ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বিজ্ঞান ও শিল্প প্রযুক্তিমেলা

ক্ষুদে বিজ্ঞানীদের অভিনব আবিষ্কার, বিজ্ঞানমনস্ক করার উদ্যোগ

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ১১ জানুয়ারি ২০১৫

ক্ষুদে বিজ্ঞানীদের অভিনব আবিষ্কার, বিজ্ঞানমনস্ক করার উদ্যোগ

মোরসালিন মিজান এইটুকুন বয়স। তাতে কী? বড়দের মতো কাজ। দারুণ দারুণ সব উদ্ভাবন। বিজ্ঞান পড়া শুধু নয়। বিজ্ঞানের যে জ্ঞান, তার চমৎকার ব্যবহার। স্কুল-কলেজের ক্ষুদে বিজ্ঞানীরা কত কী যে আবিষ্কার করে দেখিয়েছে! সেইসঙ্গে ছিল স্বশিক্ষিত বিজ্ঞানীদের গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন। সব মিলিয়ে বিজ্ঞান ও শিল্প প্রযুক্তিমেলা ২০১৫। প্রতিবারের মতো এবারও বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের ক্যাম্পাসে এই মেলার আয়োজন করা হয়। মেলা উপলক্ষে গত তিন দিন উৎসবমুখর ছিল গোটা এলাকা। আগামী দিনের নাগরিকদের বিজ্ঞানমনস্ক করে গড়ে তোলা, ক্ষুদে বিজ্ঞানীদের আরও উৎসাহ দেয়া, মেধার যথার্থ স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে নতুন নতুন আবিষ্কারের সুযোগ করে দেয়াই ছিল মেলার উদ্দেশ্য। বৃহস্পতিবার শুরু হওয়া মেলায় চারটি দলে ৪৫০ জন ক্ষুদে বিজ্ঞানী অংশ নেয়। ষষ্ঠ থেমে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত ‘ক’ বিভাগ। এই বিভাগে ৮ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১৫৫ জন বিজ্ঞানীরা মোট ৫৫টি প্রকল্প উপস্থাপন করে। এসব প্রকল্পের মধ্যে ডিজিটাল ফ্লাইওভার, স্বয়ংক্রিয় বৈদ্যুতিক আলো, ড্রেনের পানি ব্যবহার করে পরিকল্পিত নগরায়ন, পুরনো ট্রান্সমিটার ব্যবহার করে সৌরবিদ্যুত ইত্যাদি অন্যতম। নবম থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত ‘খ’ বিভাগ। এ বিভাগের ১০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১২৫ জন ক্ষুদে বিজ্ঞানী ৪৫টি প্রকল্প উপস্থাপন করে। এগুলোর মধ্যে ছিল ফরমালিনমুক্ত পারিবারিক মৎস্য প্রকল্প, রান্নাঘরের ব্যবহার্য পানি পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ ও সাগরের ঢেউ থেকে শক্তি উৎপাদন ইত্যাদি। ‘গ’ বিভাগে ছিল কলেজের শিক্ষার্থীরা। এ বিভাগে ১১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৯০ জন শিক্ষার্থী উপস্থাপন করে ৩৫টি প্রকল্প। একটু ব্যতিক্রম ‘ঘ’ বিভাগ। এ বিভাগের সবাই স্বশিক্ষিত বিজ্ঞানী। ৩০ প্রতিষ্ঠানের ৮০ জন স্বশিক্ষিত বিজ্ঞানী ৩৫টি প্রকল্প নিয়ে হাজির হয়। গত তিন দিন মেলা ঘুরে দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি স্টলের সামনেই কৌতূহলীদের ভিড়। বিভিন্ন বয়সী মানুষ স্টল ঘুরে দেখছেন। তাঁদের উদ্ভাবনের খুঁটিনাটি বুঝিয়ে বলছেন উদ্ভাবকরা। এরপরও প্রশ্ন। সব প্রশ্নের জবাব দিতে হচ্ছিল। তবুও ক্লান্তি নেই। তবুও হাসিমুখ। ঢাকার ওয়াই-ডব্লিউসিএ গার্লস স্কুলের একটি স্টলে গিয়ে দেখা যায় বিভিন্ন গাছের পাতা। জাম, টমেটো, আতা ও নিম গাছের পাতা সামনে মেলে ধরা। কী হবে এসব পাতা দিয়ে? জানতে চাইলে চমৎকার শুরু করে ফাবিহা আলম রাহা। মিষ্টি দেখতে মেয়েটি যারপরনাই আত্মবিশ্বাসী। যেন বিজ্ঞানের ম্যাডাম সে। তার ব্যাখ্যা থেকে বেরিয়ে আসে এ পাতাগুলোর বহুবিধ ব্যবহার। পাতার বিভন্ন উপাদান কাজে লাগিয়ে তারা এক ধরনের তরল তৈরি করেছে। একেকটি তরলের একেক রকমের কার্যকারিতা। জানা গেল, টমেটো পাতা থেকে বিষাক্ত এ্যালকোলয়েড নিয়ে তারা তৈরি করেছে কীটনাশক। এটি ব্যবহার করে ছিটপোকা দমন করা যাবে। নিমের তেল ডিডারজেন্ট ও পানি দিয়ে তৈরি কীটনাশকও পোকামাকড়কে বাঁচতে দেবে না। বীজকে ছত্রাকমুক্ত করতে কাজ করবে জামপাতা। পাশেই আরেক টেবিলে বীজতলা করে দেখানো হয়েছে। শুষ্ক বীজতলা থেকে পাওয়া ধানের চারাও রাখা ছিল এক পাশে। পুরো বিষয়টি ব্যাখ্যা করে সাবিহা সাদমিন সুনন্দা। তারও বুদ্ধিদীপ্ত উপস্থাপনা। ক্ষুদে বিজ্ঞানী জোর দিয়েই বলল, তাদের উদ্ভাবন ব্যবহার করা হলে ফসল উৎপাদন বাড়বে। এজন্য খরচও হবে কম। মেলায় শহীদ পুলিশ স্মৃতি কলেজের ছিল বেশ কয়েকটি স্টল। একটিতে গিয়ে দেখা যায়, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ইউটার্ন রোডমডেল। উদ্ভাবক সাবিহা, অনামিকা ও হিমু। জানতে চাইলে তারাও প্রকল্প কিভাবে কাজ করবে তা দেখিয়ে দেয়। সে অনুযায়ী, বিপরীত দিক থেকে আসা দুটি গাড়ির একটি আরেকটিকে না দেখলেও সমস্যা নেই। কাছাকাছি দূরত্বে আসলে উভয় গাড়িকে দুটি স্পিডব্রেকার অতিক্রম করতে হবে। আর তখনই বিশেষ সংকেত দেবে ল্যাম্পপোস্ট। বেল বেজে ওঠবে। তাতেই চালক বার্তা পেয়ে যাবেন সামনে আরেকটি গাড়ি আছে। মেলায় হলিক্রস গার্লস হাইস্কুলের মেয়েরা তৈরি করে নিয়ে এসেছিল বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র। পানির পাইপ, ড্রাম, গরুর চর্বি ইত্যাদি পরিত্যক্ত উপাদান দিয়ে তারা তৈরি করেছিল একতারা, গিটার, ডুগডুগি, বাঁশিসহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র। সেগুলো কী করে বানানো হলো তা ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দেয় তাসলিম মারজানা, নবান্ন তেরেজাসহ কয়েকজন। বাজিয়েও শোনায়। বিসিএসআইআর উচ্চ বিদ্যালয়ের বেশকিছু স্টল ছিল মেলায়। একটি স্টলে গিয়ে দেখা গেল অভিনব শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র। প্লাস্টিকের বালতির নিচের অংশে বরফ জমা করে উপরিভাবে একটি টেবিল ফ্যান উপুড় করে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। তারপর স্কচটেপ দিয়ে ভাল করে আটকে দেয়া হয়েছে। বালতির গায়ে তিনটি ছিদ্র করে বসানো হয়েছে সরু পাইপ। ফ্যান চালু করলে বাতাস বরফ ছুঁয়ে পাইপের ভেতর দিয়ে বের হয়ে আসতে থাকে। আবিষ্কারকদের পক্ষে মোঃ রাশেদ হাত ফ্যান চালালে সেই বাতাসে হাত রেখে দেখা যায়, আসলেই এসির হাওয়ার মতো ঠাণ্ডা! মেলায় স্বশিক্ষিত বিজ্ঞানীরাও নিজেদের আবিষ্কার দিয়ে বিচারকদের একরকম অবাক করে দেয়। সব মিলিয়ে বিজ্ঞানমনস্ক করার কার্যকর একটি উদ্যোগ। পুরস্কার বিতরণীর মধ্য দিয়ে শনিবার বিজ্ঞান ও শিল্প প্রযুক্তিমেলা শেষ হয়েছে।
×