ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

একদার মুক্তিবাহিনী হাসপাতালের করুণ হাল ॥ নিজেই খুঁড়িয়ে চলছে প্রথম কৃত্রিম অ

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ১৫ জানুয়ারি ২০১৫

একদার মুক্তিবাহিনী হাসপাতালের করুণ হাল ॥ নিজেই খুঁড়িয়ে চলছে প্রথম কৃত্রিম অ

আনোয়ার রোজেন ॥ ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলার গোরাই গ্রামের তরুণ মিথুন দাস (২১)। বছর দুয়েক আগে এক সড়ক দুর্ঘটনায় মিথুনের বাঁ পা কাটা পড়ে। তার দিনমজুর বাবা হরিহর দাস (৫৫) ছেলের চিকিৎসার ব্যবস্থা টেনেটুনে করতে পারলেও কৃত্রিম পা সংযোজন করানোর সামর্থ্য তার নেই। তাই আশায় বুক বেঁধে ছেলেকে নিয়ে দরিদ্র হরিহর মঙ্গলবার আসেন রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর), যা পঙ্গু হাসপাতাল নামেই দেশব্যাপী পরিচিত। হাসপাতালের আর্টিফিসিয়াল লিম্ব এ্যান্ড ব্রেস সেন্টার (কৃত্রিম অঙ্গ সংযোজন কেন্দ্র) থেকে নামমাত্র খরচে রয়েছে কৃত্রিম পা সংযোজনের ব্যবস্থা। কিন্তু পঙ্গু মিথুনের বিধিবাম! তিনি জানতে পারলেন, গত চার বছর ধরে বন্ধ রয়েছে কৃত্রিম অঙ্গ সংযোজন কেন্দ্রের কার্যক্রম। দক্ষ লোকবল না থাকায় কৃত্রিম অঙ্গের উৎপাদন বন্ধ রয়েছে দীর্ঘ এক যুগ। তাই একমাত্র সরকারী এই পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান থেকে মিথুনকে ফিরে যেতে হয়েছে এক পা নিয়ে, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। কেন্দ্রটির অবস্থাও ঠিক একই রকম। মিথুনের মতো আরও অনেকেই কৃত্রিম অঙ্গ সংযোজনের আশায় এখানে এসে ফিরে যান ব্যর্থ মনোরথে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দক্ষ ও প্রশিক্ষিত লোকের অভাব, জনবল নিয়োগে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং কৃত্রিম অঙ্গ উৎপাদন ও সংযোজনের জন্য প্রয়োজনীয় আধুনিক যন্ত্র ও প্রযুক্তি না থাকায় দেশের প্রথম কৃত্রিম অঙ্গ সংযোজন কেন্দ্রটি মুখ থুবড়ে পড়েছে। অথচ একই সময়ে দেশে বেসরকারী উদ্যোগে একাধিক কৃত্রিম অঙ্গ সংযোজন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে, যা সরকারী কেন্দ্রটির তুলনায় বহুগুণ ব্যয়বহুল। ফলে স্বল্প খরচে কৃত্রিম অঙ্গ সংযোজনের সেবা পাওয়ার বদলে রোগীরা ব্যয়বহুল চিকিৎসা নিতে বাধ্য হচ্ছেন। পঙ্গু হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, কৃত্রিম অঙ্গ সংযোজন কেন্দ্রের ১২ পদের মধ্যে একমাত্র টেকনিশিয়ান ছাড়া সবাই অবসরে চলে গেছেন অনেক আগেই। কেন্দ্রে বর্তমান কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা মাত্র চার। সেন্টারের ম্যানেজার মোজাহার মোল্লা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে বদলি হয়ে এসেছেন রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর। সেন্টারের দায়িত্ব সামলানোর জন্য যে ধরনের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও কারিগরি জ্ঞান থাকা দরকার মোজাহার মোল্লার তা নেই। এর ওপর তারও অবসরে যাওয়ার সময় এসেছে। পিতার চাকরির সুবাদে সুযোগ পাওয়া মুকলাল রবিদাশ কেন্দ্রের একমাত্র লেদার ওয়ার্কার। এছাড়া কার্পেন্টার পদে রয়েছেন দুইজন। এর মধ্যে অবসরে যাওয়ার অপেক্ষায় আছেন একজন। সেন্টারে অনুমোদিত পদের মধ্যে লিম্ব মেকারের আটটি, লেদার ওয়ার্কার একটি, কম্পোজিটর একটি ও কার্পেন্টারের একটি পদ বর্তমানে খালি রয়েছে। প্রসঙ্গত, মহান মুক্তিযুদ্ধের পর যুদ্ধাহতদের চিকিৎসার জন্য ১৯৭২ সালে মুক্তিবাহিনী হাসপাতাল নামে যাত্রা শুরু হয় এ অর্থোপেডিক হাসপাতালের। প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই সচল ছিল কৃত্রিম অঙ্গ সংযোজন কেন্দ্র। প্রথম বছরেই কেন্দ্রে যুদ্ধাহতদের জন্য ১০০ কৃত্রিম অঙ্গ তৈরি হয়। এরপর গত চার দশকে হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগের উন্নয়ন হলেও কেন্দ্রটি তাল মিলিয়ে এগোতে পারেনি। শুরুটা ১০০ শয্যায় হলেও বর্তমানে হাসপাতালটির শয্যা সংখ্যা ৫০০। নতুন আরও ৫০০ শয্যা বাড়ানোর পরিকল্পনাও নেয়া হয়েছে। শুধু আমাদের দেশে নয়, উপমহাদেশের অর্থোপেডিক হাসপাতালগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। ২০০০ সালে এই হাসপাতাল থেকে সেবা নেয়া রোগীর সংখ্যা ছিল ৫৭ হাজার ৪৪৮। সে বছর মোট অস্ত্রোপচার হয় ১৩ হাজার ৪২২। একযুগ পর রোগীর সংখ্যা ও অস্ত্রোপচার সংখ্যায় দুটোই বেড়েছে দ্বিগুণ। সর্বশেষ ২০১৩ সালে এক লাখ ৩৫ হাজার ৬০৯ রোগী এ হাসপাতাল থেকে সেবা নিয়েছেন। ওই বছর মোট অস্ত্রোপচার হয়েছে ২৫ হাজার ৫১৫। অথচ এ দীর্ঘসময়ে অবহেলায় ও তদারকির অভাবে বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে কেন্দ্রটি। দীর্ঘদিন অচল থাকায় এ পর্যন্ত মোট কত রোগী এ কেন্দ্র থেকে সেবা নিয়েছেন তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। সর্বশেষ ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ অনুরোধে থাইল্যান্ড সরকার এই হাসপাতালে রানা প্লাজাসহ বিভিন্ন দুর্ঘটনায় আহত ১০৭ জনকে বিনামূল্যে কৃত্রিম পা সংযোজনের ব্যবস্থা করে। সে সময় থাই রাজকুমারীর অর্থায়নে পরিচালিত প্রসথেসিস ফাউন্ডেশন হাসপাতালের কৃত্রিম অঙ্গ সংযোজন কেন্দ্রটি পুরোদমে চালু ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণের প্রস্তাব দেয়। সে অনুযায়ী গত বছরের জুলাইয়ে প্রথম দফায় চারজনকে প্রশিক্ষণের জন্য থাইল্যান্ডের চেনমাইয়ে পাঠানোর কথা থাকলেও যান মাত্র দুইজন। এদের মধ্যে কেন্দ্রের ম্যানেজার গত নবেম্বরে প্রশিক্ষণ শেষ করে দেশে ফিরলেও লেদার ওয়ার্কার মুকলাল রবিদাশ অসুস্থ হয়ে প্রশিক্ষণ শেষ না করেই দেশে ফেরেন। বর্তমানে আবুল কালাম আজাদ (অস্ত্রোপচার সহকারী, আগে ছিলেন ওয়ার্ডবয়) প্রশিক্ষণের জন্য থাইল্যান্ডে অবস্থান করছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রশিক্ষণ শেষ না করে তিনিও দেশে ফেরার জন্য হাসপাতালের পরিচালকের কাছে কয়েক দফা চিঠি লিখেছেন। এ অবস্থায় মঙ্গলবার হাসপাতালটি ঘুরে দেখা যায়, পুরো হাসপাতালে ভিড় থাকলেও নিচতলায় ১০২ নম্বর কক্ষে আর্টিফিসিয়াল লিম্ব এ্যান্ড ব্রেস সেন্টারটি ফাঁকা। সেন্টারের ব্যবস্থাপক, একজন লেদার ওয়ার্কার ও দুই কার্পেন্টার অলস সময় পার করছেন। কেন্দ্রের ভেতরে বসানো পুরানো সব যন্ত্রপাতি প্লাস্টিকের বস্তা দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে দুই রোগী এসে কৃত্রিম অঙ্গ সংযোজনের ব্যাপারে জানতে চাইলে কেন্দ্রটি বর্তমানে বন্ধ রয়েছে বলে তাদের জানানো হয়। এ সময় সেন্টারের ব্যবস্থাপক মোজাহার মোল্লা জনকণ্ঠকে বলেন, প্রতিবছর প্রায় ৩৫০ থেকে ৪০০ মানুষ বিভিন্ন দুর্ঘটনায় পা হারান। তাদের সবারই কৃত্রিম পায়ের সাহায্যে পঙ্গুত্বের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার সুযোগ থাকে। কিন্তু এখানে আগের সব টেকনিশিয়ান-কর্মচারী অবসরে যাওয়ায় কৃত্রিম অঙ্গ উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর ঢাকা মেডিক্যাল থেকে আমাকে এখানে বদলি করে পাঠানো হয়। লোকবল না থাকায় কেন্দ্রের কার্যক্রম চালানো যাচ্ছে না। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুরোধে থাইল্যান্ডের প্রসথেসিস ফাউন্ডেশন কেন্দ্রটি চালু করতে কারিগরি সহযোগিতা ও প্রশিক্ষণ দিতে রাজি হয়েছে। কিন্তু প্রশিক্ষণের জন্যও পর্যাপ্ত লোক পাঠানো যাচ্ছে না। দাতব্যসংস্থা পক্ষাঘাতগ্রস্তদের জন্য পুনবার্সন কেন্দ্র (সিআরপি) গত বছর সাভারে কৃত্রিম অঙ্গ সংযোজনের জন্য একটি প্রস্থেটিকস ও অর্থোটিকস স্কুল চালু করেছে। এছাড়া রাজধানীর মোহাম্মদপুরে বেসরকারী সংস্থা ব্র্যাকের একটি অলাভজনক লিম্ব এ্যান্ড ব্রেস সেন্টার (বিএলবিসি) চালু রয়েছে। বিএলবিসি সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে (২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল) সংস্থাটি হতে দুই হাজার ৯২ বিভিন্ন কৃত্রিম অঙ্গ সংযোজন করে। এর মধ্যে ২০০৯ সালে ৪৭৯, ২০১০ সালে ৫০০, ২০১১ সালে ৪৩২, ২০১২ সালে ৪১১ ও ২০১৩ সালে ২৭০ জন বিভিন্ন কৃত্রিম অঙ্গস্থাপন করে। আর ২০১৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত এ সংখ্যা ২৫৪। বিএলবিসির সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডাঃ মোঃ শাহিনুল হক জানান, ১৯৯৭ সাল থেকে তারা অলাভজনকভাবে এই কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন। এই সুবিধা আগে স্বল্পমূল্যে পঙ্গু হাসপাতালে পাওয়া যেত, এখন নেই। এই সুযোগে অনেকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান খুলে বসেছে। একটি কৃত্রিম পা তৈরিতে যদি এক লাখ টাকা ব্যয় হয়, তবে ব্যবসায়ীরা এর জন্য রোগীদের কাছ থেকে তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করে থাকেন। জানা গেছে, সরকারী লিম্ব সেন্টারটি বন্ধ থাকার সুযোগে নিটোরের আশপাশে কৃত্রিম অঙ্গ তৈরির জন্য বাণিজ্যিকভাবে গড়ে উঠেছে কমপক্ষে ১০ প্রতিষ্ঠান। সরকারী হাসপাতালে কৃত্রিম অঙ্গ তৈরি না হওয়ার সুযোগ নিয়ে এসব প্রতিষ্ঠান রোগীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। সরেজমিনে দেখা যায় এসব প্রতিষ্ঠানে ট্রেলার ব্রেস সার্জিক্যাল জুতো, কোমরের বেল্ট, পেলভিক ট্রাকসন, সারভাইক্যাল কলার, কৃত্রিম পা, ক্র্যাচ প্রভৃতি আইটেম তুলনামূলক অনেক বেশি দামে বিক্রি হয়। নিটোর সূত্রে জানা গেছে, লিম্ব সেন্টারটি যখন চালু ছিল তখন হাঁটুর উপরের অংশের প্রসথেসিসের জন্য ব্যয় হতো মাত্র ৫৫০ টাকা অথচ এই একই প্রসথেসিসের জন্য বর্তমানে ওসব বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রোগীদের কাছ থেকে ১৫-২০ হাজার টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নিচ্ছে। সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ হামিদুল হক খন্দকার জনকণ্ঠকে বলেন, দক্ষ জনবলের অভাবই কেন্দ্রটির দুরবস্থার মূল কারণ। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কেন্দ্রটি পুরোপুরি চালুর ব্যাপারে আন্তরিক উদ্যোগ নিয়েছেন। লোকবল নিয়োগে অনুমোদন পাওয়া গেছে। শীঘ্রই পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয়া হবে। গত শতাব্দীর আশির দশক থেকেই কেন্দ্রটি ধুঁকছে। সম্প্রতি রানা প্লাজা দুর্ঘটনার সময় থাইল্যান্ড থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এসে এখানে কাজ করেছেন। সেখানকার প্রসথেসিস ফাউন্ডেশন একটি প্রকল্পের আওতায় কেন্দ্রটি চালুর ব্যাপারে কারিগরি ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান এবং প্রশিক্ষণ দিতে রাজি হয়েছে। চলতি সপ্তাহেই থাই দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসে প্রকল্পটি চূড়ান্ত করা হবে। আশা করি দুই-তিন মাসের মধ্যেই কেন্দ্রটি আবার পুরোদমে চালু করা যাবে।
×