ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

পদ্মা পারে বর্ণিল উৎসব

শৈশবের আনন্দঘন সময় হরেক আকৃতির ঘুড়ি, দারুণ ওড়াউড়ি

প্রকাশিত: ০৪:২৩, ১০ জানুয়ারি ২০১৫

শৈশবের আনন্দঘন সময় হরেক আকৃতির ঘুড়ি, দারুণ ওড়াউড়ি

মোরসালিন মিজান ॥ সুতো ছিঁড়ে তুমি গোটালে নাটাই/ আমি তো কাঙাল ঘুড়ি,/ বৈরী বাতাসে কী আশ্চর্য/ একা একা আজও উড়ি ...। হ্যাঁ, কোন কোন ঘুড়ি উড়তে উড়তে হঠাৎ একলা হয়ে পড়ছিল। কাটাকাটি খেলায় হেরে দূরে আরও দূরে কোথাও হারিয়ে যাচ্ছিল। বাকিরা উড়ছে শুধু। অজস্র ঘুড়ির ওড়াউড়িতে মুখরিত হয়ে ওঠেছিল পদ্মাপাড়। মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া ফেরিঘাট সংলগ্ন এলাকায় দিনভর ঘুড়ি ওড়ানো উৎসবের আয়োজন করা হয়। গত কয়েক বছর ধরে উৎসবটি আয়োজন করে আসছে বাংলাদেশ ঘুড়ি ফেডারেশন। এবার কক্সবাজারে উৎসব আয়োজনের প্রাথমিক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল। পরে তা পদ্মাপাড়ে স্থানান্তর করা হয়। শুক্রবার সকাল থেকেই এখানে জমে ওঠে উৎসব। ঘুড়ি উৎসব হলেও এর সঙ্গে যোগ করা হয় সুন্দরবন ও সুন্দরবনের বাঘ রক্ষার দাবি। সে দাবি সামনে রেখে উৎসবের সেøাগান ঠিক করা হয়Ñ ‘বনের বাঘ থাকুক বনে, ঘুড়ি উড়ুক নীল গগনে’। অবশ্য ওড়াউড়ি পুরোদমে শুরু হলে পরে আকাশ আর নীল থাকেনি। ঘুড়ির যত রং, যেন গায়ে মেখেছিল আকাশ। দেশী-বিদেশী একগুচ্ছ ঘুড়ি উড়িয়ে উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন। পর্বটি এতো আকর্ষণীয় ছিল যে, ছেলে বুড়ো সকলেই উপভোগ করেছেন। এ সময় আকাশের দিকে চোখ তুলে তাকাতেই দেখা যায় ২০টি বাঘ! রয়েল বেঙ্গল টাইগাররা ঘুড়ি হয়ে উড়ছে! বাতাসে শরীর দুলছে তাদের। দেখে মনে হয় এক একটি জ্যান্ত বাঘ! কিছুটা ফানুসের মতো করে এই ঘুড়ি তৈরি করা হয়েছিল। বাঘের থাবার আকৃতি নিয়ে আকাশে ওড়ে আরও ২০টি ঘুড়ি। বাকি ২০টির ফুলের আকৃতি। নামÑ পুষ্প ঘুড়ি। এসব ঘুড়ির ওড়াউড়ি মুহূর্তেই বদলে দেয় পরিবেশ। মন কেমন চঞ্চল হয়ে ওঠে। উৎসবে যোগ দিয়েছিলে বহু ঘুড়িপ্রেমী মানুষ। সকলেই মনের আনন্দে ঘুড়ি ওড়ান। পকেট কাইট, স্ট্যান্ট কাইট, ড্রাগন কাইট, সিরিজ কাইট, ট্রেন কাইট, ডেলটা ও কমপ্লেক্স কাইটÑ কত কত নাম! আকার আকৃতির দিক থেকেও ভিন্নতা ছিল। কোনটি দেখতে কৈশোরে ক্লাসরুমে বানানো এরোপ্লেনের মতো। কাগজের এরোপ্লেন খুব দূর দিয়ে উড়তে পারতো না। এখানে তারা গতি পেয়েছে। কিছু ঘুড়ি বড়সড়ো পাখির মতো দেখতে। পাখির গড়ন। পাখির মতো করে শরীর আঁকা। কোন কোন ঘুড়ির দিকে তাকিয়ে টিকটিকি ছাড়া কিছু মনে হয়নি। এভাবে বিচিত্র সব ঘুড়ির প্রদর্শনী হয়েছে আকাশে। বিশেষ করে তরুণীরা বাচ্চারা মিশে গিয়েছিল উৎসবের সঙ্গে। দারুণ মজা করে তাঁরা ঘুড়ি উড়িয়েছে। একটি পর্ব ছিল শুধু কাটাকাটি খেলার। গ্রামীণ ঐতিহ্যের এই খেলা বেশ উত্তেজনা ছড়াতে সক্ষম হয়। উড়ন্ত ঘুড়ির নাটাই হাতে খেলায় অংশ নেন দক্ষ ব্যক্তিরা। তাঁরা নিজের ঘুড়ির সুতোর সঙ্গে অন্যটির সুতো প্যাঁচিয়ে নিয়ে কৌশলে টান দেন। কখনও দ্রুত সুতো ছাড়েন। ছাড়তেই থাকেন। এরই এক পর্যায়ে একটি টিকে থাকে। অন্যটি সুতো থেকে বিচ্ছিন্ন হয় দূরে হারিয়ে যায়। এভাবে রোমাঞ্চকর হয়ে ওঠে কাটাকাটি খেলা। আকাশের পাশাপাশি নিচেও ছিল ব্যতিক্রমী সব আয়োজন। অভিনব বাঘ সিংহ ও ড্রাগন নৃত্য উৎসবে নতুন মাত্রা যোগ করে। মানুষই নাচে বটে। তবে তাদের কারও মুখ দেখা যায় না। ফলে সকলের নজর কাড়ে এ নৃত্য। সন্ধ্যায় নতুন চেহারা পায় উৎসব। এ সময় ওড়ানো ঘুড়ি বিশেষ আলো ছড়ায় আকাশে। বাতির মতো জ্বলে। ঘুড়ির সঙ্গে যুক্ত হয় রঙিন ফানুসও। আয়োজকরা মঙ্গল প্রদীপ জ্বালান। নদীর তীরে আলপনা করেন। সব মিলিয়ে অন্যরকম একটি দিন। উৎসব প্রসঙ্গে পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, ঘুড়ি আমাদের গ্রামীণ সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ। এ ধরনের উৎসব ঐতিহ্যটিকে বাঁচিয়ে রাখতে ভূমিকা রাখবে। ২০১৬ সালকে পর্যটন বর্ষ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, সেখানে ঘুড়ি বিশেষ গুরুত্ব পাবে। আয়োজন সম্পর্কে ঘুড়ি ফেডারেশনের সভাপতি এ আর রহমান বলেন, ঘুড়ি আমাদের ঐতিহ্য। ঘুড়ি আমাদের শৈশব। একে বাঁচিয়ে রাখতেই উৎসবের আয়োজন। ভবিষ্যতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুড়ি উৎসব ছড়িয়ে দেয়া হবে বলে জানান তিনি।
×