ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অবরোধের আগুনে সংসার তছনছ হয়ে গেল কালামের

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ১৬ জানুয়ারি ২০১৫

অবরোধের আগুনে সংসার তছনছ হয়ে গেল কালামের

নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ চাকরির সন্ধানে রাজধানীতে এসেছিলেন যুবক আবুল কালাম হাওলাদার (২৬)। প্রাইভেট কারের চালকের চাকরি পেয়েছিলেন এক মাসের মধ্যে। কিন্তু সেই চাকরিই কাল হলো। বিএনপির অবরোধে রাজধানীর রমনার মগবাজারে পেট্রোল বোমায় দগ্ধ সেই প্রাইভেটকারই তার মৃত্যু কেড়ে নিল। অবরোধে আগুনে পোড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার সংসার তছনছ হয়ে গেল। ছয় দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে বৃহস্পতিবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বার্ন ইউনিটের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। তার মতো কাওরানবাজারে পেট্রোল বোমা দগ্ধ বাসযাত্রী রিক্সাচালক পঞ্চাশোর্ধ অমূল্য চন্দ্র বর্মন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। শুধু তারাই নয়। গুলিস্তানে ককটেল বিস্ফোরণে কবি নজরুল সরকারী কলেজের মেধাবী ছাত্র অভি বামপাশের চোখটি সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। ককটেলটি তার মুখে বিস্ফোরিত হয়। মাথায় স্পিøন্টার বিদ্ধ। একই এ ঘটনায় তার সঙ্গে থাকা বন্ধু জীবনও বোমার স্পিøন্টার বিদ্ধ হয়েছে। টানা অবরোধের পেট্রোল বোমায় দগ্ধ ১২ জন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বেডে কষ্ট ও যন্ত্রণায় ছটফট করছে। ওদের সারা শরীরে পোড়া ক্ষত চিহ্ন। কারও শ্বাসনালী পুড়ে গেছে। কারও মুখ ঝলছে গেছে। পুরো শরীর ব্যান্ডেজ মোড়ানো। আহতদের স্বজনরা অভিযোগ করেন, অবরোধকারীদের আগুনে ওদের সাজানো সংসার তছনছ হয়ে গেছে। ওদের সংসার এখন চালাবে কে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের চিকিৎসক সামন্ত লাল সেন জানান, গত ৫ জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ২২ জন দগ্ধ হয়ে তাঁদের কাছে চিকিৎসা নিতে এসেছেন। এদের মধ্যে ১২ জন এখনও ভর্তি আছেন। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের বর্ষপূর্তির দিনে ঢাকায় সমাবেশ করতে না পেরে সারাদেশে লাগাতার অবরোধ ডাকেন বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়া। এর মধ্যে প্রতিদিনই কোন না কোন জেলায় বিএনপি ও শরিকদের হরতাল চলছে। ঘটছে নাশকতা। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, অবরোধের ১১ দিনে সারা দেশে পেট্রোল বোমা ও আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা গেছেন প্রায় ১০ জন। দগ্ধ হয়েছে অর্ধশতাধিক। চার শতাধিক যানবাহনে ভাংচুর-অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। এদিকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান জানান, রাজনীতিতে ভিন্নমত থাকলে তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। তাকে হতে হবে অহিংস। রাজনীতির নামে সন্ত্রাস, সহিংসতা, মানুষ পোড়ানো কেউ কোনদিন গ্রহণ করে না। বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় অবরোধে পেট্রোল বোমায় দগ্ধ আহতদের দেখতে ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে এসে তাদের সঙ্গে কথা বলে তিনি এ কথা সাংবাদিকদের সামনে। জানা গেছে, গত ৯ জানুয়ারি রাত সোয়া ১১টার দিকে রাজধানীর রমনা থানাধীন মগবাজার আগোরা শপিং কমপ্লেক্সের সামনে প্রাইভেটকার নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন আবুল কালাম হাওলাদার। ঠিক এ সময়ই অবরোধকারী কয়েক যুবক আবুল কালামের প্রাইভেটকার লক্ষ্য করে পেট্রোল বোমা ছুঁড়ে মারে। এতে তার প্রাইভেটকারে আগুন ধরে। পরে স্থানীয়রা গাড়ির আগুন নিভিয়ে বের করে আনেন চালক মোঃ আবুল কালামকে। কিন্তু ততক্ষণে আবুল কালামের সারা শরীর পুড়ে গেছে। তার শরীরের এক তৃতীয়াংশ আগুনে ঝলসে যায়। বার্ন ইউনিটে আবাসিক সার্জন পার্থ শঙ্কর পাল জানান, আবুল কালামের শরীরের ৩৩ ভাগ পুড়ে গেছে। তার শ্বাসনালী পুড়ে গেছে। বৃহস্পতিবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে তার মৃত্যু হয়। নিহত আবুল কালামের বাবার নাম মৃত আব্দুল হক। গ্রামের বাড়ি বরিশাল জেলার আগৈলঝাড়া থানার রাংতা গ্রামে। তিন ভাইয়ের মধ্যে আবুল কালাম সবার ছোট। তার মেজ ভাই মোঃ আবু তালেব কৃষিকাজ করেন। আর বড়ভাই ইব্রাহিম ঢাকায় গাড়ি চালান। ওদিনই অমূল্য চন্দ্র বাসে আটকা পড়ে মারাত্মক দগ্ধ হন। অমূল্য চন্দ্র বর্মণের গ্রামের বাড়ি পঞ্চগড় জেলার ময়দানদীঘি ইউনিয়নের কাদেরপুর গ্রামে। বড় ছেলে নিতাই (১২), মেজ ছেলে রতন (৭) আর ছোট ছেলে জয় (২)। স্ত্রী রতœা এই তিন সন্তান নিয়ে গ্রামের বাড়িতে থাকেন। জীবিকার সন্ধানে গত ৬ বছর তিনি সিদ্ধিরগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় রিক্সা চালান। আহতের বন্ধু জাহিদুল ইসলাম জানান, অমূল্য অনেক দিন ধরে বাড়ি যায়নি। তিন ছেলেকে দেখতে গ্রামের বাড়িতে যাবার জন্য বেশ কয়েকদিন ধরে চেষ্টা চালাচ্ছিল। কিন্তু টানা অবরোধের কারণে যাওয়া হয়নি। পরে শুক্ররাতে ৫ বন্ধু মিলে সিদ্ধান্ত নেন বাড়ি যাওয়ার। সকলের সিদ্ধান্তে তাই বাধ্য হয়ে অবরোধের দিনেই শনিবার সকাল সাড়ে ৬টার দিকে অমূল্য ও তার ৪ বন্ধু মিলে গবতলী যাওয়ার উদ্দেশে সায়েদাবাদ থেকে ৮ নম্বর বাসে উঠেন। ৭টার দিকে বাসটি কাওরানবাজার সিগন্যাল অতিক্রম করে তেজগাঁও মহিলা কলেজের সামনে পৌঁছে। এ সময় একটি মোটরসাইকেলে দুই যুবক বাসটি উদ্দেশ করে পেট্রোল বোমা ছুঁড়ে মারে। এ সময় চার বন্ধু বাসের জানালা ভেঙে চলন্ত বাস থেকে বাইরে লাফিয়ে পড়ি। কিন্তু অমূল্য বের হতে পারেনি। বাসটি ওখানে স্টার্ট বন্ধ করে চালককে নিজেকে রক্ষা করেন। মুহূর্তে বাসে আগুন ধরে যায়। অমূল্য বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার শুরু করেন। ততক্ষণে সব শেষ। অমূল্যের পুরো শরীর পুড়ে গেছে। পরে ফায়ার সার্ভিসের একটি ইউনিট এসে বাসের আগুন নিভিয়ে অমূল্যকে উদ্ধার করে। উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করেন। অমূল্যের স্বজনরা অভিযোগ করেন, অবরোধে আগুনে অমূল্যের পুড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওদের সাজানো সংসার তছনছ হয়ে গেল। কে ওদের সংসার চালাবে। অবরোধকারী খুশিতে আছেন। ওদেরতো আর কেউ পুড়ে যায়নি। ভগবান ওদের বিচার করবে। মেধাবী ছাত্র অভির চোখ নষ্ট হয়ে গেছে ॥ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ১০৩ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি আছেন বুধবার রাতে রাজধানীর গুলিস্তানের বঙ্গবাজার সংলগ্ন এনএসকো টাওয়ারের সামনে ককটেল বিস্ফোরণে বাম চোখ নষ্ট হয়ে যাওয়া কবি নজরুল সরকারী কলেজের এইচএসসি শিক্ষার্থী অভি। সেদিন ককটেলটি তাঁর মুখে বিস্ফোরিত হয়। এ ঘটনায় তাঁর সঙ্গে থাকা বন্ধু জীবনও ককটেলের স্পিøন্টার আহত হন। চোখ ও মাথা স্পিøন্টার বিদ্ধ হওয়ায় ব্যান্ডেজ বাঁধা ছিল। কষ্ট ও যন্ত্রণায় হাসপাতালে বেডে বার বার সে ছটফট করছিল। আহত অভির বন্ধু জীবন জানান, তাঁরা তিন বন্ধু বঙ্গবাজারে কেনাকাটা করতে যান। রাস্তায় হাঁটতে থাকা অবস্থায় অভির মুখে এসে একটি ককটেল বিস্ফোরিত হয়। অপরটি বিস্ফোরিত হয় তার পাশে। এতে তিনিও আহত হন। অন্যদিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে এসে হরতাল-অবরোধের আগুনে ঝলসানো মানুষের মুখ দেখে হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করলেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান। তিনি বললেনÑ এ দৃশ্য দেখে স্বাভাবিক থাকা যায় না। যারা অবরোধ ডেকেছেন এবং যারা এই কর্মসূচীতে নাশকতা চালাচ্ছেনÑ তাদের সবার উদ্দেশে ‘হাতজোড় করে’ মিজানুর বলেন, সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে কেউ কোনদিন সফল হয়নি। আপনাদের কাছে মিনতি করছি, আপনারা আমাদের ভবিষ্যত নষ্ট করবেন না। বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা সাবেক পররাষ্ট্র সচিব রিয়াজ রহমানের ওপর হামলার ঘটনারও নিন্দা জানান মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান। একইসঙ্গে তিনি প্রশ্ন রাখেন, তাকে (রিয়াজ রহমান) দেখতে হাসপাতালে অনেকে গিয়েছেন। বিভিন্ন বক্তব্য-বিবৃতি দিয়েছেন। কিন্তু ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে থাকা রিক্সাচালক, ভ্যানচালক, শিক্ষিকা, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের দেখতে কয়জন এসেছেন? বার্ন ইউনিটের চিকিৎসক সামন্ত লাল সেন বলেন, গত ৫ জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ২২ জন দগ্ধ হয়ে তাদের কাছে চিকিৎসা নিতে এসেছেন। এদের মধ্যে ১২ জন এখনও ভর্তি আছেন। এদিকে এদিন নাশকতায় দগ্ধদের ঢামেক হাসপাতালে দেখতে যান পুলিশের নবনিযুক্ত আইজি এ কে এম শহিদুল হক। এ সময় বার্ন ইউনিটে দগ্ধদের চিকিৎসার খোঁজখবর নেন তিনি। সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে আইজি জানান, এর আগে তিনজন মারা গেছেন। আজ (বৃহস্পতিবার) একজন মারা গেলেন। আমি এখানে সহমর্মিতা জানাতে এসেছি। দগ্ধদের অবস্থা ভয়াবহ। চিকিৎসকরা তাঁদের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। প্রধানমন্ত্রীও দগ্ধদের চিকিৎসার খোঁজখবর নিচ্ছেন। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে আইজি জানান, নাশকতার সঙ্গে জড়িতদের ধরতে বিশেষ অভিযান চলছে। এ অভিযান জোরদার করা হয়েছে। এসব কাজে নিয়োজিতদের খুঁজে তদন্ত সাপেক্ষে আইনের আওতায় আনা হবে।
×