ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

মিলু শামস

ইতিহাসের সঙ্গে ক’দিন

প্রকাশিত: ০৩:৩৭, ১৪ জানুয়ারি ২০১৫

ইতিহাসের সঙ্গে ক’দিন

কনট প্লেসের ‘হলদিরাম’ থেকে বেরিয়ে অদ্ভুত দুর্যোগের মুখে স্তম্ভিত সবাই। হলদিরামে ঢুকেছিলাম রাত ন’টার দিকে। তখনও সব স্বাভাবিক। শীতের প্রকোপ বেশি হলেও হাড় কাঁপানো নয়। জিন্স-গরম কোট-টুপিতে কুলিয়ে যাচ্ছে। খেয়ে বেরোতে প্রায় এগারোটা। হলদিরাম চত্বর পেরিয়ে খানিক এগুতেই ঘন কুয়াশা গ্রাস করে চারপাশ। একগজ দূরের জিনিসও দেখা যাচ্ছে না, সব গাড়ির ইমার্জেন্সি লাইট জ্বলছে। খুব কাছে না গেলে তাও চোখে পড়ে না। আবার অতটা কাছে যাওয়াও বিপজ্জনক। অভিনব এক পরিস্থিতি। কুয়াশা যে এমন দুর্যোগ ডেকে আনতে পারে আগে জানা ছিল না। দিল্লী সম্পর্কে বাঙালীর মনে ধারণা জন্মাতে যাযাবরের অবদান অপরিসীম। এর তাপমাত্রা সম্পর্কেও। এখন অবশ্য গুগল সার্চে মুহূর্তেই প্রতিদিনের আবহাওয়ার খবর জানা যায় তবে তা তথ্য মাত্র। ব্রিটিশ পরিকল্পনায় নির্মিত নতুন দিল্লী। তার পশ এলাকা কনট প্লেস। সেখানকার সৌন্দর্য বাড়াতে লাগানো হয়েছে ঘাস। ঘাস পরিচর্যায় সূর্যের আলোর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে যাযাবর যে রস পরিবেশন করেছেন, গুগলের সাধ্য নেই তার ইউজারকে এর স্বাদ দেয়া। এ জন্য পড়তেই হবে ‘দৃষ্টিপাত’ উনিশ শ’ ছেচল্লিশে লেখা- ‘গ্রীষ্মকালে সূর্যের তাপ সেখানে একশ’ তেরো ডিগ্রীতে ওঠে এবং সারা বছরে যে দেশে মাত্র কুড়ি ইঞ্চি বৃষ্টি হয়, সে দেশে ঘাস জন্মাতে প্রয়াসের প্রয়োজন। নয়াদিল্লীর কনট প্লেসের প্রত্যেকটি ঘাস হাতে করে বোনা এবং হাতে ধরে বাঁচানো। তার জন্য সরকারী হর্টিকালচার ডিপার্টমেন্ট থেকে যে পরিমাণ যত্ন, জল ও অর্থ ব্যয় করা হয়, সে-হিসাবটা যে-কোন দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকের জ্বালাময়ী প্রবন্ধ রচনার উপাদান হতে পারে।’ এখন সে ঘাস নেই, পরিচর্যার ঘটাও নেই। ব্রিটিশ তো নেইই। একই স্থাপত্য নকশার দৃষ্টিনন্দন ভবনগুলো রয়েছে শুধু। ঘাস নেই, গাছ নেই বলেই কি কুয়াশার এ ঘনঘটা? গাড়ির ভেতর শঙ্কায় জড়োসড়ো স্তব্ধতার গুমোট ভাঙায় সেন্স অব হিউমার। ‘মোদির এ্যাম্বুশ নয় তো, বাংলাদেশ থেকে এসেছি বলে? ‘যেভাবে ঘর ওয়াপসি’ চলছে! হাসির ঝড় ওঠে। মোদির হোক বা প্রকৃতির, ঠেলা সামলাচ্ছে সায়েফ। সেই কর্ণধার এ যাত্রায়। ড্রাইভিংয়ে দক্ষ সায়েফ আমাদের বন্ধু। বহুজাতিক কোম্পানির উঁচু পদে কাজ করে। দিল্লী থেকে তিরিশ মাইল দূরে গুরগাঁওয়ে পোস্টিং। আমরা এসেছি শুনে স্ত্রী উর্মিলাকে নিয়ে দেখা করতে এসেছে। শেষ পর্যন্ত সায়েফ আমাদের নিরাপদে হোটেলে নামিয়ে দেয়। সেদিন গুরগাঁওয়ে পৌঁছাতে ওদের চার ঘণ্টা লেগেছিল। যে সময়ে ওরা রওয়ানা করেছিল অর্থাৎ রাত বারোটার পর দিল্লী থেকে গুরগাঁও পৌঁছাতে সময় লাগে আধা ঘণ্টা। সায়েফ জানাল দিল্লীর বেশিরভাগ বহুজাতিক কোম্পানি এমন কি সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠানও এখন গুরগাঁওকেন্দ্রিক। দিল্লীতে নতুন প্রতিষ্ঠান হচ্ছে না বললেই চলে। রাজধানীর ওপর চাপ কমাতে এ ব্যবস্থা। পরে দিল্লী থেকে আগ্রার পথে যেতে হাইওয়ের পাশে স্যাটেলাইট সিটি নির্মাণের আরও উদ্যোগ দেখে মনে হয়েছে এমন উদ্যোগ আমাদের ঢাকার জন্য বহু আগেই জরুরী হয়েছে। রাজধানী হিসেবে নতুন দিল্লীর যাত্রা উনিশ শ’ এগারোয়। কলকাতা থেকে স্থানান্তরের কাজটি করেছিলেন রাজা পঞ্চম জর্জ। এই সেদিনের কথা। ঢাকার তুলনায় নতুন দিল্লীর ইতিহাস একেবারে সাম্প্রতিক। তারপরও রাজধানীর জীবনধারা স্বাভাবিক রাখতে আগে থেকেই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা এবং সে অনুযায়ী এগিয়ে চলছে ওরা। আর গর্ব করার মতো প্রাচীন ঐতিহ্যের শহর ঢাকাকে যথেচ্ছভাবে নষ্ট করছি আমরা। রাজধানী সুরক্ষা বা বাসযোগ্য রাখার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই। যেটুকু আছে তা কাগজে কলমে। পুরান দিল্লীর আবহে মুঘলরাই এখনও প্রাধান্যে। তাদের স্থাপনাগুলো অপূর্ব নান্দনিকতায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে। যদিও সবখানে অযতেœর ছাপ প্রকট, তারপরও ওতে যে শিল্পীর নিপুণ হাতের ছোঁয়া, যতœ ও অপরিসীম মমতার স্পর্শ রয়েছে তা আড়াল হয়নি। মুঘলদের মতো এত আড়ম্বর করে আর কেউ সম্ভবত সমাধি গড়েনি। দিল্লীতে হুমায়ুনের সমাধি, আগ্রায় তাজমহল, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আরও অনেক সমাধি রয়েছে মুঘলদের। এখনকার বিচারে জায়গার অপচয় মনে হলেও শৈল্পিক মান অস্বীকার করা যায় না। যাযাবর ঠিকই বলেছেন, ‘মুসলমানেরা প্রিয়তম-প্রিয়তমার স্মৃতিকে করতে চেয়েছে কালজয়ী। রাখতে চেয়েছে স্মারকচিহ্ন। তাই সৌধ গড়েছে পিতার, পতির, পত্নীর, এমনকি উপপতœীর সমাধিতে। হিন্দুরা তপস্বী, তারা দিয়েছে বেদ ও উপনিষদ। মুসলমানেরা শিল্পী, তারা দিয়েছে তাজ ও রংমহল। হিন্দুরা সাধক, তারা দিয়েছে দর্শন। মুসলমানেরা গুণী, তারা দিয়েছে সঙ্গীত। হিন্দুর গর্ব মেধার, মুসলমানের গৌরব হৃদয়ের। এই দুই নিয়েই ছিল ভারতবর্ষের অতীত; এই দুই নিয়েই হবে তার ভবিষ্যত। একটিকে বাদ দিলেই পাকিস্তান- মিস্টার মহম্মদ আলী জিন্নাহ না চাইলেও।’ পাকিস্তান সত্যিই হয়েছে। জন্ম থেকে তার পরিচয় ইসলামী রাষ্ট্র। ভারত হিন্দু রাষ্ট্র নয়। ভারতের পরিচয় রবীন্দ্রনাথ দিয়েছেন ‘ভারততীর্থ’ কবিতায়- ‘হেথায় আর্য, হেথা অনার্য, হেথায় দ্রাবিড় চিন-/ শক-হুন-দল পাঠান মোগল এক দেহে হল লীন।’ সেই ভারতে ‘ঘর ওয়াপ্সি’ অর্থাৎ ঘরে ফেরা কর্মসূচী চলছে উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতৃত্বে। উদ্দেশ্য অ-হিন্দুদের হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে আনা। উত্তর প্রদেশ, গুজরাট, কর্নাটক, অন্ধ্র, ওড়িষা, তামিলনাড়ু প্রভৃতি প্রদেশ থেকে মুসলমান ও খ্রীস্টানদের ধর্মান্তর করার খবর ছাপা হচ্ছে ভারতীয় পত্রপত্রিকায়। প্রায় প্রতিদিন আসে এ খবর। দিল্লীর আর্চবিশপ অনিল জে টি কাউটো বড়দিনের আগে নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলতে গিয়েছিলেন। মোটামুটি নিরাশ হয়ে ফিরেছেন। মোদি একে মিডিয়ার সৃষ্টি বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। কেউ কেউ অবশ্য বলছেন বিশ্ব হিন্দু পরিষদ আসলে বলতে চাইছে- ভারত হিন্দুর আবাস, অহিন্দুরা নিজ দেশে ফিরে যাও। নির্বাচনী ভাষণে মোদিও এমন ইঙ্গিত দিয়েছিলেন একাধিকবার। হায়রে! তাহলে তো গান্ধীর ‘হরিজন’ ছাড়া অন্যসব হিন্দুকেও ভারত ছাড়তে হয়। কারণ ইতিহাস বলে, আর্য আক্রমণে বিপর্যস্ত স্থানীয় গোত্রপ্রধানদের বড় অংশ এক সময় আপোস করে আর্য পক্ষে যোগ দেয় এবং ধীরে ধীরে আর্য জাতিতে রূপান্তরিত হয়। ব্রাহ্মণরা তো অবশ্যই কায়স্থরাও দাবি করেন তাঁরা আর্য বংশোদ্ভূত। অর্থাৎ বহিরাগত। শুধু ব্রাহ্মণ কায়স্থ নন, কালে কালে বৈশ্য শূদ্ররাও নিজেদের আর্য বলে জানান দিতে থাকেন। তার মানে হরিজন ছাড়া বাকি হিন্দুরা ভারতে অভিবাসী, তাঁরাও ঘর ওয়াপসির আওতায় পড়েন। হিন্দুত্ব, হিন্দু রাষ্ট্র ইত্যাদি নিয়ে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ভারতে যে কেরিকেচার শুরু করেছে নরেন্দ্র মোদি তা কতদিন প্রশ্রয় দেবেন সে সিদ্ধান্ত তাঁর। তবে তিনি যে শাঁখের করাতে আটকা পড়েছেন তা বেশ ভালই বোঝা যাচ্ছে। যে আদর্শের পতাকা নিয়ে তাঁর জন্ম বৃদ্ধি ও ক্ষমতায় আরোহণ তার সবটুকু জুড়ে আছে হিন্দুত্ববাদ। রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের গর্ভে তাঁর জন্ম। সংঘের আদর্শিক চাপ তাঁর ওপর থাকবে তাই স্বাভাবিক। দেশের অন্যান্য ধর্মের নাগরিকরা নিজ দেশে স্বাধীনভাবে বাঁচতে চাওয়ার দাবি প্রধানমন্ত্রীর কাছে করবেন তাও স্বাভাবিক। আর যে কর্পোরেটরা নির্বাচনী প্রচারের বিশাল ফুয়েল যোগালেন তারাই কি চুপ থাকবেন? ॥ দুই ॥ মুঘল সম্রাটদের প্রতি যতটুকু আগ্রহ তা মূলত আকবরকে ঘিরে। শাহজাহানকে মনে হতো ফ্যান্টাসির নায়ক। যদিও ডিএল রায় তাঁকে ট্র্যাজেডির নায়ক বানিয়েছেন। ছোটবেলায় দেখেছি মাতৃস্থানীয়রা সুঁই সুতো দিয়ে কাপড়ে তাজমহল রিপু করে নিচে নানা রকম শ্লোক বা কবিতার লাইন লিখে ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখতেন। ‘তাজমহলের মর্মরে গাথা কবির অশ্রুজল’ অথবা তাজমহলের পাথর দেখেছ, দেখিয়াছ কি তার প্রাণ। অন্তরে তার মমতাজ মহল বাহিরেতে শাহজাহান।’ এ ধরনের পঙ্ক্তি তাজমহল বা শাহজাহানের প্রতি বাড়তি আবেগ তো জাগায়ইনি বরং জনগণের ট্যাক্সের টাকা এভাবে নষ্ট করায় তাঁকে যথেষ্ট দায়িত্বহীন সম্রাটই মনে হয়েছে। শাহজাহান-মমতাজের প্রেম নিয়ে যুগ যুগ ধরে নানা কল্পকথা চলে এলেও আমার কেন যেন মনে হয় স্ত্রীর প্রতি প্রেমের চেয়ে নিজের প্রতি প্রেমটাই তাঁর বেশি ছিল। যা হোক, ঐতিহাসিক, সমাজতাত্ত্বিক, অর্থনৈতিক সব ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের পরও তাজের সামনে দাঁড়ালে, একে স্পর্শ করলে এর অসাধারণ শিল্প নৈপুণ্যকে স্বীকার করতেই হবে। অসাধারণ কারুকাজ। কত ধৈর্য কত মনোযোগ এর পেছনে রয়েছে ভাবলে অবাক হতে হয়। একেবারে নিখুঁত মাপজোক। নানা ধরনের পাথরের অপূর্ব নকশা। পাথরগুলোর গায়ে আলো ফেললে এখনও জ্বলে ওঠে। এখনও জীবন্ত। বাইশ হাজার শ্রমিক বাইশ বছরের সাধনায় সত্যিই এক অসামান্য ঐতিহাসিক শিল্পকর্ম রচনা করে রেখে গেছেন। সমৃদ্ধ মুঘল স্থাপত্য ও চিত্রকলার কথা বইয়ে পড়লেও তার সত্যিকারের রূপ দেখলাম এবার। এ কথা ঠিক, ভারতে সাধারণ শিক্ষা বিস্তারে মুঘলদের তেমন কোন অবদান নেই। কিন্তু তাদের ভাষা, স্থাপত্য, চিত্রকলা, সঙ্গীত ও কাব্য যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছে। উনিশ শতক পর্যন্ত আদালতের ভাষা ছিল ফার্সী। রামমোহন রায় ফার্সী ভাষাতেই প্রথম পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। মনে পড়ে দু’হাজার নয় সালে ইতিহাসবিদ তপন রায় চৌধুরী ঢাকায় এলে এশিয়াটিক সোসাইটি স্মারক বক্তৃতার আয়োজন করেছিল। ‘ব্রিটিশ ভারতে হিন্দু ও মুসলমান’ শিরোনামে ওই স্মারক বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, ‘রাজনারায়ণ বসু তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন যে, ব্রাহ্ম ধর্মের বুদ্ধিবৃত্তিক শিকড় সেই প্রাচীন উপনিষদে নিহিত থাকলেও এর ধর্মীয় আবেগ হাফিজ ও রুমির কাছ থেকে নেয়া। মাঝে মাঝে আমি অবাক হয়ে ভাবি দেবেন্দ্রনাথ যদি তাঁর কনিষ্ঠ পুত্রকে সংস্কৃতির পাশাপাশি ফার্সী ভাষা শেখাতেন তাহলে কি হতো। নজরুলের গজলের মধ্যে আমরা একটা সূক্ষ্ম ধ্বনি শুনতে পাই। রবীন্দ্রনাথের কাব্যেও আমরা এর সমৃদ্ধ সুর শুনতে পেতাম।’ সমৃদ্ধ ইতিহাসের দেশ ভারত। দিল্লী, উত্তর প্রদেশে মুঘলদের ইতিহাস, উড়িষ্যায় অশোক, কোনার্ক মন্দিরের নান্দনিক উপস্থিতি, কেরালায় ওলন্দাজ, পর্তুগীজ নিদর্শন- কোনটাকে বাদ দিয়ে ভারত নয়। এই সমৃদ্ধ ভারতে বার বার আসতেই হবে- ইতিহাস ও প্রাচ্যসভ্যতার পাঠ নিতে।
×