয়, তার শ্বশুরবাড়িও বাংলাদেশে ঢাকার গে-ারিয়ায়। তাই দুই কুল থেকে সুচিত্রা আমাদেরও। ৬ এপ্রিল, ১৯৩১ সাল। পাবনার এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারের অন্দরমহল থেকে ছড়িয়ে পড়ে এক নবজাতকের চিৎকার। বাড়ির কর্তা করুণাময় দাশগুপ্ত মেয়ের মুখ দেখে খুশি। এলাকায় মিষ্টি বিলিয়ে জানিয়ে দেন, তিনি কন্যা-সন্তানের পিতা হয়েছেন। তিনি নিজের স্ত্রী ইন্দিরা দাশগুপ্তের সঙ্গে আলাপ করে মেয়ের নাম রাখেন রমা দাশগুপ্ত। এ রমাই আজকের সুচিত্রা। তিনি ছিলেন সংসারের পঞ্চম সন্তান এবং তৃতীয় কন্যা। রমার শৈশব- কৈশোর কেটেছে পাবনা শহরের গোপালপুর মহল্লার হেমসাগর লেনের বাড়িতে। রমার বাবা ছিলেন এলাকার প্রাইমারী স্কুলের প্রধান শিক্ষক। তাই পড়াশোনায় ছিল বেশ কড়াকড়ি। পাবনার মহাখালী পাঠশালায় পড়াশোনা শুরু করেন রমা। প্রাইমারী পাঠ চুকিয়ে তিনি ভর্তি হন পাবনা গার্লস স্কুলে। এখানে ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়াশোনা করেন রমা। ১৯৮০ সালের ২৪ জুলাই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিলেন মহানায়ক উত্তম কুমার। রাতভর তার মরদেহ’র পাশে আত্মীয়-পরিজনদের সঙ্গে ছিলেন দুই দশকের চলচ্চিত্র জীবনের সঙ্গী সুচিত্রা সেনও। সেদিন উত্তমকে শেষবারের মতো বিদায় জানিয়েছিল এই পৃথিবী। অনেকটা সেই দিনটিতেই যেন বিদায় নিয়েছিলেন সুচিত্রা সেনও। উত্তমের শেষ শয্যার পাশ থেকে উঠে ফিরে গেলেন কলকাতার বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের ২৪/৪/৪ ঠিকানার বাড়িতে। সেই যে আড়ালে গেলেন, তারপর ফিরলেন মাত্র একবারই। ১৯৮২ রবীন্দ্রসদন প্রেক্ষাগৃহে সীমিত পরিসরে আয়োজিত স্বল্পসংখ্যক মানুষের সামনে কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে। শেষবার তাকে ক্যামেরার সামনে দেখা গিয়েছিল ১৯৭৮ সালে। ‘প্রণয় পাশা’ চলচ্চিত্রে তিনি শেষ অভিনয় করেছিলেন। শেষ জীবনে তিনি দেখতে কেমন হয়েছেন এই কৌতূহল ছিল সবার কাছে। আড়ালের মানুষ থেকে গেলেন আড়ালেই। অন্তরালে থাকার জন্য সুচিত্রার তীব্র চেষ্টা দেখা যায় ২০০৫ সালের এক ঘটনায়। সে বছর আজীবন সম্মাননায় দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন সুচিত্রা। কিন্তু অন্তরাল থেকে বের হয়ে মানুষের সামনে রাষ্ট্রপতির হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণে তিনি অস্বীকৃতি জানান। তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী প্রিয়রঞ্জন দাশ মুন্সি বিষয়টি নিয়ে একটি কমিটিও গঠন করেছিলেন। নিয়ম বদলানো সম্ভব হলেও তিনি আর পুরস্কার নিতে যাননি। বালিগঞ্জের বাড়িটিতে একা থাকতেন সুচিত্রা। মেয়ে নাতনীরা নিজেদের মতো করে আলাদা। বিভিন্ন সময় পত্রিকান্তরে জানা যায় ঘরে বসে টিভিতে নিজের ছবিগুলো আগ্রহ নিয়ে দেখতেন। রামকৃষ্ণ মিশনের হেডকোয়ার্টার বেলুর মঠে গিয়ে অনেক সময় পুজো-অর্চনা করে সময় কাটাতেন। কলকাতার স্বনামধন্য সাহিত্যিক কণা বসু মিশ্র এক স্মৃতিকথায় একটা ঘটনার উল্লেখ করেছিলেন। কলকাতা দূরদর্শনে ‘সাত পাকে বাঁধা’য় সুচিত্রা সেনের অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকে ফোন করেছিলেন কণা। ততদিনে সুচিত্রা চলচ্চিত্র থেকে বহুদূরে। কণা ফোনে তাকে বললেন, সাতপাকে বাঁধায় আপনার অভিনয় দেখে আমি আপ্লুত, অসাধারণ। সুচিত্রা সেন কণাকে থামিয়ে বললেন ওটা অভিনেত্রী সুচিত্রা সেন, আমি নই। অভিনয় ক্যারিয়ারে একবার সাক্ষাতকারে সুচিত্রা বলেছিলেন আমাকে শুধু স্ক্রীনেই দেখা যাবে, কারণ আমি একজন অভিনেত্রী। উত্তম-সুচিত্রা জুটি মিলেই তো মহাকাব্য রচিত হয়েছে। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত নিজেকে আড়ালে রেখে তিনি এখনও আমাদের কাছে রয়ে গেছেন সেই চিরচেনা রূপেই।
×