ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

সরকার অনড় ॥ কোন সংলাপ নয়

প্রকাশিত: ০৫:০৯, ১৭ জানুয়ারি ২০১৫

সরকার অনড় ॥ কোন সংলাপ নয়

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ বিএনপি-জামায়াত লাগাতার অবরোধ চালিয়ে গেলেও নির্বাচন নিয়ে তাদের সঙ্গে কোন ধরনের আলোচনা বা সংলাপের চিন্তাই করছে না শাসক দল আওয়ামী লীগ। নাশকতা ও সহিংসতানির্ভর রাজনৈতিক দলগুলোকে কোন ছাড় না দেয়ার অবস্থানেই অনড় রয়েছে দলটি। আপোসের পরিবর্তে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পদক্ষেপের মাধ্যমে পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও বিরোধীপক্ষকে আরও কঠোরভাবে মোকাবেলার সিদ্ধান্ত রয়েছে দলটির নীতিনির্ধারক মহলে। জানা গেছে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা মধ্যবর্তী নির্বাচনের যে দাবি বিএনপি করে আসছে, তা স্পষ্টতই নাকচ করে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। আগামী নির্বাচন নিয়ে সংলাপ বা আলোচনার কোন ভাবনাই শাসক দলটিতে নেই। বরং আন্দোলনের নামে বিএনপি-জামায়াত জোটসহ সরকারবিরোধী পক্ষরা যে নাশকতা ও নৃশংসতার পথ বেছে নিয়েছে, তা দমনে সরকার আরও হার্ডলাইনে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মানুষের জানমাল রক্ষায় দলটি যে কঠোর অবস্থান নিয়েছে, সে অবস্থান থেকে তারা কোনভাবেই সরে আসবে না। সভা-সমাবেশের মাধ্যমে রাজপথ দখলে রাখার পাশাপাশি কঠোর অবস্থানে থেকে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার সিদ্ধান্ত রয়েছে দলটির উচ্চ মহলে। সরকারের এ মনোযোগ সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ক’জন শীর্ষ কর্মকর্তার বক্তব্যেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও নাশকতা-সহিংসতা দমনে সরকার থেকে যা যা করার তাই করা হবে বলেও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানান, জনগণের জানমাল রক্ষায় ও নিরাপত্তায় সরকার সর্বোচ্চ কঠোর অবস্থানে থেকে যা যা করার তাই করবে। কাউকেই ন্যূনতম ছাড় দেয়া হবে না। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ বলেছেন, সাধারণ মানুষের জীবন বাঁচাতে বোমাবাজদের প্রয়োজনে গুলি করতেও দ্বিধা করা হবে না। এমনকি যতদিন প্রয়োজন ততদিন মাঠে থাকবে বিজিবি। সর্বশেষ শুক্রবার রংপুরের মিঠাপুকুরে পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক ও র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ সন্ত্রাসীদের কঠোরভাবে নির্মূল করার ঘোষণা দিয়েছেন। দেশকে অস্থিতিশীল করার কোন অপচেষ্টাই বাস্তবায়ন না করতে দেয়ার দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন তাঁরা। এ প্রসঙ্গে ক্ষমতাসীন চৌদ্দ দলীয় জোটের প্রধান শরিক জাসদের সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু জনকণ্ঠকে বলেন, নাশকতা ও অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকান্ডের নির্দেশদাতা বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ফাউল করে লালকার্ড পেয়ে রাজনীতির মাঠের বাইরে চলে গেছেন। লালকার্ড পাওয়া খালেদা জিয়ার সঙ্গে কোন ধরনের সংলাপের প্রশ্নই ওঠে না। গণতান্ত্রিক শক্তির সঙ্গে সংলাপ বা আলোচনা হতেই পারে। কিন্তু অগণতান্ত্রিক, জঙ্গীবাদ, রাজাকার, যুদ্ধাপরাধী ও নাশকতাকারী অপশক্তির সঙ্গে রাজনীতির খেলা বা সংলাপ হতে পারে না। তিনি বলেন, খালেদা জিয়া যদি নাশকতা ও অন্তর্ঘাত বন্ধ এবং জঙ্গীবাদ-রাজাকার-যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গ ছেড়ে গণতন্ত্রের গেটপাস গ্রহণ করে তখন দেখা যাবে কী হয়, তার আগে নয়। আর বিএনপি-জামায়াতের বাইরে যারা সংলাপের কথা বলছেন, তাদের প্রতি অনুরোধÑআগে খালেদা জিয়াকে নাশকতা-নিষ্ঠুরতা ও জঙ্গীবাদী জঘন্য কর্মকা- থেকে বিরত থাকতে বলুন। আর তা না পারলে জাতির সামনে পরিষ্কার হবে, যারা সংলাপের কথা বলছেন তারা খালেদা জিয়ার নাশকতা-অন্তর্ঘাতমূলক নৃশংসতাকেই সমর্থন দিচ্ছেন। আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমও বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে কোন ধরনের সংলাপের সম্ভাবনা নাকচ করে দেন। তিনি বলেন, কীসের সংলাপ, কার সঙ্গে সংলাপ? বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলনের নামে নাশকতা-সহিংসতার সঙ্গে দেশের জনগণের ন্যূনতম সম্পর্ক বা সমর্থন নেই। নির্বাচনে ও রাজপথে ব্যর্থ হয়ে খালেদা জিয়ারা এখন অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকা-ের মাধ্যমে যদি মনে করেন আওয়ামী লীগকে পরাজিত করবেন, তবে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। খালেদা জিয়া নির্বাচনী ট্রেন মিস করে দিশাহারা হয়ে জনগণের ওপর প্রতিশোধ নিচ্ছেন। ২০১৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই নির্বাচন হবে, তার আগে নয়। কঠোরভাবে বিএনপি-জামায়াতের নাশকতা দমন করে আবারও তাদের পরাজিত করা হবে। আওয়ামী লীগসহ ক্ষমতাসীন শরিক দলের নেতাদের মতে, খালেদা জিয়া চাইলেই দলীয় কার্যালয় ছেড়ে বাসায় যেতে পারেন, সরকারের পক্ষ থেকে বার বার একথা বলা হলেও এক গভীর চক্রান্ত থেকেই তিনি নিজেকে নিজে অবরুদ্ধ করে রেখেছেন। একটি বছর ধরে আন্দোলনের চেষ্টা করেও জনগণের ন্যূনতম সমর্থন আদায়ে ব্যর্থ হন তিনি। আর আন্দোলন ডেকেও নিজ দলেরই নেতাকর্মীর কাছে না পাওয়ার হতাশা থেকেই খালেদা জিয়া আন্দোলনের নামে চোরাগোপ্তা নাশকতা-নৃশংসতার পথ বেছে নিয়েছেন। আর তাঁর এই আন্দোলন নির্বাচনের জন্য নয়, নিজের ও তাঁর পুত্রের নামে দায়েরকৃত মামলা থেকে রক্ষায় জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে সহিংসতার পথ বেছে নিয়েছেন বিএনপি নেত্রী। আওয়ামী লীগের উচ্চ পর্যায়ের সূত্র বলছে, বিএনপি-জামায়াতের আরও কিছু গোপন ষড়যন্ত্রের তথ্য ইতোমধ্যে গোয়েন্দাদের মাধ্যমে সংগ্রহ করেছে সরকার। কিছু ষড়যন্ত্র ইতোমধ্যেই ব্যর্থ করে দিয়েছে তারা। দ্বিতীয় দফায় চলমান বিশ্ব এজতেমা শেষে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে যে নাশকতার ছক বিএনপি-জামায়াত করেছে, তাও ব্যর্থ করে দিতে সরকার থেকে সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। আর রিয়াজ রহমানের ওপর হামলাকে কেন্দ্র করে কূটনীতিক মহলের অনুকম্পা গ্রহণের যে সর্বশেষ পন্থাটি বিএনপি গ্রহণ করেছিল, আওয়ামী লীগ ও সরকার তরফ থেকে কূটনীতিকদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে সব কিছু পরিষ্কার করতেও সক্ষম হয়। তাই দলটির নীতিনির্ধারকদের ধারণা, চলতি সপ্তাহেই সারাদেশের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়ে আসবে। সরকারের উচ্চ সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি-জামায়াতের লাগাতার হরতাল-অবরোধে যানবাহনে আগুন, সন্ত্রাস, বোমাবাজিসহ সৃষ্ট পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দু’একদিনের মধ্যেই কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। আগামী দু-চারদিনের মধ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না এলে প্রয়োজনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিশেষ অভিযানে নামানোর চিন্তা-ভাবনা চলছে সরকারের নীতিনির্ধারক মহলে। জানা গেছে, আগামীকাল রবিবার শেষ হবে দ্বিতীয় পর্বের বিশ্ব এজতেমা। বিশ্ব এজতেমার কারণে কিছুটা ধৈর্যের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে চাইছে সরকারপক্ষ। এই সময়ের মধ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না এলে সরকার কঠোরহস্তে নাশকতাকারীদের দমনে মাঠে নামার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে অংশ না নিয়ে পুরো একটি বছরই বিএনপি ও জামায়াত ছিল দৃশ্যত অস্তিত্বের সঙ্কটে। সরকারবিরোধী কঠোর আন্দোলনের বার বার হুমকিধমকি দিলেও বিগত এক বছরে রাজপথে সামান্য আন্দোলন তো দূরের কথা, রাজপথেই নিজ দলের নেতাকর্মীকে নামাতে ব্যর্থ হয়েছেন খালেদা জিয়া। বিএনপি সূত্রগুলো বলছে, দলের কোন পর্যায়ের নেতাকে কাছে না পেয়ে গত ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় নির্বাচনের দিন নিজে দলীয় কার্যালয়ের সামনে কিংবা জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান নেয়ার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। তাঁর ধারণা ছিল, রাজপথে তিনি (খালেদা জিয়া) বসে গেলে নেতাকর্মীরা ঘরে বসে থাকতে পারবে না। সে ক্ষেত্রে একটি রক্তক্ষয়ী পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে, সরকার বেকায়দায় পড়ে মধ্যবর্তী নির্বাচন নিয়ে সংলাপে বসতে বাধ্য হবে। কিন্তু গোয়েন্দা মারফত খালেদা জিয়ার এমন পরিকল্পনার খবর ফাঁস হয়ে যাওয়ায় সরকার শক্তহাতেই তা মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়। এ যাত্রায় রাজপথে কিছু করতে না পেরে অবরোধ-হরতালের নামে দেশের বিভিন্নস্থানে বিএনপি-জামায়াত ক্যাডাররা পেট্রোলবোমা মেরে, আগুন দিয়ে পূর্বের ন্যায় আবারও মানুষ হত্যা করে যাচ্ছে। বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের ধারণা, এভাবে মানুষের রক্ত ঝরাতে পারলে তা বন্ধে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ সক্রিয় হয়ে উঠবে। সংলাপ বা আলোচনার মাধ্যমে সৃষ্ট সঙ্কট সমাধানে উদ্যোগী হবে। বিশ্ব নেতাদের চাপে সরকারও সংলাপে বসতে বাধ্য হবে। এ পরিকল্পনা থেকেই অবরোধ-হরতাল কর্মসূচীর মধ্যেই বিএনপির কিছু নেতা ও সমর্থক বুদ্ধিজীবী কূটনীতিকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন ও বৈঠক করছেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও বিএনপি নেতারা কোন আলোর মুখ দেখতে পাচ্ছেন না বলেই জানা গেছে। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের অবস্থান হচ্ছে, নাশকতা-সহিংসতা চালিয়ে কখনই বিএনপি জনসমর্থন এবং বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সমর্থন পাবে না। দেশের মানুষ শান্তি চায়, সংঘাত-সহিংসতা চায় না। আর বিগত ছয়টি বছর ধরেই সরকার সফলতার মাধ্যমে দেশ পরিচালনা করে বাংলাদেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে স্থাপিত করেছে। দেশের মানুষ শান্তি-স্বস্তিতে রয়েছে। গ্রামের মানুষের ভাগ্যেও ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। সর্বশেষ জরিপেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের জনপ্রিয়তা যে অনেক বেড়েছে তাও উঠে এসেছে। যেহেতু সরকার দেশ পরিচালনায় সফল, দেশের মানুষেরও সমর্থন রয়েছে সে কারণে বিএনপির সঙ্গে ২০১৯ সালের নির্বাচনের আগে কোন ধরনের সংলাপের কথা তারা ভাবছেই না। বরং রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দু’ভাবেই কঠোর অবস্থানে থেকে বিএনপি-জামায়াতের নাশকতা-সহিংসতা নির্মূলের কথা ভাবছে সরকারের হাইকমান্ড।
×