ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আরএম দেবনাথ

‘পেটে মরছে চাষী মাঠে মরছে সবজি’

প্রকাশিত: ০৩:০৫, ১৬ জানুয়ারি ২০১৫

‘পেটে মরছে চাষী মাঠে মরছে সবজি’

চারদিকে নাশকতার খবর। অর্থনৈতিক খবরও কম নয়। নাশকতার ঘটনার মধ্যেই লুক্কায়িত আছে অর্থনীতির খবর। কিভাবে তা কয়েকটা খবরের শিরোনাম পাঠ করলেই বোঝা যাবে। একটি দৈনিকের খবরের শিরোনামগুলো হচ্ছে : ‘রাতে রাজপথে নাশকতা’, ‘দূরপাল্লার বাসে যাত্রী নেই ট্রেনের শিডিউলে বিপর্যয়’, ‘ট্যাক্সিক্যাবে আগুন দেয়ার সময় তিন দুর্বৃত্তকে গণপিটুনি’, ‘৮ ট্রাকে-বাসে আগুন, ৪০টি যান ভাংচুর’। আরেকটি দৈনিকের তিনটি শিরোনাম হচ্ছে- ‘২৪ গাড়িতে আগুন’, ‘ট্রেনের শিডিউল লণ্ড ভণ্ড’, ‘পেটে মরছে চাষী মাঠে মরছে সবজি’। যে কোন পাঠক শিরোনামগুলোর ভেতরের খবরে ঢুকলেই বুঝতে পারবেন প্রতিটি খবরের রয়েছে অর্থনৈতিক দিক। মজার বিষয় কেউ এ বিষয়ে ভাবি না। আমরা নাশকতার খবরকে শুধু নাশকতার খবর বলেই দেখি। দেখা যাক আমাদের উদ্ধৃত সর্বশেষ খবরটির শিরোনামটি। বলা হচ্ছে- পেটে মরছে চাষী মাঠে মরছে সবজি। আমরা জানি সারাদেশের বিভিন্ন জায়গায় এখন সবজি চাষ হয়। চাষ হয় মাছের। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জায়গা থেকে ঢাকায় সবজি আসে। কাঁচামরিচ, ফুলকপি, বেগুন, টমেটো, বাঁধাকপি ইত্যাদি সবজি আসে। ট্রাকভর্তি জলের টাটকা-জীবন্ত মাছ আসে উত্তরবঙ্গ থেকে। রুই-কাতলা ইত্যাদি মাছ। জীবন্ত মাছে এখন ঢাকার বাজার সয়লাব। ময়মনসিংহ অঞ্চল থেকে সবজি ও মাছ আসে। নরসিংদী, ভৈরব, কালীগঞ্জ, দোহার, নবাবগঞ্জ, বিক্রমপুর, মানিকগঞ্জ প্রভৃতি অঞ্চল থেকে ধরতে গেলে সারাবছর সবজি ও মাছ আসে। বস্তুত শীতকাল হচ্ছে সবজির মাস, মাছের মাস। এখন খেয়েদেয়ে সুখ। সরবরাহও প্রচুর, দামও কিছুটা সস্তা। অথচ ২০১৪ সালের শীত, ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাস কৃষকদের জন্য অভিশাপ হিসেবে নেমে এসেছে। কৃষকের সবজি জমিতে পড়ে রয়েছে, সবজি গঞ্জে-বাজারে পড়ে আছে। ‘বিএনপি’ আহূত অবরোধের ফলে পাইকাররা গ্রামে-গঞ্জে যেতে পারছেন না। ট্রাক-বাস, ভ্যান এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে পারছে না। সবজি কেন, কোন মালই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে পারছে না। পাইকার নেই, পরিবহন নেই, নগদ টাকা নেই। অবরোধের কারণে ব্যাংকে ব্যাংকে ‘ক্যাশ’ টাকার অভাব ঘটেছে। ‘রেমিট্যান্স’ বিঘ্নিত। সাধারণভাবে ব্যাংকের এক শাখা থেকে অন্য শাখায় ‘ক্যাশ’ পাঠানো হয়। শহর থেকে গ্রামের শাখায় টাকা পাঠানো হয়। অবরোধে এসব বন্ধ। একে তো পরিবহনের ব্যবস্থা নেই, দ্বিতীয়ত নেই পুলিশ প্রহরার ব্যবস্থা। পুলিশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাতে ব্যস্ত। ফলে গ্রামাঞ্চলের লেনদেন দারুণভাবে বিঘ্নিত। মাল আছে, সবজি আছে, মাছ আছে কিন্তু পরিবহন নেই, পাইকার নেই, ক্যাশ টাকা নেই। এর জন্যই খবরের শিরোনাম ‘পেটে মরছে চাষী মাঠে মরছে সবজি’। উল্লেখ্য, এর মধ্যেই লুক্কায়িত আরেকটি অর্থনৈতিক খবর। আর সেটা হচ্ছে পরিবহন খাতের। বর্তমান অবরোধে ক্ষতিগ্রস্ত আরেকটি বড় ব্যবসায়িক খাত হচ্ছে পরিবহন খাত- বাস, ট্রাক, লরি, মোটর লঞ্চ, কাভার্ডভ্যান ইত্যাদি। বিমান পরিবহনও। বাংলাদেশে কত সংখ্যক বাস, ট্রাক, লরি, কাভার্ডভ্যান আছে তার হিসাব দেয়া কঠিন। তবে ব্যবসায়ীরা দাবি করেন প্রায় দুই লাখ বাস, ট্রাক, লরি, কাভার্ডভ্যান আছে। প্রতিটি যানে যদি চারজন করে কর্মচারী ধরে হিসাব করি তাহলে ৮ লাখ শ্রমিক এই খাতে নিয়োজিত। তার মানে ৮ লাখ পরিবার। তার মানে ৪ জন ধরে হিসাব করলে ৩২ লাখ মানুষ। এদের জীবন আজ অনিশ্চিত। রোজগার নেই, আয় নেই। এর অর্থ এদের ঘর-সংসার চলছে না। যাদের চলবে তাদের সঞ্চয় ভেঙ্গে খেতে হবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধারদেনা করে চলতে হবে এবং আমি নিশ্চিত এ ধকল কাটিয়ে উঠতে ড্রাইভার-হেলপার-কর্মচারীদের অনেক দিন লাগবে। এটা তো গেল পরিবহন মালিকদের কথা। প্রতিটি পরিবহনের পেছনে রয়েছে ব্যাংকের অর্থায়ন। ওই অর্থের বা ঋণের টাকার অবস্থা কি হবে? ২০১২-১৩ সালে হরতাল-অবরোধের ধাক্কাই ব্যাংকগুলো সামলাতে পারছে না। তার ওপর নতুন ধাক্কা। এতে ব্যাংকের খেলাপী ঋণ বাড়বে বৈ কমবে না। পরিবহন মালিকরা পড়বেন নতুন বিপদে। ঋণের ওপর সুদের বোঝা, সুদের ওপর সুদের বোঝা। পরিবহন খাত বিপর্যস্ত করে দিয়েছে আরেকটি উদীয়মান খাতকে। আমাদের পর্যটন শিল্পটি ধীরে ধীরে গড়ে উঠছিল। হয় না, হয় না, যে খাত সেই পর্যটন খাতটি উদীয়মান মধ্যবিত্তের হাত ধরে ধীরে ধীরে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছিল। পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সিলেট, খুলনা, কুয়াকাটা প্রভৃতি অঞ্চলে মানুষ এখন বেড়াতে যায়। বলাবাহুল্য এই সময়টা বেড়ানোর সময়। জানুয়ারি-মার্চ পর্যটনের মাস। দু’দিন যাবতই চট্টগ্রামের পর্যটন ব্যবসায়ীরা, হোটেল মালিকরা টেলিভিশনে তাদের কষ্টের কথা জানাচ্ছেন। তাঁদের যত বুকিং আছে সব পালাক্রমে বাতিল হচ্ছে। আমি দুটো হোটেলের কথা জানি এবং তা অবশ্যই কক্সবাজারের। এরা গত বছর তাঁদের ঋণের পুনঃতফসিল (রিসিডিউলিং) করিয়ে নিয়েছেন। আমি নিশ্চিত বর্তমান অবরোধ চললে তাঁরা আবার বিপদে পড়বেন। বর্তমান নিয়মে তিনবারের বেশি ঋণ পুনঃতফসিল হবে না। ইতোমধ্যেই তাঁদের দু’বার পুনঃতফসিল হয়ে গেছে। তাঁদের জন্য অপেক্ষা করছে মহাবিপদ। বর্তমান অবরোধে বহু ব্যবসায়ী-শিল্পপতি ঋণ পুনঃতফসিলের সমস্যায় পড়বেন। রাজশাহী অঞ্চলে বহু পোল্ট্রি আছে। গতবার (২০১২-১৩) অবরোধের সময় লোকসানে পড়ে অনেক খামার বন্ধ হয়েছে। খামারিরা বলছেন খামার ছিল ৪০০০। এখন বন্ধগুলো বাদ দিয়ে রয়েছে ২০০০ খামার। এসব পোল্ট্রিতে খাবার নেই এখন, ওষুধ নেই, ডিম বিক্রি হচ্ছে না। কারণ পরিবহনের কোন ব্যবস্থা নেই। ফাঁকে ফাঁকে যখন পরিবহন পাওয়া যায় তখন তার ভাড়া দ্বিগুণেরও বেশি। যানবাহন ভাঙ্গা হচ্ছে, আগুন দেয়া হচ্ছে। ড্রাইভার-হেলপার-শ্রমিকদের পেটানো হচ্ছে। অনেকেই হচ্ছে অগ্নিদগ্ধ। ফল? ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ যাতায়াত ব্যবস্থা। এর ফল? ফল, ঝুঁকি নিয়ে যারা গাড়ি চালাবে তার ভাড়া দ্বিগুণ-তিনগুণ। অতএব মালের দাম বৃদ্ধি- এই আর কী। এদিকে দেখা যাচ্ছে ঠিক ২০১৩ সালের শেষের দিকের মতো অবস্থা। রেল চলাচল বিঘিœত। রেলের ‘ফিসপ্লেট’ তুলে নেয়া হচ্ছে। যাত্রী পরিবহন বিঘিœত। ট্রেনের ‘সিডিউল’ বলতে কিছু নেই। কোন্ গাড়ি কখন যাবে তার কোন ঠিক নেই। গাড়ি দুর্ঘটনায় লোক নিহত হচ্ছে, আহত হচ্ছে। রেলের ক্ষতিসাধিত হচ্ছে। সবই আর্থিক ক্ষতি। রেল চলছে না, ট্রাক-বাস চলছে না, আন্তঃজেলা পরিবহন বিঘিœত হওয়ায় যথারীতি আরেকটি খাত দারুণভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছে। আর সেটি হচ্ছে পোশাক রফতানি। পোশাক রফতানি ব্যবসায়ীরা ইতোমধ্যে তাঁদের বিপর্যয়ের কথা দেশবাসীকে জানিয়েছেন। তাঁরা সংগঠিত। তাঁরা তাঁদের লোকসানের কথা জানাতে পারছেন। দিনে কত রফতানি বিঘ্নিত হচ্ছে তার খবর তাঁরা দিতে পারছেন। কিন্তু যে আশঙ্কাটি তাঁরা করছেন সেটি বাংলাদেশেরও। রফতানি অর্ডার বাতিলের আশঙ্কা রয়েছে। ‘রানা প্লাজা’ ধস, পোশাক শিল্পের নানাবিধ ‘কম্পøায়েন্স’ ইস্যুতে এমনিতেই আমাদের রফতানির প্রবৃদ্ধি শ্লথ হয়ে উঠেছে। ২০১৩ সালের ধকল তো রয়েছেই। এর মধ্যে বর্তমান অহেতুক অবরোধ। বলাবাহুল্য পোশাক রফতানিই আমাদের এক নম্বর রফতানি দ্রব্য। এটি আমাদের অর্থনীতির লাইফলাইন। অন্য লাইফলাইন হচ্ছে রেমিট্যান্স। রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধির হার আগের মতো নয়। এরপর যদি পোশাক রফতানিতে ভাটা পড়ে তাহলে অর্থনীতির জন্য সেটা হবে বড় দুঃসংবাদ। পোশাক রফতানির এই দুঃসংবাদের পাশাপাশি খবর দেখলাম আরেকটা। সেটা হচ্ছে জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থা। জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে সারাদেশে। পর্যাপ্ত ওয়াগন না থাকায় চট্টগ্রাম থেকে রংপুর ও সিলেট অঞ্চলে তেল পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। অবরোধের কারণে পুলিশ প্রহরাও পর্যাপ্ত পাওয়া যাচ্ছে না। এটিও এক্ষেত্রে আরেকটি বাধা। ‘বিএনপি’ আহূত অবরোধের অষ্টম দিনেই অর্থনীতির এ অবস্থা। কৃষি বিপর্যস্ত হওয়ার আশঙ্কা। রফতানির ক্ষেত্রে অশনি সঙ্কেত। পর্যটন শিল্পে ধস। পরিবহন খাত ক্ষতিগ্রস্ত। দৈনন্দিন বেচাকেনা সর্বনিম্ন পর্যায়ে। ঢাকার বাজার মন্দা। প্রতিদিন লোক রাস্তায় বেরোচ্ছে অজানা আশঙ্কার মধ্যে। চোরাগোপ্তা হামলায় কার প্রাণ যায় কখন। কার গাড়ি কখন পোড়ে। যে কেউ হতে পারে অগ্নিদগ্ধ, গুলিবিদ্ধ। যে কোন বাড়িতে পটকা পড়তে পারে। এ ধরনের ঘটনা ঘটছে কখন, যখন দেশীয়ভাবে উন্নয়নের একটা হাওয়া লেগেছে। শুধু দেশীয়ভাবে নয়, আন্তর্জাতিকভাবেও অর্থনৈতিক মন্দা চলে যেতে শুরু করেছে। বহুদিন পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মঙ্গা কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছে। তাদের প্রবৃদ্ধি তিন শতাংশের ওপরে হবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করা হচ্ছে। প্রতিবেশী ভারতেও প্রবৃদ্ধির হার ৬-৭ শতাংশ হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অর্থনীতির অবস্থাও ভাল। চীনের প্রবৃদ্ধির হার ৭-৮ শতাংশ হবে বলে চীন জানিয়েছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এসব হচ্ছে অর্থনীতির সুবাতাস। আমাদের প্রবৃদ্ধির হারও সাড়ে ছয় শতাংশ হবে বলে প্রাক্কলিত আছে। সবচেয়ে বড় কথা, আন্তর্জাতিক অনুকূল পরিবেশের সঙ্গে আমাদের জন্য আরও একটি বড় খবর ছিল। তেলের দাম এখন বিশ্ববাজারে সর্বনিম্ন। এটা আমাদের জন্য বড় সুখবর। ভর্তুকির দৃষ্টিকোণ থেকে, সরকারের খরচের দৃষ্টিকোণ থেকে এগুলো স্বস্তির খবর। আমাদের হাতে রয়েছে বড় কয়েকটি প্রকল্প। পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে সম্পস্রারণ, ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়ক সম্প্রসারণের কাজ হাতে। বিদ্যুতের প্রকল্প রয়েছে। গ্যাসের প্রকল্প রয়েছে। এক কথায় উন্নয়নের একটা টেম্পো এসেছে। তেলের মূল্য হ্রাস একটা স্বস্তি দিয়েছে। মূল্যস্ফীতি সর্বনিম্ন। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ সর্বোচ্চ। রেমিট্যান্সের প্রবাহটা ঠিক আছে। পোশাক শিল্পের অবস্থা স্থিতিশীল। এমন একটা পরিস্থিতিতে বর্তমান অবরোধ কর্মসূচী। কিসের জন্য? নির্বাচন দিতে হবে। এর জন্য রাস্তা অবরোধের দরকার আছে কি? নির্বাচনের দাবিতে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হবে কেন? নির্বাচনের জন্য গাড়ি-ঘোড়া পোড়ানো হবে কেন? বাড়িতে আগুন দেয়া হবে কেন? মানুষ পোড়ানো হবে কেন? রেললাইন উপড়ানো হবে কেন? শত প্রশ্ন আজ জনমনে। লেখক : সাবেক প্রফেসর বিআইবিএম
×