ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আন্তর্জাতিক চাপ, বিশ্ব এজতেমা কোন কিছুই হতাশ নেত্রীকে থামাতে পারছে না

বিএনপি অবরোধ পালনে যে কারণে মরিয়া

প্রকাশিত: ০৪:২০, ১০ জানুয়ারি ২০১৫

বিএনপি অবরোধ পালনে যে  কারণে মরিয়া

শরীফুল ইসলাম ॥ ইসলাম ও ধর্মীয় মূল্যবোধের কথা বলে রাজনীতি করে শুক্রবার ও বিশ্ব এজতেমার দিনে অবরোধ কর্মসূচী পালন করে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে বিএনপি। ৬ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া টানা অবরোধের কারণে এজতেমায় আগত দেশী-বিদেশী মুসল্লিরা পথে পথে দুর্ভোগের শিকার হয়েছে। শুক্রবার দিনভর দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত মুসল্লিরা বিএনপি-জামায়াতের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। এদিকে টানা অবরোধ ডেকে কেন্দ্রীয় নেতারা মাঠে নামলেও পিকেটারদের দিয়ে নাশকতা চালিয়ে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করায় দেশী-বিদেশী বিভিন্ন মহলের চাপের মুখে পড়েছে বিএনপি। এমনকি দলের একটি অংশও বিএনপি হাইকমান্ডের প্রতি নাখোশ হয়েছে। তারপরও লন্ডন থেকে দেয়া বিএনপির সিনিয়র ভাইসচেয়ারম্যান তারেক রহমানের কঠোর নির্দেশনার কারণেই বিএনপি এ কর্মসূচী অব্যাহত রেখেছে। জানা যায়, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত অবরোধ কর্মসূচী পালন করে আপাতত স্থগিত করে এজতেমার পর আবার অবরোধ কর্মসূচী চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে মতামত দিয়েছিল বিএনপির একটি অংশ। কিন্তু লন্ডন থেকে দলের সিনিয়র ভাইসচেয়ারম্যান তারেক রহমান ও দেশে অবস্থান করা তার অনুসারীরা খালেদা জিয়াকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন এ যাত্রায় আন্দোলন থেকে পিছু হটলে নেতাকর্মীদের মনোবল দুর্বল হওয়ার পাশাপাশি দলের দুর্বলতাও প্রকাশ পাবে। তাই যে কোন কিছুর বিনিময়ে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। আর এ আন্দোলনের মাধ্যমেই দলের প্রকৃত নেতাকর্মীদের পরীক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে তাদেরই পদপদবীর ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিতে হবে। তারেক রহমান ও তাঁর অনুসারীদের অনুরোধেই অতীতে ধর্মীয় বিষয়ে বড় ধরনের ছাড় দিলেও শেষ পর্যন্ত বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কঠোর অবস্থানে গিয়ে শুক্রবার ও এজতেমার দিনে অবরোধ কর্মসূচী চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। অপর একটি সূত্র জানায়, এজতেমাকে কোন সময়ই ভাল চোখে দেখে না ২০ দলীয় জোটে বিএনপির শরিক দল জামায়াত। কারণ, এজতেমার আয়োজক ও অরাজনৈতিক চেতনায় বিশ্বাসী তবলীগ জামাতের সঙ্গে জামাতের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব রয়েছে। উভয়েই ইসলামের নামে রাজনীতি করলেও কেউ কাউকে সহ্য করতে পারে না। এ কারণেই এবার সুকৌশলে জামায়াত বিএনপি হাইকমান্ডকে দিয়ে এজতেমার সময় অবরোধ চালিয়ে তবলীগ জামাতকে কোণঠাসা করার চেষ্টা চালিয়েছে বলে তবলীগ জামাতপন্থী লোকেরা অভিযোগ করেছেন। জানা যায়, ২০ দলীয় জোটের ক’টি শরিক দল এবং গাজীপুর জেলা বিএনপির কিছু নেতা ক’দিন আগেই বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার কাছে বার্তা পাঠিয়েছিলেন এজতেমা চলাকালে যেন অবরোধ কর্মসূচী না রাখা হয়। বিএনপিপন্থী কিছু বুদ্ধিজীবীও খালেদা জিয়াকে অনুরোধ করেছিলেন অবরোধ স্থগিত করার জন্য। কিন্তু বৃহত্তর আন্দোলনের স্বার্থেই তিনি শুক্রবার এজতেমার সময়ও অবরোধ কর্মসূচী চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে অনড় অবস্থানে গেছেন। বিএনপির পক্ষ থেকে গণতন্ত্র ও ভোটের অধিকারের স্বার্থে বর্তমান সরকারের পতন ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে টানা হরতাল পালন করলেও এ কর্মসূচীর ফল এখনও বিএনপির পক্ষে আসেনি। বরং ৪ দিনের অবরোধে অন্তত ৮ জন মানুষের প্রাণহানি কয়েক হাজার যানবাহন ভাংচুর এবং অর্ধসহস্রাধিক গাড়ি জ্বালাও-পোড়াওসহ বিভিন্ন নাশকতামূলক কর্মকা-ের মাধ্যমে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করা ছাড়া জাতিকে আর কিছুই দিতে পারেনি। সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য টানা অবরোধ কর্মসূচী পালন করলেও শুক্রবার ও এজতেমার দিনে অবরোধ চালিয়ে উল্টো বিএনপিই রাজনৈতিক দেওলিয়াত্ব প্রকাশ পেয়েছে। তাদের এ কর্মসূচী পালনের প্রতিবাদে সারাদেশে নিন্দার ঝড় উঠেছে। কেউ কেউ এমনও বলছে, ইসলামের নামে রাজনীতি করে বিএনপি-জামায়াত কি করে শুক্রবার ও এজতেমার দিনে অবরোধ কর্মসূচী পালন করেছে? প্রসঙ্গত, টঙ্গীর তুরাগ তীরে শুক্রবার থেকে শুরু হওয়া প্রথম দফার এজতেমায় যোগ দিতে বিশ্বের অর্ধশতাধিক দেশ থেকে কয়েক হাজার মুসল্লি এসেছেন। বিএনপির ডাকা অবরোধের কারণে তাঁরা বিমানবন্দরে নেমেই এজতেমা মাঠে যেতে বিড়ম্বনার মধ্যে পড়ছেন। অনেক বিদেশী মুসল্লি এবার খোঁজখবর নিয়ে আতঙ্কের কারণে এজতেমায় আসতে চাচ্ছে না বলেও জানা যায়। তবে অবরোধ না থাকলে ১৬ জানুয়ারি থেকে দ্বিতীয় দফায় অনুষ্ঠিতব্য এজতেমায় যোগ দিতে চাচ্ছেন। এ ছাড়া অবরোধের কারণে যানবাহন চলাচল সীমিত থাকা এবং নাশকতার আশঙ্কায় দেশের বিভিন্ন জেলা থেকেও এবার মুসল্লিরা কম আসছে। আর এ কারণেই এজতেমার আয়োজকদের মধ্যে বিএনপি-জামায়াত সম্পর্কে চরম ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। তবে এজতেমার আয়োজক তবলীগ জামাত অরাজনৈতিক সংগঠন হওয়ায় তাঁরা প্রকাশ্যে প্রতিবাদ না করলেও পরোক্ষভাবে বিভিন্ন মাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ অব্যাহত রেখেছে বলে জানা গেছে। সূত্র মতে, বিএনপি সরকারবিরোধী আন্দোলনে ব্যর্থ বিভিন্ন মহলের কাছ থেকে এমন সমালোচনার মুখে দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াও ক্ষেপে গেছেন। তাই মরণ কামড় দিয়েই আন্দোলনের প্রস্তুতি নিয়েছেন। এ জন্য ৫ জানুয়ারি থেকে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতে তিনি ২দিন আগেই গুলশানের বাসা থেকে বের হয়ে এসেছেন। তার টার্গেট ছিল ৩ জানুয়ারি রাতে নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অসুস্থ দলের যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীকে দেখতে গিয়ে সেখানেই থেকে যাওয়া এবং আন্দোলন সফল না হওয়া পর্যন্ত কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের দ্বিতীয় তলায় তাঁর নিজ কক্ষেই অবস্থান করা। কিন্তু তাঁর কৌশলটি টের পেয়ে যায় গোয়েন্দা সংস্থা। তাই গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে খালেদা জিয়াকে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যেতে বাধা দিয়ে রুহুল কবির রিজভীকে এ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করে দেয় পুলিশ। সেই সঙ্গে তাঁরা কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে ওই এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করে। এ অবস্থায় ওই রাত থেকে খালেদা জিয়া গুলশান কার্যালয়েই থেকে যান। এখনও তিনি সেখানে থেকেই প্রতিদিন বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে অবরোধ কর্মসূচী সফল কারার আহ্বান জানাচ্ছেন। গুলশান কার্যালয় থেকে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া এবং লন্ডন থেকে সিনিয়র ভাইসচেয়ারম্যান তারেক রহমান অবরোধ সফল করতে দলীয় নেতাকর্মীদের দফায় দফায় নির্দেশ দিলেও গ্রেফতার এড়াতে কেন্দ্রীয় নেতারা মাঠে না নামায় তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরাও এ কর্মসূচী পালনে সাড়া দিচ্ছে না। তবে বিচ্ছিন্নভাবে কোন কোন এলাকায় বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের কিছু ত্যাগী তৃণমূল নেতাকর্মী রাজপথে নেমে অবরোধের পক্ষে ঝটিকা মিছিল করে ককটেল ফাটিয়ে বা যানবাহন ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে পুলিশের গ্রেফতার এড়াতে মুহূর্তেই উধাও হয়ে যায়। তবে তাদের এ কর্মকা-ের ফলে রাজপথে চলাচলকারী যে সব লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয় তারা বিএনপি-জামায়াতের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়। তাই টানা অবরোধ কর্মসূচী পালন করতে গিয়ে বিএনপি-জামায়াত জনগণের কাছে নিন্দার পাত্র হচ্ছে। শুক্রবার বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, বিশ্ব এজতেমাও চলছে অবরোধও চলবে। তবে এজতেমার মধ্যে অবরোধ কর্মসূচী পালন নিয়ে আওয়ামী লীগ যে অপপ্রচার চালাচ্ছে তা ভ-ামি। তিনি বলেন, এ সরকারকে পদত্যাগ করতেই হবে। সরকার পদত্যাগ না করা পর্যন্ত রাজপথ, রেলপথ ও নৌপথে অবরোধ কর্মসূচী চলবে। সর্বশক্তি চালিয়ে তিনি দলের নেতাকর্মীদের অবরোধ কর্মসূচী চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান। জাতীয় প্রেসক্লাবে এক অনুষ্ঠানে এজতেমার সময় অবরোধ কর্মসূচী সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, বিএনপি ধর্মের নামে রাজনীতি করে। বিশ্বের লাখো মুসলমানের সমাবেশ বিশ্ব এজতেমায় সন্ত্রাস ও অরাজকতা করে মুসলিমদের মনে আতঙ্ক তৈরি করছে। এর জবাব মুসলিম উম্মাহ দেবে। আর টঙ্গী আহসান উল্লাহ মাস্টার স্টেডিয়ামে পুলিশ কন্ট্রোল রুমের সামনে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, বিএনপির অবরোধের কারণে মুসলিমদের এজতেমা ময়দানে আসতে অনেক সমস্যা হয়েছে। অবরোধের কারণে তাঁদের যে কষ্ট হয়েছে তা দুঃখজনক। যাদের কারণে এজতেমায় আসতে মুসলিদের কষ্ট হচ্ছে তাদের শাস্তি হওয়া উচিত।
×