ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

একনেকে প্রথম সংশোধনী প্রস্তাব উঠছে কাল ॥ সরকারী তহবিলের ব্যয় কমছে

প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়নে অর্থ সহায়তা বাড়াচ্ছে দাতারা

প্রকাশিত: ০৫:০০, ১২ জানুয়ারি ২০১৫

প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়নে অর্থ সহায়তা বাড়াচ্ছে দাতারা

হামিদ-উজ-জামান মামুন ॥ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়নে অতিরিক্ত অর্থায়ন করছে দাতারা। ফলে এটি বাস্তবায়নে বৈদেশিক সহায়তা অংশের বরাদ্দ বাড়ছে। তবে কমছে সরকারী অংশের ব্যয়। এসব কারণে কর্মসূচীটির প্রথম সংশোধন করা হচ্ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাব পাওয়ার পর প্রক্রিয়াকরণ শেষে অনুমোদনের জন্য মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে উপস্থাপন করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। এ পর্যায় সংশোধনীতে মোট কর্মসূচীর ব্যয় ২২ হাজার ১৯৬ কোটি টাকা থেকে ৪ হাজার ৩২ কোটি টাকা কমে দাঁড়াচ্ছে ১৮ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা। তবে মোট ব্যয় কমলেও দাতাদের অংশের অর্থায়ন বাড়ছে বলে জানা গেছে। মঙ্গলবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠেয় একনেক বৈঠকে সভাপতিত্ব করবেন প্রধানমন্ত্রী ও একনেক চেয়ারপার্সন শেখ হাসিনা। সূত্র জানায়, এ কর্মসূচীটি বাস্তবায়নে বিশ্বব্যাংক দিচ্ছে ৪০ কোটি মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা। এছাড়া এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকও দিচ্ছে ১২ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশী মুদ্রায় এক হাজার কোটি টাকা। সম্প্রতি অতিরিক্ত এ অর্থায়নের বিষয়টি অনুমোদন দিয়েছে বিশ্বব্যাংক বোর্ড। সংস্থাটি জানায়, চলমান তৃতীয় প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচীর জন্য আরও ৪০ কোটি মার্কিন ডলারের অতিরিক্ত অর্থায়নের মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তির হার ৯৮ শতাংশ এবং প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনের হার ৮০ শতাংশে উন্নীত করে প্রাথমিক শিক্ষা মানের অগ্রগতি অব্যাহত রাখা হবে। এছাড়া এ প্রকল্পের আওতায় মেধাভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ ও শূন্যপদ পূরণের নিশ্চয়তা বিধানে প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। উপরন্তু, শিক্ষা বছরের প্রথম মাসেই ৯০ শতাংশ স্কুলে পাঠ্যবই বিতরণ নিশ্চিত করা হবে। এ কর্মসূচীর দায়িত্বপ্রাপ্ত বিশ্বব্যাংকের টিম লিডার আয়েশা ভাওদা বলেছেন, সরকারের নেতৃত্বে পরিচালিত কর্মসূচীর জন্য অতিরিক্ত অর্থায়নের মাধ্যমে ১ কোটি ৯০ লাখ শিশুকে স্কুলমুখী করা এবং মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রদান ও প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করা নিশ্চিত হবে। আরও বেশিসংখ্যক শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসা ছাড়াও এ কর্মসূচীর অধীনে বিশেষ করে অনগ্রসর এলাকাসমূহে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা অব্যাহত রাখা হবে এবং স্কুলের সুযোগ-সুবিধা ও অবকাঠামো মান উন্নত করা হবে। এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের দায়িত্বপ্রাপ্ত অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব কাজী শফিকুল আজম জনকণ্ঠকে জানান, প্রাথমিক শিক্ষা খাত উন্নয়নে দাতাদের সহায়তায় বাস্তবায়নাধীন মেগা এ কর্মসূচীর জন্য অতিরিক্ত অর্থায়ন হিসেবে বিশ্বব্যাংক এ সহায়তা দিচ্ছে। শুধু বিশ্বব্যাংকই নয় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকও (এডিবি) অতিরিক্ত অর্থায়ন করছে। কর্মসূচীটি বাস্তবায়নে উন্নয়ন সহযোগীরা সন্তুষ্ট হয়েছে বলেই অতিরিক্ত অর্থায়ন করছে। আমরা আগামী কয়েক বছর কর্মসূচীটি বাস্তবায়নে অর্থায়নের গ্যাপ নির্ধারণ করেছি। সেখানে বিশ্বব্যাংক ও এডিবির কাছ থেকে কত টাকা নেয়া হবে এবং সরকারী তহবিলের কত টাকা প্রয়োজন হবে তা নির্ধারণ করেছি। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ সূত্র জানায়, প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়ন, শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিতকরণ ও শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের দক্ষতা বাড়াতে ২০১১ সালে এ কর্মসূচী হাতে নেয় সরকার। দাতা গোষ্ঠীর সহায়তা নির্ভর মেগা কর্মসূচী বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয় ২২ হাজার ১৯৬ কোটি টাকা। এটি বাস্তবায়নে শুরুতেই বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন করেছিল প্রায় দুই হাজার ৭০০ কোটি টাকা এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) অর্থায়ন করেছিল প্রায় দুই হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এ ছাড়াও অর্থায়নে সহায়তা করেছিল ডিএফআইডিসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থা। এ কর্মসূচীটি বাস্তবায়নে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক অতিরিক্ত অর্থায়ন হিসেবে দিচ্ছে ১২ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার যা বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। এ বিষয়ে এডিবি ডেস্কের দায়িত্বপ্রাপ্ত অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন আহমেদ জনকণ্ঠকে জানান, এ বিষয়ে এডিবির একটি মিশন ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ সফর করেছে। এ সময় অতিরিক্ত অর্থায়নের বিষয়ে সম্মতি পাওয়া গেছে। তিনি আরও বলেন, কর্মসূচীটি বাস্তবায়নে এডিবি সন্তুষ্ট হয়েছে বলেই অর্থায়ন করছে। পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, পিউডিপি-৩ কর্মসূচীর অধীনে দেশব্যাপী ৩ হাজার ৬৮৫টি শ্রেণী কক্ষ নির্মাণ, ২ হাজার ৭০৯টি বিদ্যালয় পুনর্নির্মাণ, একজন শিক্ষকের অনুকূলে ৪০ জন ছাত্রের সমন্বয় তথা অনুপাত ১ : ৪০ তে নামিয়ে আনা, ১ লাখ ২৮ হাজার ৯৫৫টি টয়লেট স্থাপন, ৪৯ হাজার ৩০০টি নলকূপ, ৫৩ হাজার ৭৫০টি প্রশ্রাবখানা নির্মাণ, ১১ হাজার ৬০০টি শ্রেণী কক্ষ মেরামত ও জেলা উপজেলায় রিসোর্স সেন্টার করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। সূত্র জানায়, প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচী-৩ (পিইডিপি-৩) কর্মসূচীতে একক অডিট সংক্রান্ত জটিলতার সৃষ্টি হলেও তা শেষ পর্যন্ত কেটে গেছে। এতদিন অন্যান্য প্রকল্পে বৈদেশিক সহায়তা ও সরকারী অংশের টাকা আলাদা আলাদা করে অডিট করা হলেও এ কর্মসূচীতে এসে দাতারা দুটি মিলে একটি অডিট প্রতিবেদন চাওয়ায় এ জটিলতা দেখা দেয়। কেননা বৈদেশিক অংশ অডিট করার দায়িত্ব হচ্ছে ফরেন এইড এইডেট প্রজেক্ট অডিট ডিরেক্টরেট নামের একটি সংস্থার আর সরকারী অর্থের অডিটের দায়িত্ব হচ্ছে কম্পোট্রোলার এ্যান্ড অডিটর জেনারেলের (সিএনজি অফিস)। এক সঙ্গে প্রতিবেদন চাওয়ায় কোন সংস্থা অডিট করবে তা নিয়ে মতদ্বৈততার সৃষ্টি হয়। ফলে অর্থ ছাড়ের বিষয়টি অনিশ্চয়তায় পড়েছিল। অবেশেষে শুধু এ কর্মসূচীটির জন্য সিএনজি অফিসের বিশেষ ব্যবস্থায় দুটো অডিট প্রতিবেদন এক সঙ্গে করবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন থেকে চলতে থাকা নয়টি দাতা সংস্থার অর্থায়নে এ কর্মসূচী থেকে অডিট সংক্রান্ত জটিলতা কেটে গেছে। এ বিষয়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ও বিশ্বব্যাংক ডেস্কের প্রধান কাজী শফিকুল আজম জনকণ্ঠকে বলেন, অডিটের বিষয়টি নিয়ে যে সমস্যা ছিল তা কেটে গেছে। এখন যেটি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে তা হলো গত দুই বছর যেভাবে বিশেষ ব্যবস্থায় অডিট কাজ পরিচালিত করা হয়েছিল শুধু এ কর্মসূচী চলার সময় সে রকমই বিশেষ ব্যবস্থায় অডিট করা হবে। অন্য কোন প্রকল্পে দাতারা এ ধরনের শর্ত দিলে সে ক্ষেত্রে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে না। পিইডিপি-৩ কর্মসূচীতে অর্থায়নকারী দাতা সংস্থাগুলো হচ্ছে, বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), ডিএফআইডি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস এইড, সিডা, জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা), কানাডিয়ান সিডা এবং ইউনিসেফ। সূত্র জানায়, গত মার্চ মাসে বিশ্বব্যাংকের এক মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল শিক্ষা খাতে ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করেছে বাংলাদেশ। শিক্ষার প্রায় সব ক্ষেত্রেই অভিগম্যতা ও সমতা অর্জনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে উপবৃত্তি। সংস্থাটির মতে, উপবৃত্তি প্রদানের মাধ্যমে অধিক সংখ্যায় নিম্ন আয়ভুক্ত পরিবারের শিশু ও মেয়েদের ভর্তির ব্যবস্থা করে বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষায় প্রায় সর্বজনীন অভিগম্যতা অর্জন করে ফেলেছে। প্রাথমিক স্কুলে মোট ভর্তির হারে শতভাগসহ অন্যান্য শিক্ষায় ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করেছে বাংলাদেশ। ওই মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বাংলাদেশ অবিচলভাবে শিক্ষায় অভিগম্যতা বাড়িয়েছে, যার ফলে প্রাথমিক স্কুলে মোট ভর্তির হার ৯১ শতাংশ থেকে বেড়ে ১০০ শতাংশের উপরে হয়েছে। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তির হার ৫২ থেকে ৬২ শতাংশ হয়েছে। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীতে ভর্তির হার ৩৩ থেকে ৪৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির হার ৭ থেকে ১০ শতাংশ হয়েছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে উপবৃত্তি। সংস্থাটির মতে, উপবৃত্তি প্রদানের মাধ্যমে অধিক সংখ্যায় নিম্ন আয়ভুক্ত পরিবারের শিশু ও মেয়েদের ভর্তির ব্যবস্থা করে বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষায় প্রায় সর্বজনীন অভিগম্যতা অর্জন করে ফেলেছে। সংস্থাটির হিসাবে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় বাংলাদেশ নারী-পুরুষ সমতাও অর্জন করেছে। এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি মেয়ে মাধ্যমিক স্কুলে পড়াশোনা করতে পারে। মাধ্যমিক পর্যায়ে এখন ছেলের চেয়ে মেয়ের সংখ্যা বেশি। মেয়েদের ক্ষেত্রে নেট ভর্তির হার ৪৪ থেকে বেড়ে ৫৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। আর ছেলেদের ক্ষেত্রে এ হার ৩২ থেকে ৪৫ শতাংশ হয়েছে। আগের চেয়ে বেশি শিক্ষার্থী এখন স্কুলে টিকে থাকছে। গত ৩০ বছরে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করা মানুষের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। শিক্ষার্থীরা গড়ে যে কয়টি শ্রেণী অতিক্রম করতে পারে তার সংখ্যা বেড়েছে। এমনকি দরিদ্রদের ৫৭ শতাংশ ও সাধারণ পরিবারের শিশুদের ৮৩ শতাংশ প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে।
×