ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

গণতন্ত্রের নতুন যাত্রা

প্রকাশিত: ০৪:৩৮, ১১ জানুয়ারি ২০১৫

গণতন্ত্রের নতুন যাত্রা

শ্রীলঙ্কার বিদায়ী প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসের কট্টর সমর্থকরা ছাড়া মৈত্রীপালা সিরিসেনার বিজয় নিয়ে কারও মনে কোন সন্দেহ ছিল না। সিরিসেনা ছিলেন ৮ জানুয়ারির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিরোধী দলের অভিন্ন প্রার্থী। কিন্তু এতে সরকারী ফলাফল পুরোপুরি বের হওয়ার আগেই পরাজয় মেনে নিতে এবং সরকারী বাসভবন ছেড়ে যেতে রাজাপাকসের সিদ্ধান্ত তাঁর সমর্থক ও বিরোধীকে সমভাবে বিস্মিত করেছে। শ্রীলঙ্কায় তিন দশক ধরে গৃহযুদ্ধ এবং অর্ধ দশক ধরে আধা একনায়কতন্ত্র সুলভ শাসন চলার পর অপেক্ষাকৃত শান্তিপূর্ণ পরিবেশেই নির্বাচনী প্রচার চলে। আর এরপর নির্বাচনোত্তর সহিংসতা ছাড়াই ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তর দেশটির গণতন্ত্রের টিকে থাকার সামর্থ্যই প্রমাণ করে। বিশ্লেষণ হিন্দু অনলাইনের। রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ ও জ্যোতিষী পরামর্শের ভিত্তিতে রাজাপাকসে সংবিধান নির্ধারিত সময়ের দু’বছর আগেই ২০১৪-এর নবেম্বরে নতুন করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আহ্বান করেন। তিনি নজিরবিহীনভাবে তৃতীয় বারের মতো প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হন। তিনি শ্রীলঙ্কার সংবিধান সংশোধন করে নিজের জন্য সেই সুযোগ তৈরি করে নেন। তিনি তৃতীয় মেয়াদের জন্য নির্বাচিত হলে শ্রীলঙ্কা রাষ্ট্রের ওপর তাঁর পরিবারের নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত থাকত এবং এর পিছনে সমর্থন যোগাতো রাজনৈতিক বশংবদদের এক জোট এবং তাঁর ও তাঁর পরিবারের সৃষ্ট নতুন ব্যবসায়ী শ্রেণী। তবে অনেক পর্যবেক্ষক সঙ্গত কারণেই আশঙ্কা করেছিলেন, রাজাপাকসে তৃতীয় বারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে শ্রীলঙ্কার গণতন্ত্রের জীবনীশক্তির অবশিষ্টটুকুও নিঃশেষিত হয়ে যাবে। সাধারণ মানুষের নামে একনায়কোচিত শাসনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের ক্ষেত্রকে আরও সঙ্কুচিত করা হলে তিনি তাঁর উন্নয়নবাদী জাতীয় নিরাপত্তামুখী রাষ্ট্রের মডেলকে আরও সুসংহত করার সুযোগ পেতেন। শ্রীলঙ্কার ভোটারদের গণতান্ত্রিক ইচ্ছা এখন ওই সব সম্ভাবনাকর পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে। নতুন প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা কিভাবে তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পালন করবেন? তাঁর সুশাসনের স্বার্থে সরকার পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতিই শ্রীলঙ্কার ভোটারদের উজ্জীবিত করেছিল। সিরিসেনা নির্বাচনী প্রচারের গণতান্ত্রিক ও দুর্নীতিমুক্ত শাসন প্রতিষ্ঠা, পারিবারিক শাসন ও স্বজনপ্রীতির অবসান ঘটানো এবং সরকারের মূল প্রতিষ্ঠানগুলোর বিশেষত আইনসভা ও বিচার বিভাগের স্বায়ত্তশাসন পুনরুজ্জীবিত করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এ ধরনের স্বদেশীয় গণতান্ত্রিক সংস্কারের এজেন্ডা প্রধানত রাজাপাকসের পাঁচ বছরের আধা-একনায়কতান্ত্রিক ও পরিবারকেন্দ্রিক ধরনের শাসনের বিরোধিতা করতেই উদ্ভাবন করা হয়। সিরিসেনা ও তাঁর নিউ ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (এনডিএফ) তাঁদের রাজনৈতিক এজেন্ডায় দু’ধরনের রাজনৈতিক সংস্কারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন: রাষ্ট্রীয় সংস্কার ও শাসন সংস্কার রাষ্ট্রীয় সংস্কার এজেন্ডায় সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে শ্রীলঙ্কা রাষ্ট্রের পূর্ণ গণতন্ত্রায়নের দিকে দৃষ্টি দেয়া হয়। নির্বাহী বিভাগ প্রেসিডেন্সিয়াল ব্যবস্থার ও সংবিধানের ১৮তম সংশোধনীর রদকরণই এর দুটি মূল উপাদান। এ সংশোধনী প্রেসিডেন্ট পদকে প্রভূতভাবে শক্তিশালী ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ করে তুলে। আগের নির্বাচনগুলোর সঙ্গে পার্থক্যক্রমে, এবারের নির্বাচনে অঞ্চলভিত্তিতে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং জাতিগত সংখ্যালঘুদের অধিকারগুলো রাষ্ট্রীয় সংস্কার এজেন্ডায় কোন স্থান পায়নি। বিস্ময়ের কথা, তামিল ও মুসলিম দলগুলো সিরিসেনাকে সমর্থ এবং ৮ জানুয়ারি তাঁর বিজয় নিশ্চিত করলেও ক্ষমতা হস্তান্তরের কোন প্রতিশ্রুতির জন্য দরকষাকষি করেনি। তারা প্রধানত তাঁর সরকার পরিবর্তন ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় সংস্কারের প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতেই তাঁকে সমর্থন করেছিল। এতে রাজাপাকসে পরবর্তী যুগে নতুন রাজনীতির সূচনা করতে শ্রীলঙ্কার অধিকাংশ রাজনৈতিক স্বার্থসংশ্লিষ্টদের তাগিদবোধই প্রতিফলিত হয়। ২০১৬-এর আগে অনুষ্ঠেয় পার্লামেন্টের পরবর্তী নির্বাচনে তামিল ও মুসলিম সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক অনুভূতি বড় ধরনের গণতান্ত্রিক সংস্কারের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকবে না। অঞ্চল ভিত্তিতে ক্ষমতা হস্তান্তর ও সমঝোতার প্রশ্নটিও কোনদিন রাজনৈতিক এজেন্ডায় ফিরে আসবে।
×