ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

স্মরণে চির অম্লান ॥ মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান

প্রকাশিত: ০৪:২৯, ১১ জানুয়ারি ২০১৫

স্মরণে চির অম্লান ॥ মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান

আজ ১১ জানুয়ারি। গত বছরের এই দিনে নির্ভীক, সত্যনিষ্ঠ, জাতির বিবেক মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান (১৯২৮-২০১৪) ইন্তেকাল করেন। পঁচাশি বছর বয়সের পরিপূর্ণ কর্মময় জীবনের অধিকারী ছিলেন তিনি। জীবনপাত্র তাঁর অসাধারণ কর্মযজ্ঞে ষোলোআনাই পূর্ণ ছিল। জীবনের শেষের দিকে জাতির অভিভাবক রূপে তিনি নিজ কর্ম ও যোগ্যতা বলেই আসীন হয়েছিলেন। জাতির দুর্যোগ ও দুঃসময়ে তিনি আমাদের যে পথ দেখিয়েছিলেন তাঁর মাঝেই আমাদের কল্যাণ ও মুক্তি নিহিত ছিল। বিচারিক জীবনে সর্বোচ্চ পদোন্নতি হয়েছিল তাঁর। ১৯৯৬ সালে জাতির এক কঠিন সময়ে তিনি দ্বিতীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। দক্ষতা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে সে দায়িত্ব তিনি সর্বোচ্চ নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে পালন করেছিলেন। তাঁর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধানের স্বল্প সময়ও তাঁর সামনে দেখা দিয়েছিল অনভিপ্রেত কিছু চ্যালেঞ্জ। ধৈর্য ও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সে চ্যালেঞ্জ তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে মোকাবেলা করেছিলেন। রক্তপাতের আশঙ্কা দূর হয়েছিল তাতে এবং শান্তিও পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। শান্তিপূর্ণভাবে অবাধ ও নিরপেক্ষ সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৯৬ সালের জুন মাসে। বিচারপতি হিসেবে তাঁর দীর্ঘ সময়ের অভিজ্ঞতাই প্রমাণ করে যে এ ধরনের দুরূহ কাজ তাঁর নেতৃত্বেই সম্ভব। একটু পেছনে ফিরে গেলে মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের জীবনের একটি পরিপূর্ণ রূপ আমরা দেখতে পাব। মেধাবী ছাত্র ছিলেন তিনি বরাবরই। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার নেতৃত্বে অনেকের সঙ্গে হাবিবুর রহমানও শামিল ছিলেন। কোন রাজনৈতিক অভিলাষ থেকে নয়, কেবল মাতৃভাষাকে ভালবেসে এই প্রতিবাদ করাটাকে তিনি কর্তব্য বলে মনে করেছিলেন। পঞ্চাশের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ লাভের পরও যখন দেখলেন তাঁর ভাষা আন্দোলনের সময় স্বল্প কারাবাস কর্তৃপক্ষের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি অনায়াসে ছেড়ে দিলেন। সেখানেও তিনি প্রতিবাদের এক অভিনব পন্থা উদ্ভাবন করেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের মূল ভবনের সামনে গলায় ট্রে ঝুলিয়ে সিগারেট বিক্রি করেন। ‘শেলীজ ওন শপ’ শুধু তাঁর নিজেরই ছিল না, তার মধ্য দিয়ে প্রকাশও পেয়েছিল তাঁর নিজের চিন্তা, প্রচলিত উপায়ের বাইরে প্রতিবাদের অভিনবত্বে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় অধিকৃত দেশের রুদ্ধশ্বাস অবস্থায় তিনি শুরু করেছিলেন যথাশব্দ রচনার। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মুক্তকণ্ঠে অশেষ সাধুবাদ জানিয়েছিলেন তাঁকে এই বিশাল কর্মযজ্ঞের জন্য। অভিধান জাতীয় কাজ- ‘যথাশব্দ’ প্রণয়নের পরও অব্যাহত ছিল। কোরান সূত্র, বচন ও প্রবচন, মিত্রাক্ষর, যার যা ধর্ম এবং রবীন্দ্রনাথের বাণী সঙ্কলন- মাতৃভাষার সপক্ষে রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্র প্রবন্ধের সংজ্ঞা ও পার্থক্য বিচার, রবীন্দ্র রচনা, রবীন্দ্র ব্যাখ্যা, রবীন্দ্রবাক্যে আর্ট সঙ্গীত ও সাহিত্য, রবীন্দ্র-রচনায় আইনী ভাবনা। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে কবি, তুমি নহ গুরুদেব- এর মতো উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ সঙ্কলনও তাঁর রয়েছে। কতভাবে যে মাতৃভাষা এবং তার প্রতি আমাদের কর্তব্যের কথা তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন- ‘আমরা কি যাব না তাদের কাছে যারা শুধু বাংলায় কথা বলে’, ‘একুশে ফেব্রুয়ারি সকল ভাষার কথা কয়’, ‘বাংলার সংগ্রাম এখনও অসমাপ্ত’- প্রভৃতি গ্রন্থে। নানান দেশের কবিদের মাতৃভাষা-বন্দনার সঙ্কলনের কথাও এ প্রসঙ্গে স্মরণযোগ্য। ‘বাংলাদেশের সংবিধানের শব্দ ও খ-বাক্য’- আরেকটি প্রয়োজনীয় গ্রন্থ। যাঁরা বাংলাভাষায় লিখিত সংবিধান বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহার বা প্রয়োগ করতে চান, তাঁদের জন্য অত্যাবশ্যক এ বইটি। বাংলায় আইনচর্চার ক্ষেত্রে মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ও অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের যৌথ সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘আইন-শব্দকোষ’ আইনজীবীদের কাছে ব্যাপকভাবে সমাদৃত একটি গ্রন্থ। মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের নিজের অধীত বিষয় ছিল ইতিহাস। নিজের অর্জিত বিশ্বাস ও জ্ঞান থেকে তাঁর অসাধারণ কীর্তি- ‘গঙ্গাঋদ্ধি থেকে বাংলাদেশ।’ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তিন মাসের কর্মসময়ে তিনি চমৎকারভাবে বিধৃত করেছিলেন ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়ভার’ বইটিতে। এ ছাড়াও দেশ সম্পর্কে তাঁর নানান ধরনের ভাবনা অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত ও ক্ষুরধার লেখনীতে ধরা পড়েছে ‘চাওয়া-পাওয়া ও না পাওয়ার হিসাব’, ‘স্বপ্ন’, ‘দুঃস্বপ্ন ও বোবার স্বপ্ন’ এবং ‘বাংলাদেশ দীর্ঘজীবী হোক’ গ্রন্থসমূহে। মানব জীবনের সকল দিকেই তাঁর ব্যাপক উৎসাহ ছিল ভালমন্দ, লঘু-গুরুতর সব বিষয়ে। তাঁর অসাধারণ জ্ঞান ও মনীষা তাঁকে উদার মনের অধিকারী করেছিল। পরমতসহিষ্ণুতা ছিল তাঁর এক অসাধারণ গুণ। প্রকৃত রাষ্ট্রনায়ক কিংবা সার্থক বিচারকের একটি ছায়া হাবিবুর রহমানের চরিত্রে বেশ প্রবলভাবেই বিরাজমান থাকলেও স্বরূপ ও উত্তরাধিকারের বিষয়টি ছিল আরও গভীর ও বিস্তৃত। নিভৃতচারী, অক্লান্ত পরিশ্রমী এই কৃতীবিদ্য মানুষটি আদালতে বাংলা ভাষা প্রচলনের তাগিদ দেয়া থেকে শুরু করে বাংলা ভাষার ভিন্নধর্মী অভিধান কিংবা বাঙালীর ইতিহাস রচনাও করেছেন সাফল্যের সঙ্গে। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে অনুবাদ করেছেন পবিত্র কোরআন। বলতে দ্বিধা নেই, মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের জীবন ও কর্ম আমাদের পরম গৌরবের স্থায়ী উত্তরাধিকার। প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি। লেখক : প্রাবন্ধিক
×