ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

পাহাড়ে শান্তির সন্ধান

প্রকাশিত: ০৫:২১, ১২ জানুয়ারি ২০১৫

পাহাড়ে শান্তির সন্ধান

(শেষ পর্ব) শিক্ষক, শিক্ষাবিদ এবং অন্য যে কোন পেশাজীবী হিসেবে মনে করি- অন্যে প্রশ্ন করার আগে নিজেই নিজেকে যদি প্রশ্ন করা যায়, ‘আমি কি আমার পেশার দায়িত্বটি ঠিকমতন করলাম? আমার/আমাদের কোন কাজ কি জনগণের অধিকারকে ক্ষুণœ করে? করলে, সেটি কি? কিভাবে তা বন্ধ করা যায়?’ এই সব প্রশ্নের উত্তর সব সংস্থা ও পেশাজীবী সদস্যদের সংস্থার, নিজের, দেশের, জাতির উন্নয়ন ও শান্তির স্বার্থে তৈরি করা ও সে অনুযায়ী সমাধানের পথে অগ্রসর হওয়া দরকার। যে অপরাধী সেই তো তার দ্বারা কৃত অপরাধের বিষয়টি অন্য যে কোন ব্যক্তির চাইতে বেশি জানে- তাই নয় কি? ব্যক্তি ও সংস্থা নিজের কৃত কাজ ও এর পরিণতির সম্পর্কে সচেতন হলেই কেবল তাদের দ্বারা অপরাধ, অশান্তি সংঘটনের হার হ্রাস পাবে। অন্যথায় নয়। পূর্বে প্রকাশিত পর্বগুলোতে বর্ণিত পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পাহাড়ী, বাঙালী বসতি স্থাপনকারী, প্রশাসন, পুলিশ, সেনা-বিডিআর, রাজনীতিক ও সরকারসহ সবার ঐক্যবদ্ধ আন্তরিক প্রচেষ্টাই শান্তির প্রাথমিক ভিত্তি গঠন করবে, এটি বলা বাহুল্য। শান্তি স্থাপনের সূচনালগ্নে কতগুলো বিষয়ে এখানে ভূমিকা পালনকারী স্টেকহোল্ডারদের এবং বসবাসকারী সব জাতিসত্তার মানুষকে ঐকমত্যে আসা প্রয়োজন, যেমন- (১) বাংলাদেশের বৈচিত্র্যপূর্ণ পাহাড়ী অঞ্চলকে এর প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য- পাহাড়, ঘন অরণ্য, বিভিন্ন বৃক্ষ, পশু, পাখি, নদী, নালা, ঝর্ণা, পাহাড়ীদের বসতি, বাঙালীদের বসতিকে সীমিত রেখে এ বৈশিষ্ট্যকে বজায় রাখা। (২) এ লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী অঞ্চলে পর্যটন ব্যবস্থা প্রসারিত করার যে পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে, তাতে বাণিজ্যিক পর্যটনের চরিত্র প্রকটভাবে প্রকাশ পাচ্ছে, অথচ এ এলাকার পর্যটন ব্যবস্থা হবে- ইকো-পর্যটন ব্যবস্থা, যা প্রকৃতিকে অক্ষুণœ রেখে তৈরি হবে। ভারতের পাহাড়-অরণ্যসমৃদ্ধ অঞ্চলে ইকো টুরিজমই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যা স্থপতি ও পরিবেশবিদ যৌথভাবে পরিকল্পনা করতে সক্ষম। অর্থাৎ পাহাড়, অরণ্য, ঝর্ণা, লেক, নদী, পাহাড়ীদের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ জীবনাচার ও সংস্কৃতিকে টুরিস্টদের আকর্ষণের বিষয় হিসেবে সুরক্ষিত রেখেই পাকা পথ, টুরিস্টলজ ইত্যাদি তৈরি হবে। (৩) পাহাড়ে এক সময় রাষ্ট্রের উদ্যোগে উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে দেশের সমতলের বিভিন্ন জেলা থেকে বাঙালীদের এনে বসতি ও চাষের জমি প্রদান করে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় ‘বাঙালী বসতি’ সৃষ্টি করা হয়েছিল, যা আগেই বর্ণনা করা হয়েছে। স্মরণ রাখতে হবে, এই বাঙালী বসতি স্থাপনের মধ্য দিয়েই পাহাড়ে অশান্তির সূত্রপাত ঘটেছিল। (৪) পাহাড়ে বর্তমানে নিরাপত্তা বাহিনীÑপুলিশ, সেনাবাহিনী ও বিডিআর একটি ভূমিকায় অন্যতম প্রধান স্টেকহোল্ডার হয়ে অবস্থান করছে। (৫) পাহাড়ে ’৯৬ সালের শান্তিচুক্তির মাধ্যমে সন্তু লারমার নেতৃত্বে সশস্ত্র পাহাড়ীরা অস্ত্র সমর্পণ করে স্বদেশে ফিরে এসে একটি শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনের নিশ্চয়তা আশা ও সেটি লাভ করেছিল। (৬) এ সময় শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের পক্ষে সন্তু লারমার নেতৃত্বে জনসংহতি সমিতি নামে একটি সংস্থার জন্ম হয়। আশ্চর্য এই যে, এর পরপরই কথিত আছে তদানীন্তন বিরোধী দলের প্রশ্রয়ে পাহাড়ীদের দিয়েই শান্তিচুক্তি বিরোধী দল- ইউপিডিএফ নামে একটি সংঘর্ষ-হাইজ্যাক-অপহরণ-খুন ইত্যাদি অপরাধকর্ম পরিচালনাকারী দলের উত্থান হয়। এর পর থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, শান্তিচুক্তিকে ব্যর্থ করার লক্ষ্যে ইউপিডিএফ একটি নেপথ্য শক্তির প্রশ্রয়ে এই সব শান্তিবিরোধী অপরাধ করে চলেছে। (৭) একটি তৃতীয় শক্তি পাহাড়ের বাঙালী-পাহাড়ীর মধ্যে সর্বদা একটি সাংঘর্ষিক, শত্রুতামূলক সম্পর্ক বজায় থাকুক এটি চাচ্ছে। বিভিন্ন ঘটনা বিশ্লেষণ করে এমন একটি ধারণা হয়, যা হয়ত প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য প্রমাণ দিয়ে প্রমাণ করা সম্ভবপর নয়। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে, পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার পর বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া বক্তব্য দিয়েছিলেনÑ ‘এখন থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী পর্যন্ত ভারতের দখলে চলে যাবে, ওখানে কোন মসজিদে আজান হবে না, উলু দেয়া হবে, পূজা হবে, ওখানে যেতে পাসপোর্ট-ভিসা লাগবে ইত্যাদি!’ তাঁর সে সময়ের বক্তব্যটি ছিল পুরোপুরি উসকানিমূলক এবং হতাশাজনক এই জন্য যে, তিনি জিয়াউর রহমানের জাতিবিরোধী, শান্তিবিরোধী অপরাজনীতিকেই অনুসরণ করে নিজে ও দল দেশের বাঙালী-পাহাড়ীর মধ্যে শান্তি স্থাপনের চেষ্টা না করে শান্তিবিরোধী অবস্থানই গ্রহণ করেছেন, যে অবস্থান থেকে তিনি কখনও সরে আসেননি! তাঁকে জাতীয় নেত্রী হিসেবে পাহাড়ী কেন, পাহাড়ের বাঙালীরাই তো গ্রহণ করতে পারে না! (৮) পাহাড়ে বাঙালী বসতি স্থাপনকারীদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ-চেতনায় বিশ্বাসীদের সংখ্যা কত তা নিয়ে সংশয় আছে। কেননা, পাহাড়ে জামায়াতে ইসলামী ও অন্যান্য মুক্তিযুদ্ধবিরোধী মৌলবাদী দলের সমর্থক সংখ্যা কম নয়। ইসলামী মৌলবাদীরা সহিংসতায় বিশ্বাসী এবং আগ্রাসনের মাধ্যমে দখলদারিত্বে বিশ্বাসী। ফলে, পাহাড়ী, ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ এদের পাশে বার বার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেমন সমতলে শহরে, গ্রামে প্রগতিশীল উদার বাঙালী মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান এদের দ্বারা আক্রান্ত হয়, তেমনই পাহাড়ের তিন জেলায় এমনটি বার বার ঘটেছে! উপরে বর্ণিত স্টেকহোল্ডার ও বসবাসকারীর সবাই পাহাড়ের তিন পার্বত্য অঞ্চলে, কক্সবাজারে নানামুখী স্বার্থরক্ষার লড়াইয়ে যুক্ত। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, এখন সব কথার বড় কথা এবং শেষ কথা-পাহাড়ে কিভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব? প্রথমত, সব স্টেকহোল্ডার ও বাসিন্দা- বাঙালী-পাহাড়ীকে এই বিশ্বাসে উপনীত হবে যে, শান্তিপূর্ণ পরিবেশই সবার কাম্য। সংঘর্ষে সমাধান নেই। সংলাপ, বোঝাপড়াই শান্তির শর্ত। দ্বিতীয়ত, সহিংসতা দ্বারা অপরের ক্ষতি করে নিজের জান-প্রাণ-মাল কিছুই রক্ষা করা যায় না। সুতরাং নিজের স্বার্থে, সন্তানের জানমালের নিরাপত্তার স্বার্থে সহিংস প্রবণ ও সহিংস গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে সহজ এবং স্বাভাবিক জীবনকে গ্রহণ করতে হবে। তৃতীয়ত, নিজেদের নিরাপদ জীবনের স্বার্থে পাহাড়ী-বাঙালীর মধ্যে বিবাদ, সংঘর্ষ বাধিয়ে দিয়ে যারা সুবিধা ভোগ করে তাদেরকে, এই তৃতীয় শক্তিকে চিহ্নিত করতে হবে এবং তাদের পরিচয় মিডিয়ায় উন্মোচন করতে হবে। নিজেরা কোনক্রমেই তাদের হাতের পুতুল না হয়ে গোষ্ঠীবদ্ধভাবে তাদের মোকাবেলা করতে হবে। চতুর্থত, সরকারপ্রধান পাহাড়ী ও বাঙালীদের সঙ্গে টেলি-কনফারেন্সের মাধ্যমে গণশুনানি করতে পারেন, যেখানে পার্বত্য অঞ্চল সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির বাছাইকৃত সদস্যবৃন্দ সরকারপ্রধানের সঙ্গে অংশগ্রহণ করবেন। এতে পাহাড়ীদের পক্ষে সন্তু লারমাসহ পাহাড়ী নেতৃবৃন্দ এবং বাঙালীদের পক্ষে বাঙালী নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি নেতৃত্ব দেবেন। সমাধানের জন্য বিশেষ একটি সালকে চিহ্নিত করে তার পরে আগত বাঙালীদের সমতলে তাদের পূর্ব পুরুষদের জেলায় খাস জমি, এমনকি সরকারের ‘ঘরে ফেরা’, ‘একটি বাড়ি, একটি খামার’ প্রকল্পের মাধ্যমে সমতলে ফিরে আসার প্রস্তাব দেয়া যেতে পারে এ প্রস্তাব শান্তি সন্ধানী বাঙালীদের গ্রহণ না করার বাস্তব কোন কারণ দেখি না। বাঙালীদের একটি অমূলক ভয়-আশঙ্কা, একদল বাঙালী পাহাড় থেকে চলে গেলে সংখ্যায় কমে যাওয়া পাহাড়ে থেকে যাওয়া বাঙালীরা হামলা-আক্রমণের শিকার হবে- এ ধারণাটি তাদের মনে একটি মৌলবাদী গোষ্ঠী তাদের স্বার্থে প্রতিষ্ঠিত করেছে, যার কোন ভিত্তি নেই। কেননা, বিশ্বাস করতে হবে- ‘জোর যার মুল্লুক তার’Ñ এটি শুধু নিরাপত্তাহীন জীবনই উপহার দেয়, যেখানে প্রতি মুহূর্তে জান-মাল হানির পূর্ণ সম্ভাবনা নিয়ে তাদের বসবাস করতে হয়। এটি পাহাড়ে বাসরত কোন বাঙালীর মনের কথা বলে মনে করার কোন কারণ নেই। পাহাড়ের বাঙালীরা মনেপ্রাণে শান্তি চায় এবং তাদের একান্ত ইচ্ছা- প্রধানমন্ত্রী যেন তাদেরও দুঃখের, অনিরাপদ জীবনের কথা শোনেন ও একটি সমাধানের পথ বের করেন। তাদের একটি মনোবেদনা এই যে, সরকার পাহাড়ীদের জন্য শান্তিচুক্তি করেছে। সরকার বাঙালীদেরও, যারা নিজ ইচ্ছায় পাহাড়ে বসতি গড়তে আসেনি, রাষ্ট্রের ভুল নীতির শিকার হয়ে এসেছে, তাদেরকেও সংঘটিত হওয়া অতীত ভুল থেকে উদ্ধার করে মুক্ত নাগরিকের সব সুযোগ-সুবিধা দিয়ে শান্তির জীবনযাপনের সুযোগ দেবে। বাঙালীদের অনুরোধ করব, প্রথম সুযোগেই প্রধানমন্ত্রীর সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর অন্তর্ভুক্ত প্রকল্পগুলোর সুবিধাভোগী হবার প্রস্তাব গ্রহণ করে সময় ও সুযোগ থাকতে নিরাপদ জীবনে ফিরে আসুন। মনে রাখবেন, বর্তমান সরকার যে সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করেছে, তা পরে দ্বিতীয়বার আর নাও আসতে পারে। সময় ও সুযোগ বার বার কিন্তু আসে না। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী প্রতি জেলা থেকে বিদেশে মানবসম্পদ প্রেরণের নীতি গ্রহণ করেছেন। সে সুযোগও আপনারা গ্রহণ করতে পারেন অগ্রাধিকারের দাবি নিয়ে। পঞ্চমত, আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, তারা বিদেশে জাতিসংঘের শান্তি মিশনে যোগ দিয়ে যুদ্ধ-সংঘাত থেকে নাগরিকদের রক্ষা, রিলিফ বিতরণ, নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধান করে শুধু জাতিসংঘ নয়, ঐসব দেশের জনগণের মন জয় করে বিশ্বে প্রশংসিত হচ্ছে, সেখানে স্বদেশের ক্ষুদ্র এই পাহাড়ী অঞ্চলে পাহাড়ীদের প্রাপ্য নাগরিক অধিকার, শান্তিপূর্ণ জীবন ও নিরাপদ জীবন, হামলা-ধর্ষণ-অগ্নিসংযোগের শিকার হওয়া, গৃহহারা হওয়া, ভূমিহারা হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে না- এটি জনগণ বিশ্বাস করতে পারে না। নিরাপত্তা বাহিনী আন্তরিক হলে কত কঠিন সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম হয় তার একটি উদাহরণ, বিএনপি-জামায়াত জোট আমলের শেষ পর্বে র‌্যাব জামায়াতের প্রশ্রয়ে গড়ে ওঠা জেএমবি, বাংলাভাই, আবদুর রহমান গংকে গ্রেফতার করে দেশ-বিদেশের প্রশংসা অর্জন করেছিল। তারা এ কাজে অতি দক্ষ, অবশ্যই তারা পাহাড়ে শান্তিপূর্ণ অবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম। তবে পাহাড়ে দীর্ঘমেয়াদী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকার পাহাড়ী-বাঙালীর দীর্ঘকালের নানামুখী রাজনীতি চর্চার ফলে উদ্ভূত সাংঘর্ষিক বর্তমান পরিস্থিতিতে দুই পক্ষের সঙ্গে দৃঢ়, আন্তরিক, ফলপ্রসূ আলোচনার মাধ্যমে সঠিক যৌক্তিক ও যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সেসব সিদ্ধান্ত দ্রুত বাস্তবায়ন করার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে- এমনই পাহাড়ী এবং পাহাড়ের বাঙালীদের প্রত্যাশা। প্রধানমন্ত্রী প্রথমবার পাহাড়ীদের জন্য শান্তিচুক্তি করে প্রশংসিত হয়েছেন, দ্বিতীয়বারও তিনিই পাহাড়ী ও বাঙালী উভয়পক্ষের শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ জীবনের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করে প্রশংসিত হবেনÑ এটি জনগণের প্রত্যাশা। (সমাপ্ত)
×