ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ ইসালে সওয়াব ও ওয়াজ মহফিল

প্রকাশিত: ০৩:০৭, ১৬ জানুয়ারি ২০১৫

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ ইসালে সওয়াব ও ওয়াজ মহফিল

ইসালে সওয়াব মহফিল আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে গেছে যুগ পরম্পরাগতভাবে। এই ইসালে সওয়াব মহফিলের অর্থ সওয়াব পৌঁছানোর সম্মেলন। সাধারণত বছরে একবার এই মহফিল বিশেষ করে বিভিন্ন পীর সাহেবের খানকা শরীফে অনুষ্ঠিত হয়, আবার কোথাও কোথাও উরস নামেও এই মিলন উৎসবেরও আয়োজন করা হয়। তবে লক্ষ্য করা গেছে উরসের নামে যেসব বার্ষিক মহফিল অনুষ্ঠিত হয় তার অধিকাংশই শিরক, কুফর বিদা’আত প্রভৃতি অনুষঙ্গ দ্বারা আচ্ছাদিত, যেখানে সওয়াব লাভের আশা করা দুরূহ হয়ে পড়ে। এর মানে এই নয় যে, সমস্ত উরসই ওই দোষে দুষ্ট। ৬ রজব আজমীর শরীফে সুলতানুল হিন্দ গরীবে নওয়াজ খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী রহমাতুল্লাহি আলায়হির মাযার শরীফে যে উরস হয় সেখানে মানুষ খাজা মঈনুদ্দীন চিশতীর মাযার শরীফ যিয়ারত করে বহু ফায়দা হাসিল করে। কিন্তু সেই উরসকে কেন্দ্র করে একশ্রেণীর শরী’আত ও মা’রিফাত সম্পর্কে অজ্ঞ মানুষ যে সমস্ত কার্যকলাপ করে তা শরী’আতসম্মত নয়। আমাদের দেশেও গজিয়ে ওঠা এমনকিছু খাজাবাবা, বিশ্বওলী সুফী সম্রাট, দয়াল বাবা লকবধারীদের কেন্দ্র করে মহাপবিত্র উরস শরীফের নামে যে সমস্ত কাণ্ড-কারখানা চালু আছে সেগুলোতে শরিক হয়ে মহা মূল্যবান ঈমান-আ’কিদা বরবাদ করা ছাড়া কোন লাভ হয় না, আবার এমন কিছু উরস অনুষ্ঠিত হয় যেখানে শরিক হলে রূহানী তরক্কী তো হয়ই সেই সঙ্গে ঈমান-আকিদা মজবুত বুনিয়াদ লাভ করে। যেমন প্রতি বছর ১৬ চৈত্রে অনুষ্ঠিত যশোরের খড়কী শরীফের উরস মুবারক। এই উরস শতাধিক বছর ধরে নির্দিষ্ট তারিখে হয়ে আসছে। এটার প্রতিষ্ঠা করেন বাংলা ভাষায় রচিত সর্বপ্রাচীন নির্ভরযোগ্য মৌলিক ও প্রামাণ্য তাসাওউফ গ্রন্থ এরশাদের খালেকীয়া বা খোদাপ্রাপ্তি তত্ত্ব গ্রন্থের লেখক হযরত মওলানা শাহ সুফী মোহাম্মদ আবদুর করিম রহমাতুল্লাহি আলায়হি। এই গ্রন্থ সম্পর্কে প্রফেসর সৈয়দ আলী আহসান ও প্রফেসর মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের যৌথ গ্রন্থনায় গ্রন্থিত বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত গ্রন্থের ইসলামী সাহিত্য পরিচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, আবদুল করিম ছিলেন নকশবন্দীয়া তরিকার একজন কামিল সুফী সাধক, নিজের জীবনে সুফীতত্ত্বের আমল করেছিলেন বলে দুরূহ সুফীতত্ত্ব সম্বন্ধে তাঁর গভীর জ্ঞান ছিল। প্রথম থেকে চতুর্থ অধ্যায়ে তিনি তাসাওয়াফের জটিল দার্শনিক তত্ত্বের মনোজ্ঞ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এবং পঞ্চম থেকে নবম অধ্যায়ে সুফী সাধনার নকশবন্দীয়া, কাদেরিয়া এবং চিশতিয়া তরিকার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেছেন। দশম বা শেষ অধ্যায়ে তিনি বেদ, পুরাণাদিতে প্রচলিত দার্শনিক বিষয়বস্তুর তত্ত্ব উদ্ঘাটন করে ইসলামী সুফী মতবাদের সঙ্গে তার একটি তুলনামূলক আলোচনা করেছেন। মোহাম্মদ আবদুল করিমের খোদাপ্রাপ্তি তত্ত্বের মতো বাংলায় তাসাওয়াফ সম্পর্কিত বই আর দ্বিতীয়টি দেখা যায় না। (বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত দ্বিতীয় সংস্করণ, পৃষ্ঠা-১৫৩)। এই গ্রন্থে উপযুক্ত পীরের লক্ষণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলা হয়েছে : ‘পীরকে লোভশূন্য হওয়া নিতান্ত আবশ্যক। লোভী ব্যক্তিকে ফকির জ্ঞান করিতে হবে না এবং ফকির কখনও ঢং করিয়া আর্থোপার্জনের জন্য বুজুর্গী করিয়া বেড়ায় না। তাঁহারা সততই গুপ্ত থাকিতে চেষ্টা পান, প্রকাশ হওয়াকে ভালবাসেন না। ... যার কোন রিপু বলবৎ আছে, তাহাকে সিদ্ধ ফকির বলিয়া জানিতে হইবে না। ... তাহাদের মিষ্টালাপন-কুহক জাল হতে সতর্ক থাকিবেন।’ আমাদের দেশে এক ধরনের উরসে লোক জড়ো করবার জন্য যেসব প্রচারণা কৌশল প্রয়োগ করা হয় তাতেই স্পষ্ট হয়ে যায় তাতে বেশ এক বড় ধরনের ‘কিন্তু’ রয়েছে। আর এই কিন্তুকে দূর করবার জন্য ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে ফুরফুরা শরীফের পীর মুজাদ্দিদে যামান মওলানা শাহ্ সুফী আবু বকর সিদ্দিকী রহমাতুল্লাহি আলায়হি ফাল্গুন মাসের ২১, ২২, ২৩ তারিখ নির্ধারণ করে ফুরফুরা শরীফে ইসালে সওয়াব ও ওয়াজ মহফিল কায়েম করেন যা আজও ওই তিন দিন ধরে সেখানে লাখ লাখ লোকের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। তিনি এই মহফিল সম্পর্কে বলেছেন : ‘আমি জানি, আল্লাহ্ বলিয়াছেন : ইয়া আইয়ুহাল লাযীনা আমানু কুও আনফুসাকুম ওয়া আহলীকুম্ নারা- হে ইমানদারগণ, তোমারা নিজেদিগকে ও নিজের পরিজনকে অগ্নি হতে রক্ষা কর।’ এই আয়াতের মর্ম অবলম্বনে আমার বাড়িতে দেশী-বিদেশী সকলকে আম দাওয়াত দিয়া বহু আলেম-ওলামা, হাফেজ, ক্বারী কর্তৃক ওয়াজ-নসিহত করাইয়া ও নিজে করিয়া, শরিয়তের হুকুম আহকাম জানাইয়া দেই। ... ৬০-৭০ খতম কুরআন শরীফ, সূরা এখলাছ ও ফাতেহা, কলেমা ইত্যাদি পড়ানো হয়। এই সমস্তের সওয়াব হযরত নবী (সা.)-এর ও যাবতীয় ওলি-আওলিয়া গওছ, কুতুব এবং যাবতীয় মুসলমানদের রুহের ওপর সওয়াব রেছানী করা হয়। এই জন্য এই মহফিলের এক নাম ইসালে সওয়াব। এই মহফিল যাহাতে আল্লাহ্ কায়েম রাখেন, তাহার চেষ্টা আমার পুত্রগণ, খলিফাগণ ও মুরিদগণ করিবেন। খলিফাগণের মধ্যে যদি কাহারও বাড়িতে এ রূপ মহফিল করিতে কাহারও শক্তি হয়, তবে তিনি তাহা করিবেন। সাবধান! কেহ যেন অর্থের লোভে বা অন্য কোনরূপ মান মর্যাদার জন্য না করেন। বিশুদ্ধ হেদায়েতের নিয়তে করিলে বহু নেকি পাইবেন। আরও সাবধান থাকিবেন যে, যেন এই মহফিলে কোন প্রকার বেদয়াত ও হারাম কার্য বা নামাজের জামায়াত তরক না হয়। বাজে তামাসা ইত্যাদি না হয়।’ (মওলানা মোহাম্মদ রুহুল আমিন, ফুরফুরা শরীফের হযরত পীর সাহেব কেবলার বিস্তারিত জীবনী, প্রথম সংস্করণ, কলিকাতা ১৯৩৯, পৃ-২৪২-২৪৩)। ফুরফুরা শরীফের মুজাদ্দিদে যামান হযরত মওলানা শাহ সুফী আবু বকর সিদ্দিকী (রহ.) তাঁর প্রধান প্রধান খলিফাগণের বাড়িতে তারিখ নির্ধারণ করে ইসালে সওয়াব ও ওয়াজ মহফিল কায়েম করে যান- যা আজও অব্যাহত রয়েছে, যেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে : শর্ষীনার ইসালে সওয়াব-যা অনুষ্ঠিত হয় ১৪, ১৫, ১৬ অগ্রহায়ণ যশোরের (বর্তমান মাগুরা জেলা) দ্বারিয়াপুর শরীফের ইসালে সওয়াব ও ওয়াজ মাহফিল যা প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় ৪ মাঘ। এ ছাড়াও কুমিল্লার ধামতিতে, যশোরের ইনায়েতপুরে, ফরিদপুরের ডোবরায়, পটুয়াখালীর আমতলীতে, সাতক্ষীরার হামিদপুরে, নোয়াখালীর শ্রীনদীতে এবং অন্যান্য প্রায় শতাধিক স্থানে ইসালে সওয়াব মহফিল অনুষ্ঠিত হয় বিভিন্ন তারিখে। ফুরফুরা শরীফের মুজাদ্দিদে যামানের অন্যতম প্রধান খলীফা দ্বারিয়াপুর শরীফের পীর সাহেব কিবলা হযরত মওলানা শাহ সুফী আলহাজ তোয়াজউদ্দীন আহমদ রহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁর পীরের নির্দেশে ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে যে ইসালে সওয়াব ও ওয়াজ মহফিল কায়েম করেন তা আজও ৪ মাঘ তারিখেই অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। ইসালে সওয়াব ও ওয়াজ মহফিলের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এতে খতমে কুরআন বহুবার করা হয়। এছাড়াও বাদ মাগরিব তরীকতের নিয়ম অনুযায়ী এক ঘণ্টারও অধিক সময় ধরে যিক্র-আযকার, তা’লীম-তালকীন প্রদান করা হয়। হাজার হাজার মানুষ যখন একযোগে অনুচ্চস্বরে আল্লাহ্ আল্লাহ্ নাম মুবারক যিকর করে, লাইলাহা ইল্লাল্লাহ যিক্র করে কিংবা জীবনের তাবত গোনাহর কথা স্মৃতিতে এনে তওবার ফয়েজ রপ্ত করে রব্বানা জলামনা আনফুসানা ওয়া ইল্লাম তাগফির লানা ওয়া তারহামনা লানা কুনান্না মিনাল খাসেরীন মনে মনে খেয়ালের সঙ্গে পাঠ করে এবং কাঁদতে থাকে তখন এক অনন্য পবিত্র পরিবেশ সমস্ত মহফিল আঙিনাজুড়ে প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে। ইশার নামায বাদ শুরু হয় বিভিন্ন আলিমের ওয়াজ-নসিহত যা রাতের শেষপ্রহর পর্যন্ত চলে, একপর্যায়ে তাহাজ্জুদ আদায় করা হয়, তারপর বিভিন্ন স্থানে একজন একজন দাঁড়িয়ে সুমধুর স্বরে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের প্রতি সালাত ও সালাম অর্থাৎ আস্সালাতু আস্সালামু আলায়কা ইয়া রসূলাল্লাহ পেশ করতে থাকে। তারপর ফজরের আযান হবার পর ফযরের নামায আদায় করা হয়, তার পর যিকর-আযকার, তারপর মিলাদ মহফিল ও কীয়াম অনুষ্ঠিত হয় অনন্তপক্ষে দু’ঘণ্টা ধরে, তারপর সওয়াব রিসানী হয় আখেরী মুনাজাতের মাধ্যমে। তামাম আম্বিয়া কেরাম, সাহাবায়ে কেরাম, শোহাদায়ে কেরাম, আজওয়াজে মুতাহিরা, আশারায়ে মুবাশশিরা, তাবেয়ীন, তাবে তাবেয়ীন, আইম্মায়ে মুজতাহিদীন, তরীকতের ইমামগণ সমস্ত ওলী আল্লাহগণ, মু’মিন-মুমিনাত, মুসলিমিন-মুসলিমাতসহ যাঁরা ইন্তিকাল করেছেন সবার রুহে সওয়াজ পৌঁছানো হয় এবং বিশ্বশান্তির জন্য বিশ্ব মানবতার কল্যাণের জন্যসহ তাবত বিষয়ে দু’আ করা হয়। এই সময় বিরাট সমাবেশে যে ক্রন্দনরোল ওঠে তা যেন আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করতে থাকে। এসব ইসালে সওয়াব মহফিলে শরী’আতবিরোধী কোন কিছু হয় না-হতেও পারে না। এসব ইসালে সওয়াব ও ওয়াজ মহফিলকে হিদায়াত লাভের উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়॥ বললেও অত্যুক্তি হয় না। প্রকৃতপক্ষে এই ধরনের মহফিল থেকে বহু লোক হিদায়াত লাভ করে নিজেদের জীবনকে ধন্য করেছে এবং হিদায়াত লাভ করে আসছে। ইসালে সওয়াব ও ওয়াজ মহফিল আয়োজনের মাধ্যমে মানুষকে আলোকিত পথের দিকে আহ্বান করা হয়। আল্লাহ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : উদ’উ ইলা রব্বিকা বিলহিকমাতি ওয়াল মাওইজাতিল হাসানা- মানুষকে তোমার রব্-এর পথে আহ্বান কর হিকমতের মাধ্যমে এবং সুন্দর সুন্দর ওয়াজ নসিহত দ্বারা। (সূরা নহ্ল : আয়াত-১২৫)। ইসালে সওয়াব ও ওয়াজ মহফিল ওই আয়াতেকারীমা পালনের এক অনন্য ব্যবস্থা হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে। লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ, উপদেষ্টা ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা.) সাবেক পরিচালক ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
×