ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

রাজধানীর কাটাসুর বস্তিতে আগুন, দুই শিশুর মৃত্যু

প্রকাশিত: ০৫:০৭, ১২ জানুয়ারি ২০১৫

রাজধানীর কাটাসুর বস্তিতে আগুন, দুই শিশুর মৃত্যু

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রাজধানীর মোহাম্মদপুরের রায়ের বাজার কাটাসুর বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকা-ে দুই শিশু প্রাণ হারিয়েছে। সর্বনাশা আগুন ৪০ দোকান ও ৫০০ বসতঘর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এতে শত শত মানুষ ঘরছাড়া হয়েছে। পুড়ে ছাই হয়েছে ওদের স্বপ্ন। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের মোহাম্মদপুর, পলাশী, লালবাগ ও কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ মিলিয়ে ১১ ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালায়। প্রায় দেড় ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। ফায়ার সার্ভিস ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রবিবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে রায়েরবাজার কাটাসুর পুলপাড় বস্তিতে আগুন লাগে। মুহূর্তে আগুন ৫০০ বস্তি ঘরে ছড়িয়ে পড়ে। দাউ দাউ আগুন পুরো বস্তিতে ছড়িয়ে পড়ে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের মোহাম্মদপুর, পলাশী, লালবাগ ও কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ মিলিয়ে ফায়ার সার্ভিসের মোট ১১ ইউনিট ঘটনাস্থলে ছুটে যায়। স্থানীয়দের সঙ্গে নিয়ে প্রায় দেড়ঘণ্টা চেষ্টার পর পৌনে ১০টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। ঘটনাস্থলে দায়িত্বরত ফায়ার সার্ভিসকর্মী জসিম জানান, ক্ষয়ক্ষতি তাৎক্ষণিকভাবে নিশ্চিত করা যায়নি। আগুনে ফাতেমা নামে এক শিশু ও অজ্ঞাতপরিচয় আরও এক শিশুর মৃত্যু হয়। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ফাতেমা নামের শিশুটি তার বস্তিঘরে ঘুমিয়ে ছিল। ঘুমন্ত রেখে তার বড়বোনকে নিয়ে মা নুরুন্নাহার স্কুলে যান। কিন্তু অগ্নিকা-ের খবরে পেয়ে দ্রুত মা নুরুন্নাহার ছুটে আসেন। বাসায় ফিরে আর ফাতেমাকে জীবিত পাননি তাঁরা। ওই বস্তির ক্ষতিগ্রস্ত মনোয়ারা জানান, তিন তলা একটি টং ঘর থেকে অগ্নিকা-ের সূত্রপাত ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক জাহিরুল ইসলাম জানান, বেলা পৌনে ১টার দিকে কাটাসুরের পুলপাড়ের ওই বস্তিতে পুড়ে যাওয়া ঘরের ধ্বংসস্তূপ থেকে ফাতেমা নামে ওই শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়। তিনি জানান, সকাল সাড়ে ৮টার দিকে আগুন লাগার সোয়া এক ঘণ্টার মাথায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। নিহত ফাতেমা বস্তির বাসিন্দা অটোরিক্সাচালক জয়নালের মেয়ে। তার মা নুরুন্নাহার গৃহিণী। নিহতের ফুফু মুন্নী জানায়, সকালে ছোট মেয়েকে ঘরে রেখে নুরুন্নাহার বড় মেয়ে চতুর্থ শ্রেণী ছাত্রী জয়নাবকে পাশের জাফরাবাদ সরকারী স্কুলে নিয়ে যান। পরে নুরুন্নাহার বস্তিতে ফিরে ঘরে আগুন জ্বলতে দেখেন। ওই বস্তিতে ১৯টি বাড়িতে ৫৫১টি পরিবার বাস করত বলে মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান জানান। বাড়িগুলোর অধিকাংশই পুড়ে গেছে বলে বস্তি ঘুরে জানিয়েছেন। ঢাকা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা ইকরামুল হক ঘটনাস্থলে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে প্রাথমিকভাবে ২০ কেজি চাল ও একটি করে কম্বল দেয়ার কথা বলেছেন। তবে আগুন লাগার কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেননি ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা। তবে ওই বস্তি সংলগ্ন একটি বাড়ির বাসিন্দা ডেসার সাবেক কর্মকর্তা মতিউর রহমান জানান, সকাল সাড়ে ৮টার দিকে আগুন আগুন চিৎকার শুনে তিনি বাইরে এসে ধোঁয়া দেখতে পান। কিছুক্ষণের মধ্যেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে। বস্তির চুলা থেকে আগুন লাগতে পারে বলে ধারণা তার। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বস্তির পূর্ব পার্শ্বের ঘরগুলো বেশি আগুনে পুড়েছে। ক্ষতি হয় পশ্চিম পার্শ্বের ঘরগুলোতে। ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে জানানো হয়, সরু পথ হওয়ায় বস্তিতে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করতে ফায়ার কর্মীকে বেশ বেগ পেতে হয়। ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিস এ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশন এ্যান্ড মেনটেইন্যান্স) মেজর একেএম শাকিল নেওয়াজ জানান, আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও পানির অভাবে বেশি বেগ পেতে হয়। তিনি জানান, এলাকার বাসাবাড়ি থেকে পানি কিনে কাজ করেছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। বস্তি এলাকায় প্রবেশের রাস্তা সরু। এ কারণে আমাদের ১১টি ইউনিট থাকলেও সবগুলো দিয়ে কাজ করতে পারিনি। দাউ দাউ করে আগুনে পুড়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখছিলেন সাহিদা বেগম। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে তিনি ঘর পোড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজের স্বপ্ন পোড়ার দৃশ্যে দেখে হাউ মাউ করে কাঁদছিলেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে সাহিদা বেগম জানান, তাঁর মেয়ের বিয়ে সামনে। কানের আর হাতের গহনা দেয়ার শর্তে বিয়ে ঠিক হয়েছে। হবু বর জিলানের পরিবার থেকে সাফ জানিয়ে দেয়া হয়েছে গয়না না দিলে তাঁর মেয়ে সঙ্গে বিয়ে দিবে না। স্বামী মোহাম্মদ আলী রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। আর সাহিদা করেন বাসা বাড়িতে বুয়ার কাজ। এ ভাবেই খেয়ে না খেয়ে সংসার চলতো তাঁদের। অর্থের অভাবে মেয়েকে লেখাপড়াও শেখাতে পারেননি সাহিদা। সাহিদা আর মোহাম্মদ আলী তিল তিল করে ২৫ হাজার টাকা জমিয়েছিলেন মেয়ের বিয়ের গহনা কিনবেন বলে। আর সেই টাকা ছিল পুলপাড় বস্তির ঘরে। অগ্নিকা-ে পুড়ে গেছে তাঁর জমানো ২৫ হাজার টাকা। সেই সঙ্গে পুড়ে গেছে তাঁদের সব স্বপ্নও। মেয়ের বিয়ে বুঝি আর হলো না। এই বলে সাহিদা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। এদিকে অগ্নিকা-ের পর ঘটনাস্থলে গিয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক সাংবাদিকদের জানান, পুলপাড় বস্তির ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে সরকার পুনর্বাসিত করবে। তিনি জানান, দুই ধরনের পুনর্বাসনের কথা চিন্তা করা হচ্ছে। একটি আপদকালীন ও অপরটি স্থায়ী পুনর্বাসন। পরিবারগুলো যেন শীতে কষ্ট না পায় সেজন্য তাদের আপাতত আপদকালীন পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করবে সরকার। স্থায়ী পুনর্বাসনের বিষয়ে পরে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। আগুন লাগার কারণ বিষয়ে তিনি জানান, কীভাবে আগুন লাগল। সে বিষয়ে এখন পর্যন্ত কিছু জানা যায়নি। তবে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এদিকে রাজধানীর কাটাসুরে অগ্নিকা-ে দুই শিশুর মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধামন্ত্রীর প্রেস উইং থেকে পাঠানো শোক বিবৃতিতে বলা হয়, নিহতদের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জনিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
×