ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এ্যাপোলো-১৩ যদি পৃথিবীতে ফিরে না আসত?

প্রকাশিত: ০৩:৩৩, ১৪ জানুয়ারি ২০১৫

এ্যাপোলো-১৩ যদি পৃথিবীতে ফিরে না আসত?

বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশক ছিল মহাশূন্য প্রতিযোগিতার মহাকাব্যিক যুগের এক বর্ণাঢ্য পর্ব। আবেগ ও উত্তেজনায় ভরা যুগটিতে, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র অবিশ্বাস্য রকমের অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছিল। যেমন : ১৯৬৮ সালের অক্টোবর মাসে সোভিয়েতদের সয়ুজ-৩, মহাশূন্যে সয়ুজ-২ নভোযানের সঙ্গে সাক্ষাত করে এবং এই ঘটনার মাত্র মাস দুই বাদে ডিসেম্বর মাসে নাসার এ্যাপোলো-৮-এর নভোচারী পৃথিবীর মহাকর্ষ বলের টান অতিক্রম করে প্রথমবার চাঁদের চারদিকে ভ্রমণ করে আসেন! চাঁদে মানুষের প্রথম অবতরণের আগ পর্যন্ত এ জাতীয় কয়েকটি রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা হয়। যেমন : ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে সোভিয়েতরা সয়ুজ-৪ উৎক্ষেপ করে এবং পরদিন উৎক্ষেপ করে সয়ুজ-৫। এই দুই নভোযান মহাশূন্যে ‘সংযুক্ত বা ডক’ করে এবং সয়ুজ-৫ এর দুই নভোচারী নভোযান থেকে বেরিয়ে আসেন ও সয়ুজ-৪-এর আরোহী হয়ে পৃথিবীতে প্রত্যাবর্তন করেন। এই ঘটনার দুই মাস বাদে ১৯৬৯ সালে প্রথমবারের মতো এ্যাপোলো-৯-এর কমান্ড মডিউলের সঙ্গে চাঁদে অবতরণে সক্ষম চন্দ্রযান (লুনার মডিউল) সংযুক্ত করে পৃথিবীর কক্ষপথে ঘুরিয়ে আনা হয়। ১৯৬৯ সালের মে মাসে এ্যাপোলো-১০’কে মহড়ার জন্য (ড্রেস রিহার্সেল) চাঁদ পর্যন্ত পাঠানো হয়, চাঁদে অবতরণ ছাড়া সব সম্পন্ন করে নভোযানটি পৃথিবীতে ফিরে আসে। এর দুই মাস বাদে ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই এ্যাপোলো-১১-এর দুই নভোচারী নীল আর্মস্ট্রং ও অলড্রিন ‘ঈগল’ নামের চন্দ্রযান চালিয়ে চাঁদের বুকে অবতরণ করেন। পরদিন ২১ জুলাই ঈগলে চেপে ফিরে আসেন কমান্ড মডিউল ‘কলাম্বিয়া’তে। অবশেষে তিন নভোচারী নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরে আসেন। এই বছরেরই অক্টোবর মাসে তিন তিনটে নভোযান, সয়ুজ-৬, ৭ ও ৮ সর্বমোট সাতজন নভোচারীসহ মহাশূন্যে যুগপৎ পরিভ্রমণ করেন। আর নবেম্বর মাসে এ্যাপোলো-১২-এর নভোচারীরা দ্বিতীয়বারের মতো সফল চন্দ্রে অবতরণ করেন, নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরেও আসেন! তারপরেই ঘটে কয়েকটি দিন স্থায়ী এ্যাপোলো-১-এর ‘সফল ব্যর্থতা’র নাটকীয় অধ্যায়ের। এ্যাপোলো-১৩কে বাদ দিলে সর্বমোট ছয়টি সফল চন্দ্র-অবতরণ ঘটে। ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে এ্যাপোলো-১৭ সর্বশেষ সফল চন্দ্রে অবতরণ করে এ্যাপোলো মিশনের পরিসমাপ্তি টানে। এ্যাপোলো-১৩ ছিল যুক্তরাষ্ট্রের এ্যাপোলো মহাশূন্য প্রোগ্রামের সপ্তম মনুষ্যবাহী মিশন। ১৯৭০ সালের ১১ এপ্রিল এ্যাপোলো-১৩’কে আসলে পাঠানো হয়েছিল চাঁদে অবতরণের তৃতীয় মিশন হিসেবে। তিন নভোচারীকে নিয়ে মহাযানটি চাঁদের খুবই কাছেও চলে গিয়েছিল। তা সত্ত্বেও তিন নভোচারীর যে দু’জনের চাঁদে অবতরণের কথা ছিল, তাঁদের চাঁদে নামা আর হয়নি। দিন দুই পরে ১৩ এপ্রিল নভোযানের সার্ভিস মডিউলে রাখা দুটো অক্সিজেন ট্যাঙ্কের দুই নম্বর ট্যাঙ্কটি ফেটে যায় এবং মডিউলকে আক্ষরিক অর্থেই খোঁড়াখঞ্জ করে দেয়। যেহেতু, নভোযানের কমান্ড মডিউল শতকরা এক শ’ ভাগই সার্ভিস মডিউলের ওপরে নির্ভরশীল (কারণ, সে প্রচলনশক্তি বা প্রপালশন, বিদ্যুতশক্তি, অক্সিজেন ও জলের যোগানদার) তাই অনায়াসে বলা চলে যে নভোযানটিই খোঁড়াখঞ্জে পরিণত হয়। ফলে, জেমস এ. লভেল, জ্যাক বা জন সুইগার্ট ও ফ্রেড ডব্লিউ হেইজ নামের তিন নভোচারীকে চাঁদের আকর্ষণ ত্যাগ করে নিরাপদে ঘরে ফিরে আসার ব্যবস্থায় মনোযোগ দিতেই হয়। (মজার ব্যাপার হলো যে এ্যাপোলো-১১-এর ‘ব্যাক-আপ’ ক্রু’র তালিকায় লভেল ছিলেন কমান্ডার, হেইজ ছিলেন চন্দ্রযানের পাইলট।) সার্ভিস মডিউলের দুর্ঘটনার ফলে বিদ্যুত সরবরাহ খুবই সীমিত হয়ে যায়। ফলস্বরূপ, কেবিনের হিটিং ব্যবস্থা কমিয়ে দিতে বাধ্য হন নভোচারীরা, এমনকি খাওয়ার জলেও তাঁদেরকে নির্মম রেশন ব্যবস্থা আরোপ করতে হয়, কার্বন-ডাই-অক্সাইডের ‘রিমুভাল সিস্টেম’কে পর্যন্ত হিসাব করে ব্যবহার করতে হয় বা এমনকি নভোযানের ফিরতি পথের পরিবর্তন (ট্র্যাজেকটরি) রোধের জন্য নভোচারীদের জন্য প্রস্রাব করাও নিষিদ্ধ ছিল। এত কষ্ট ও দুর্ভোগ সত্ত্বেও তিন নভোচারী নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরে আসেন। উড্ডয়ন কমান্ডার লভেল তাই এ্যাপোলো-১৩ মিশনকে ‘সফল ব্যর্থতা’ (সাকসেসফুল ফেইলিয়োর) বলেছেন, আর চাঁদে নামতে না পারাকে বলছেন ‘ব্যর্থ চান্দ্র অবতরণ’। যে ঘটনাপ্রবাহগুলো এ্যাপোলো-১৩কে মৃত্যুর সঙ্গে লড়তে বাধ্য করেছিল, সেগুলোর সূচনা হয় আসলে বছর পাঁচেক আগে ১৯৬৫ সালে। এই বছর এ্যাপোলো নভোযানের ডিজাইনে অতি সাধারণ একটি পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আদি ডিজাইন অনুযায়ী উড্ডয়নকালে এ্যাপোলো নভোযানের ‘কমান্ড মডিউল’ ও ‘সার্ভিস মডিউলে’র সিস্টেমগুলোকে আটাশ ভল্টের বিদ্যুত পরিচালিত হওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। কিন্তু ১৯৬৫ সালে কেনেডি স্পেস সেন্টারে নভোযানের উড্ডয়ন-পূর্ব পরীক্ষা-নিরীক্ষাকালে ঠিক হয় যে, আটাশ নয়, পঁয়ষট্টি ভল্টের বিদ্যুত ব্যবহার হবে। এই মতো, নর্থ আমেরিকান এভিয়েশন প্লান্টের ইঞ্জিনিয়ারদের বলে দেয়া হয় যে, নভোযানের বৈদ্যুতিক উপাদানগুলোকে (কমপোনেন্ট) এমনভাবে পুনর্ডিজাইন করতে হবে, যাতে ৬৫-ভল্টের বিদ্যুত ব্যবহার করে অক্সিজেনপূর্ণ ট্যাঙ্ককে আরও দ্রুত চাপ-নিয়ন্ত্রণাধীনে আনা যায়। এ্যাপোলো মিশনে ব্যবহৃত নভোযানের সার্ভিস মডিউল অংশে তরল-অক্সিজেনে পূর্ণ দুটো ট্যাঙ্ক সংস্থাপিত ছিল। তরল অক্সিজেনে বা তরল হাইড্রোজেনে পূর্ণ ট্যাঙ্ক মাত্রেই হয় নির্গমন-পথ বা অতি উত্তম তাপ-অপরিবাহী (অন্তরণ) ব্যবস্থা বা উভয় ব্যবস্থাই থাকতে হবে, যাতে ট্যাঙ্কের তরল পদার্থ বাষ্পীভূত হয়ে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হতে না পারে। সার্ভিস মডিউলের অক্সিজেন ট্যাঙ্ক দুটো এত উত্তমভাবে তাপ-অপরিবাহী ছিল যে তরল অক্সিজেন বা তরল হাইড্রোজেনপূর্ণ অবস্থায় তারা কয়েক বছর ব্যবহারযোগ্য অবস্থায় থাকতে সক্ষম। এক একটি ট্যাঙ্কের ধারণ ক্ষমতা ছিল কয়েক শ’ পাউন্ড পরিমাণ তরল অক্সিজেন। তবে ট্যাঙ্কের নির্মাণ প্রক্রিয়া এমন ছিল যে ট্যাঙ্কের ভেতরে কি হচ্ছে না হচ্ছে, সেটি পরীক্ষণের কোন উপায় ছিল না। নভোচারীর শ্বাসকার্যের অতি দরকারী অক্সিজেনের সরবরাহ আসত অক্সিজেনভর্তি ট্যাঙ্ক থেকে। তাছাড়াও, নভোযানের কমান্ড মডিউল অংশে সংস্থাপিত বিবিধ যন্ত্রপাতির সিস্টেমগুলোকে চালু রাখতে যে তিনটি জ্বালানিসেল ব্যবহার হয়, সেগুলোকে বিদ্যুত উৎপাদনে সাহায্য করার দায়-দায়িত্বও ছিল ট্যাঙ্ক দুটোর। ট্যাঙ্কের ভেতরকার তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতিটি ট্যাঙ্কের অভ্যন্তরে ছিল একটি তাপনিয়ামক ‘থার্মোস্ট্যাট’ ও একটি ফ্যান। যে কোম্পানি এই থার্মোস্ট্যাট তৈরির দায়িত্বে ছিল, তারা ঘুণাক্ষরেও জানতই না যে, থার্মোস্ট্যাটটিকে ৬৫-ভল্টের বিদ্যুতে কাজ করতে সক্ষম হতে হবে। অর্থাৎ এ্যাপোলো-১৩’র পূর্ববর্তী সব মিশনে যে অক্সিজেন ট্যাঙ্ক ব্যবহার হয়েছে, সেগুলোর থার্মোস্ট্যাটও ৬৫ ভল্টের বদলে ২৮-ভল্টের বিদ্যুতে পরিচালিত হয়েছে এবং তাই বলতে হয় যে নিহায়ত কপালগুণেই কোন দুর্ঘটনাও ঘটেনি। অবশ্য এ্যাপোলো-১৩’র দুই নম্বর ট্যাঙ্কটির ছোট্ট এক নিষ্প্রভ ইতিহাস রয়েছে। ইতিহাসের প্রসঙ্গে আমাদের ১৯৬৮ সালের অক্টোবর মাসের তুচ্ছ এক দুর্ঘটনায় ফিরে যেতে হয়। এ্যাপোলো-১৩তে ব্যবহৃত দুই নম্বর ট্যাঙ্কটি ১৯৬৮ সালের অক্টোবর মাসে ক্যালিফোর্নিয়ার ডাউনিতে অবস্থিত নর্থ আমেরিকান এভিয়েশন প্লান্টে ছিল। সেখানে ট্যাঙ্ক নিয়ে নাড়াচাড়ার সময় আকস্মিকভাবে টেকনিশিয়ানদের হাত থেকে ট্যাঙ্কটি হড়কে মাত্র পাঁচ সেন্টিমিটার পরিমাণ নিচে নেমে আসে। কিন্তু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পরে বলা হয় যে হড়কে পড়ে গেলেও শনাক্তযোগ্য কোন ক্ষতির হদিস পাওয়া যায়নি। হড়কে নেমে আসা ট্যাঙ্কটি উৎক্ষেপণপূর্ব সব কয়টি রুটিন পরীক্ষা-নিরীক্ষা সাফল্যের সঙ্গে উৎরে যায়। ফলে, উড্ডয়নের ক্লিয়ারেন্স পায় এবং এ্যাপোলো-১৩তে সংস্থাপন করা হয়। তবে, ১৯৭০ সালের মার্চ মাসের শেষের দিকে ‘কাউন্টডাউন ডেমোনস্ট্রেশন টেস্ট’ নামক পরীক্ষা পরিচালনার পরে স্থল-ক্রুরা ট্যাঙ্কটিকে খালি করার চেষ্টা করে, কিন্তু করতে পারে না, ব্যর্থ হয়। অর্থাৎ ছোট্ট যে টিউবের সাহায্যে অতি-শীতল তরল বস্তুকে ট্যাঙ্কের ভেতরে ঢোকানো ও ট্যাঙ্ক থেকে বের করার কাজে ব্যবহার হয়, সেটি প্রায় দুই বছর আগে (হড়কে নেমে আসায়) নষ্ট হয়ে অকেজোতে পরিণত হয়েছিল। আসল সমস্যাটি কি, তার হদিস পাওয়ার জন্য টেকনিশিয়ানরা ঠিক করে যে ট্যাঙ্কের ভেতরে যে ফ্যানটি রয়েছে, তারা সেটি চালু করবে। ফ্যানের তাপে ট্যাঙ্কের তরল অক্সিজেন উষ্ণ হয়ে গ্যাসে পরিণত হবে এবং ফলস্বরূপ তাকে বাইরে বের করে আনা সহজ হবে। আবার ট্যাঙ্কের ভেতরে যে থার্মোস্ট্যাটটি রয়েছে, সেটি ভেতরের তাপমাত্রাকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে যে সেটি কোনক্রমেই সাতাশ সেলসিয়াসের বেশি হবে না। তার মানে, সর্বোচ্চ সাতাশ সেলসিয়াস তাপমাত্রায় কয়েকদিন ধরে (দুই নম্বর) ট্যাঙ্ক থেকে সবটুকু অক্সিজেন গ্যাস হিসেবে বেরিয়ে আসবে। যেমন ভাবা তেমনি করা, তারা ফ্যানটিকে ৬৫-ভল্টের সকেটে ঢুকিয়ে অন করে দেয়। ট্যাঙ্কের ভেতরে তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে থার্মোস্ট্যাটটিও সক্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু ২৮-ভল্টের বিদ্যুতে অভ্যস্ত থার্মোস্ট্যাটটির সংযোগ-বিন্দু বা ফিউজ, ৬৫-ভল্টের বিদ্যুতর চাপে গলে সংযোগশূন্য হয়ে পড়ে অর্থাৎ কাজ করা বন্ধ হয়ে যায়। অপরদিকে, ফ্যানটি চলতেই থাকে, অকেজো থার্মোস্ট্যাটের জন্য তার তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণও আর হতে পারে না। কিন্তু ট্যাঙ্কের অভ্যন্তরে যে এমন এক ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটেছে টেকনিশিয়ানদের সেটি বোঝার বা জানার কোন উপায় ছিল না। তারা কিছুই জানেনি। বুঝতেও পারেনি যে সঙ্গে একটি ‘তৈরিরত বোমা’ নিয়ে এ্যাপোলো-১৩ উড়তে যাচ্ছে। থার্মোস্ট্যাটটির কাজ ছিল তাপমাত্রার ওঠা-নামার সঙ্গে সঙ্গে ফ্যানের অন-অব (সাইকেল) নিয়ন্ত্রণ করা। আবার থার্মোস্ট্যাট ঠিকমতো কাজ করছে কিনা সেটি মনিটর করার জন্য ছিল তাপমাত্রা-সংবেদক সেন্সর। কিন্তু সেন্সরটি আবার সর্বোচ্চ সাতাশ সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রা দেখাতে সক্ষম করে তৈরি ছিল না। ফলে, ট্যাঙ্কের ভেতরকার প্রকৃত তাপমাত্রা কত, জানারও কোন উপায় ছিল না। এমন পরিস্থিতিতে নিয়ন্ত্রণবিহীন ফ্যানের তাপমাত্রা বেড়ে প্রায় ৫৪০ সেলসিয়াসে উঠেছিল বলে অনুমান করা হয়। কারণ, কয়েকদিনের বদলে মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ট্যাঙ্কটি খালি হয়ে গিয়েছিল। (তবে আশ্চর্য যে কারও একটুও খটকা লাগল না যে ‘কয়েকদিনের কাজ কয়েক ঘণ্টার মধ্যে’ সম্পন্ন হয় কি করে?)। যেসব বৈদ্যুতিক তার দিয়ে ফ্যানে বিদ্যুত-সরবরাহ হতো, সেগুলো ছিল ‘টেফলন’ নামক তাপ-অপরিবাহী পদার্থ দিয়ে মোড়ানো। উচ্চ তাপমাত্রায় ‘টেফলন’ গলে যায় এবং ফলে বিদ্যুত-তার নগ্ন অনাবৃত হয় ও সেই অবস্থায় থেকে যায়। কাজেই, টেকনিশিয়ানরা খালি ট্যাঙ্কটিকে যখন আবার অক্সিজেনপূর্ণ করে, যে কোন সময় সেটি বিস্ফোরিত হওয়ার জন্য অপেক্ষায় থাকে মাত্র। ১৯৭০ সালের ১৩ এপ্রিল, পৃথিবীর গ্রাউন্ড কন্ট্রোল জ্যাক সুইগার্টকে সার্ভিস মডিউলের ট্যাঙ্ক দুটোর ফ্যান চালু করার নির্দেশ দেয়। সুইগার্ট নির্দেশ পালন করেন। দুই নম্বর ট্যাঙ্কে ফ্যানটি চালু হওয়ামাত্রই, নগ্ন বিদ্যুত-তার ‘শর্ট-সার্কিট’ করে এবং বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গের সৃষ্টি হয়ে অক্সিজেন ট্যাঙ্কের ভেতরে আগুন লেগে যায়। বিশুদ্ধ অক্সিজেনের সংস্পর্শে আগুনের তীব্রতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অভ্যন্তরীণ চাপও দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং বিস্ফোরণ ঘটে। ফলস্বরূপ, অতি নিবিড়ভাবে সজ্জিত সার্ভিস মডিউলের অন্যান্য সিস্টেমও ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং নভোযানটিকে খোঁড়াখঞ্জ করে দেয়। (এ্যাপোলো-১৩-এর এই অপ্রত্যাশিত অভিজ্ঞতার পরে, অক্সিজেন ট্যাঙ্কগুলোর পুনর্ডিজাইন করা হয় যাতে অনুরূপ দুর্ঘটনা আর না ঘটতে পারে। সার্ভিস মডিউলে বাড়তি তৃতীয় একটি ট্যাঙ্কও সংযোজিত হয়। এ্যাপোলো-১৩ বাদে সর্বমোট যে আটটি এ্যাপোলো নভোযান পাঠানো হয়েছিল, সেগুলোর কোনটিই অনুরূপ সমস্যায় পড়েনি)। (পৃথিবীর সময়ের হিসাব অনুযায়ী) আর মাত্র সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার মধ্যেই চাঁদের মহাকর্ষ বলের আওতার মধ্যে ঢুকবে এমন এক মুহূর্তে নাটকীয় ঘটনার অবতারণা হয়, এ্যাপোলো-১৩-এর দুই নম্বর ট্যাঙ্কটি বিস্ফোরিত হয়। পৃথিবী থেকে সে তখন ৩,২০,০০০ কিলোমিটার দূরে। অনেক অনেক দূরে। খোঁড়াখঞ্জ নভোযানকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার জন্য ‘ফ্রি-রিটার্ন-ট্র্যাজেকটরি’ ব্যবহার হয়। অর্থাৎ এ্যাপোলো-১৩’কে পৃথিবীমুখী করার জন্য চাঁদের দিকে ঠেলে পাঠিয়ে দেয়া হয়। উদ্দেশ্য চাঁদের মহাকর্ষ বল ব্যবহার করা। তাই নভোযানটি চাঁদের দূরবর্তী অংশে চলে আসে। সেখানে প্রাথমিক ফিরতি পথ (ট্র্যাজেকটরি) নির্ধারণের পরে, চাঁদ তার মহাকর্ষ বলের সাহায্যে এ্যাপোলো-১৩কে পৃথিবীমুখী ঠেলে দেয়। এই কাজে বাড়তি প্রচালনশক্তির (প্রপালশন) প্রয়োজন হয় না বলেই ‘মুক্ত’ বা ’ফ্রি’ বলা হয়। এই মুক্ত ফিরতি পথকে ‘সারকামলুনার ট্র্যাজেকটরি’, ‘ফ্রি-লুনার ট্র্যাজেকটরি’ ইত্যাদি পরিভাষায়ও অভিহিত করা হয়। একমাত্র এ্যাপোলো-১৩ এ্যাপোলো মিশনের বাকি সব নভোযান থেকে প্রায় এক শ’ কিলোমিটার বেশি কৌণিক দূরত্বে (অলটিটিউড) চলে এসে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করে। কারণ, ১৯৭০ সালের ১৪ এপ্রিল, এ্যাপোলো-১৩ পৃথিবী থেকে ৪০০১৭১ কিলোমিটার দূরে চলে এসেছিল। যাহোক, মুক্ত-ফিরতি পথের ব্যবস্থাটি কার্যকরী হওয়াতে সুদীর্ঘ পথ অতিক্রম করে ১৯৭০ সালের ১৭ এপ্রিল এ্যাপোলো-১৩ দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে নিরাপদে অবতরণ করে। সারা পৃথিবী স্বস্তির নির্মল আনন্দ অনুভব করে। সব ভাল যার শেষ ভাল। আসলেও তাই! কারণ, এ্যাপোলো-১৩ পৃথিবীতে ফিরে না-ও আসতে পারত তো? এমন সম্ভাবনা তো ছিলই! এবারে যদি সিনিয়রিটি পাল্টে দেয়া হয়! ধরা যাক যে এ্যাপোলো-১৩ পৃথিবীতে ফিরে আসতে পারেনি! কি পরিণতি হতো তার... সার্ভিস মডিউলটি এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যে চন্দ্রযানের সাহায্যে চাঁদের বুকে অবতরণের পরে নিরাপদে আবার চন্দ্রযানে ফিরে আসাই সম্ভব হতো না। (কারণ, অক্সিজেন ট্যাঙ্কের বিস্ফোরণজনিত কারণে সার্ভিস মডিউলের চার নম্বর সেক্টরটি একেবারেই উড়ে গিয়েছিল।) তাই উড্ডয়ন কমান্ডার লভেল ও তাঁর দুই সঙ্গীকে পৃথিবীতে ফিরে আসার নির্দেশ দেয়া হয়। ফিরতি পথে পৃথিবীর বায়ুম-লে প্রবেশের আগমুহূর্ত পর্যন্ত সার্ভিস মডিউল ও চন্দ্রযানকে এ্যাপোলো-১৩ নভোযানের সঙ্গে সংযুক্ত রাখা হয়, প্রায়োগিক ও প্রযুক্তিগত কারণে। যেমন : কমান্ড মডিউলকে (এখানেই তিন নভোচারী ছিলেন) তাপঘটিত দুর্ঘটনা থেকে সংরক্ষণের জন্য সার্র্র্র্ভিস মডিউলকে ঢালের মতো ব্যবহার করা হয় এবং চন্দ্রযানকে রাখা হয় নভোচারীদের বেঁচে থাকার জন্য অতি দরকারী ‘লাইফ-সাপোর্ট’ দেয়া ও পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য। পৃথিবীর বায়ু-ম-লে প্রবেশের ঠিক আগ মুহূর্তে কমান্ড মডিউল থেকে নিরাপদ দূরত্বে চন্দ্রযানের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়াটি ছিল সবচেয়ে বিপজ্জনক মুহূর্ত। নিরাপদ ব্যবধানে কোন সঠিক মুহূর্তে, কতটুকু চাপে চন্দ্রযানকে বিচ্ছিন্ন হতে হবে, সেটির নির্ভুল হিসাব নিকাশ করতে তাই ‘স্লাইড রুল’ও ব্যবহার হয়েছিল। (বিজ্ঞানীর দল হিসাবনিকাশ করেন মাত্র ছয়ঘণ্টায়)। চন্দ্রযানটি সঠিক মুহূর্তে নির্ভুল চাপে বিচ্ছিন্ন হতে পেরেছিল বলেই তিন নভোচারী নিরাপদে ফিরে আসেন। কিন্তু চন্দ্রযানটি যদি পৃথিবীমুখী আসার নির্ভুল সঠিক পথটি অনুসরণ না করত, তবে পৃথিবীতে তো ফিরে আসা হতো না! পূর্ববর্তী ধারণা ছিল যে এমতাবস্থায় অক্সিজেনের সরবরাহ শেষ হওয়ামাত্র নভোচারীরা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তেন, আর মডিউলটি অনন্ত মহাশূন্যে ভেসে বেড়াত! (চল্লিশ বছর বাদে, বিশেষ সফটওয়ারের সাহায্যে এ্যাপোলো-১৩-এর উপাত্তগুলো বিশ্লেষণ করা হয় এবং ভিডিওবন্দী করা হয়। এ্যাপোলো-১৩ যদি অসাধারণ সফল প্রত্যাবর্তনটি করতে ব্যর্থ হতো তবে তার ভাগ্যে কি ঘটতে পারত, তার একটি চিত্র এই বিশ্লেষণ থেকে পাওয়া যায়। ভিডিওর বর্ণনা করেন মহাশূন্য বিষয়ক লেখক এন্ড্রু চাইকিন।) সেই ভিডিও অনুযায়ী, সাধারণভাবে প্রচলিত ভাবিকথন ছিল যে পৃথিবী থেকে প্রায় ৬৪ ০০০ কিলোমিটারের মাথায় চন্দ্রযানটি পৃথিবীমুখী পথ থেকে সরে যেতে পারত। কিন্তু বর্তমানে বলা হচ্ছে যে মাত্র ৪০২৩ কিলোমিটারের মাথায়ও চন্দ্রযানটি পথভ্রষ্ট হতে পারত। আর যদি হতো, তবে পৃথিবীর দিকে আবার ফিরে আসার আগে নভোচারীরা প্রায় ৫৬৩ ০০০ কিলোমিটার বিস্তৃত নতুন এক কক্ষপথে প্রবেশ করতেন। অতঃপর, নভোযানটি ৪৮০০০ কিলোমিটার দূরে থেকে চাঁদকে অতিক্রমের সময়, চাঁদের মহাকর্ষ বল চন্দ্রযানের কক্ষপথটি আবারও বদলে দিত, ঠেলে দিত পৃথিবীর দিকে। এন্ড্রু চাইকিনের ব্যাখ্যা অনুযায়ী এ্যাপোলো-১৩ আবার পৃথিবীর দিকে ছুটতে থাকত, আর ছুটত ‘বেপরোয়া সাংঘর্ষিক গতি’তে; যাকে ‘কলিশন কোর্স’ বা ‘কামিকাজে’ও বলা হয়। অর্থাৎ, এ্যাপোলো-১৩ যে কোণ সৃষ্টি করে পৃথিবীর বায়ুম-লে ঝাঁপিয়ে পড়ত, তার ফলে মডিউলটি জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যেত।’ [email protected]
×