ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আল্লাহ্ নৈকট্য লাভে তুরাগ তীরে মুসল্লিদের ঢল

প্রকাশিত: ০৪:১৫, ১০ জানুয়ারি ২০১৫

আল্লাহ্ নৈকট্য লাভে তুরাগ তীরে মুসল্লিদের ঢল

ফিরোজ মান্না/মোস্তাফিজুর রহমান টিটু/নুরুল ইসলাম, টঙ্গী থেকে ॥ সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিমের’ প্রবক্তা সামরিক জান্তা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক দল বিএনপি আজ সেই বিসমিল্লাহর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। একটি ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে প্রথম সাম্প্রদায়িক সংবিধানে রূপদানকারী বিএনপি ধর্মের দোহাই দিয়ে দীর্ঘকাল রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে জামায়াতসহ স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তারা ইসলামের নামে রাজনীতি করে ঠিকই। কিন্তু মনেপ্রাণে ইসলামবিরোধী কর্মকা- করাই তাদের কাজ। ইসলাম ইসলাম করে মুখে ফেনা তুলে দেশের মানুষের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ তৈরি করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করেছে। ধর্মের নামে সমাজের মানুষকে বার বার ধোঁকা দিয়ে চলেছে তারা। বিএনপি-জামায়াতের এই ধোঁকাবাজির জ্বলন্ত প্রমাণ টঙ্গীর তুরাগ তীর। তুরাগ তীরে শুক্রবার থেকে শুরু হয়েছে মুসলিম উম্মাহর দ্বিতীয় বৃহত্তম ইসলামী জমায়েত বিশ্ব এজতেমা। এই স্থানে প্রতিবছর ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা জমায়েত হয়ে সৃষ্টিকর্তার এবাদত-বন্দেগীতে মশগুল থাকেন। সেই এবাদত-বন্দেগীতে বাদসেঁধেছে বিএনপি জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোট। অবরোধ-হরতাল দিয়ে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের তীর্থস্থানকে অকার্যকর করার চেষ্টা চালানো হয়েছে। কিন্তু কোন বাধাই ধর্মপ্রাণ মানুষকে আটকাতে পারেনি। তারা শত ভোগান্তি মাথায় নিয়ে তুরাগ তীরে জমায়েত হয়েছেন সৃষ্টিকর্তার নৈকট্য লাভের আশায়। বিএনপি-জামায়াতের দেয়া অবরোধ-হরতাল কর্মসূচী উপেক্ষা করে টঙ্গীর তুরাগ তীরে দেশের ৩৩টি জেলার মুসল্লিরা সমবেত হয়েছেন। নানা ভোগান্তি নিয়ে মুসল্লিরা এজতেমা প্রাঙ্গণে এসে জমায়েত হয়েছেন। বিদেশী মুসল্লিরাও যোগ দিয়েছেন বিশ্ব এজতেমায়। পুলিশ, র্যাব পাহারায় মুসল্লিরা হেঁটে এজতেমা ময়দানে হাজির হয়েছেন। তবু বিএনপি-জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোট অবরোধ-হরতাল চালিয়ে যাচ্ছে। ধর্মের প্রতি এতটুকু শ্রদ্ধাবোধ না রেখে বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী গোপন স্থান থেকে ভিডিও বার্তা পাঠিয়ে অবরোধ কর্মসূচী চালিয়ে যাওয়ার জন্য দলীয় নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন। সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত এই অবরোধ চলবে বলে ওই ভিডিও বার্তায় বলা হয়েছে। এই ঘোষণার পর মুসল্লিদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও ঘৃণার জন্ম নিয়েছে। বিএনপির এমন ঘোষণায় তারা হতবাক হয়েছেন। অবরোধের কারণে এ বছরের এজতেমায় মুসল্লিদের উপস্থিতি গতবারের তুলনায় কিছুটা কম হয়েছে। বিএনপি-জামায়াতের শত বাধার মুখেও ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা বিশ্ব এজতেমা ময়দানে হাজির হয়েছেন সৃষ্টিকর্তার নৈকট্য লাভের জন্য। শুক্রবার ফজরের নামাজের পর আম বয়ানের মধ্য দিয়ে বিশ্ব এজতেমার প্রথম পর্ব শুরু হয়েছে। রবিবার আখেরী মোনাজাতের মধ্য দিয়ে প্রথম পর্বের এজতেমার কার্যক্রম শেষ হবে। শুক্রবার সারাদিনই নজিরবিহীন পাঁচ স্তরের নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে টঙ্গীর তুরাগ তীরে তবলীগ জামাতের বিশ্ব এজতেমার কার্যক্রম চলতে দেখা যায়। এজতেমা ময়দান এলাকায় অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে মাঠজুড়ে ৬০টির বেশি সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। শুক্রবার প্রথম দিনে বাদ ফজর থেকে আম বয়ানের মধ্য দিয়ে বিশ্ব এজতেমার আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়। এজতেমার শুরুর দিন জুমার নামাজে অংশ নিতে এজতেমাস্থলে মুসল্লিদের ঢল নামে। এজতেমা প্যান্ডেল কানায় কানায় ভরে যায়। প্যান্ডেলের নিচে জায়গা না পেয়ে মুসল্লিরা অংশ নেন ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ওপরে। জুমার নামাজে অংশ নিতে সকাল থেকেই টঙ্গী ও আশপাশ এলাকার হাজার হাজার ধর্মপ্রাণ মানুষ ছুটে আসেন এজতেমা ময়দানে। শুক্রবার বাদ ফজর পাকিস্তানের মাওলানা মোঃ এহসান আম বয়ানের মাধ্যমে এবারের বিশ্ব এজতেমার সূচনা করেন। এ বয়ান বাংলায় তরজমা করেন বাংলাদেশের মুরুব্বি মাওলানা মোঃ আব্দুল মতিন। অন্যান্য বছরের মতো এবারও উপস্থিত লাখ লাখ মুসল্লির উদ্দেশে যথারীতি ইমান, আমল, আখলাক ইত্যাদি বিষয়ে আম বয়ানের মাধ্যমে এজতেমার প্রথম পর্বের তিন দিনের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আগামী রবিবার জোহরের নামাজের আগে আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে প্রথম পর্বের সমাপ্তি ঘটবে। এরপর চার দিন বিরতি দিয়ে আবার আগামী ১৬ জানুয়ারি শুক্রবার থেকে শুরু হবে দ্বিতীয় পর্বের তিন দিনব্যাপী বিশ্ব এজতেমা। প্রথম পর্বের বিশ্ব এজতেমার প্রথম দিনে জুমার জামাতকে কেন্দ্র করে টঙ্গীতে মুসল্লিদের ঢল নামে। জুমার মূল জামাত এজতেমা ময়দান ছাড়িয়ে আশপাশের সড়ক-মহাসড়ক পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর স্থাপিত ৮টি ভাসমান ব্রিজের মাধ্যমে মেহরাবের সঙ্গে নদীর পূর্ব পাড়ের মূল ময়দানের সেতুবন্ধ স্থাপিত হয়। ফলে এ বছর ভাসমান সেতুতেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মুসল্লি জুমার জামাতে শরিক হন। জুমার জামাতে ইমামতি করেন কাকরাইল মারকাজ মসজিদের পেশ ইমাম হাফেজ মাওলানা জোবায়ের। শুক্রবার জুমার আগ পর্যন্ত বিশ্বের ৫৫টি দেশের প্রায় ৭ হাজার মুসল্লি এজতেমায় অংশ নিয়েছেন। অন্যান্য বছরের ন্যায় এবারও সমবেত লাখ লাখ মুসল্লির উদ্দেশে তবলীগের ৬ উসুল অর্থাৎ কালেমা, নামাজ, এলেম ও জিকির, একরামুল মুসলিমিন, সহীহ নিয়ত ও তবলীগ ইত্যাদি বিষয়ে আম বয়ানের মাধ্যমে এজতেমার প্রথম পর্বের তিন দিনের কার্যক্রম শুরু হয়। আজ শনিবার বাদ আছর প্রতিবছরের মতো যৌতুকবিহীন বিয়ে সম্পন্ন করা হবে বলে এজতেমা সূত্রে জানা গেছে। এসব বিয়ে বর ও উভয়পক্ষের অভিভাবকদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হবে। এ উপলক্ষে বর ও কনের নাম তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে। প্রথম দিনে যারা বয়ান করলেন ॥ ইমান-আমলের ওপর প্রথম দিন বাদ ফজর বয়ান করেন পাকিস্তানের মাওলানা মোঃ এহসান। বাংলায় তরজমা করেন বাংলাদেশের মুরুব্বি মাওলানা মোঃ আব্দুল মতিন। বাদ জুমা বয়ান করেন ভারতের মাওলানা শওকত, বাদ আছর বয়ান করেন বাংলাদেশের কাকরাইল মসজিদের খতিব হাফেজ মোহাম্মদ জোবায়ের ও বাদ মাগরিব দিল্লীর মাওলানা সা’দ বয়ান করেন। বিশ্ব এজতেমার আয়োজক কমিটির মুরুব্বি প্রকৌশলী গিয়াসউদ্দিন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। জুমার নামাজে ভিআইপিদের অংশগ্রহণ ॥ ইজতেমার প্রথম দিনে জুমার নামাজে অংশ নেন প্রধান বিচারপতি মোঃ মোজাম্মেল হোসেন, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সংসদ সদস্য জাহিদ আহসান রাসেল, সাবেক আইনমন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরু, গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহ খান, ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি এসএম মাহফুজুল হক নুরুজ্জামান, গাজীপুরের পুলিশ সুপার হারুন অর রশীদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ এবং সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। অবরোধ প্রত্যাহারের অনুরোধ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর ॥ এজতেমা মাঠে জুমার নামাজে অংশ নিতে এসে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী এ্যাডভোকেট আ ক ম মোজাম্মেল হক এমপি বিএনপিকে অবরোধ প্রত্যাহারের অনুরোধ জানিয়ে বলেন, অবরোধের কারণে মুসল্লিদের এজতেমা ময়দানে আসতে অনেক সমস্যা হচ্ছে। তারপরও বহু কষ্ট করে কিছুদূর হেঁটে, কিছুদূর গাড়িতে করে নানা প্রতিকূলতা অতিক্রম করে মুসল্লিরা এজতেমা মাঠে এসে পৌঁছেছেন। মুসল্লিদের সুবিধার্থে আমরা বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করেছিলাম। কিন্তু রেললাইন উপড়ে ফেলা হয়েছে। বর্তমানে তা দ্রুত মেরামতের কাজ চলছে। মুসল্লিদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করছি। অবরোধের কারণে তাদের যে কষ্ট হয়েছে তা অত্যন্ত দুঃখজনক। অবরোধ প্রত্যাহার করার জন্য বিএনপির প্রতি অনুরোধ জানাই। তিনি বলেন, এজতেমায় মুসল্লিদের আসার জন্য সরকার রাস্তায় ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছে। হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা ॥ টঙ্গী হাসপাতাল ও সিভিল সার্জনের তত্ত্বাবধানে তিনটি মেডিক্যাল ক্যাম্পে শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত গত দু’দিনে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত প্রায় তিন হাজার মুসল্লি চিকিৎসা নিয়েছেন। এরমধ্যে নয়জনকে ঢাকায় রেফার্ড করা হয়েছে এবং ছয়জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। অসুস্থদের অধিকাংশই ঠা-া, সর্দি, কাশি, আমাশয়, শ্বাসকষ্ট ও হৃদরোগের রোগী। এছাড়াও শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত ঠা-া, জ্বর ও পেটের পীড়ায় আক্রান্ত ৭১ জন অসুস্থ মুসল্লিকে টঙ্গী হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়েছে। বিদেশী মুসল্লি ॥ এজতেমার প্রথম পর্বে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত এজতেমা মাঠে ৫৫টি দেশের চার হাজার ৯শ’ ৮২ জন বিদেশী মুসল্লির আগমন ঘটেছে। এবারের এজতেমায় বিশ্বের অন্তত ১৪৪টি দেশ থেকে প্রায় ২০ হাজার মুসল্লির আগমন ঘটবে বলে আশা করছেন এজতেমার মুরুব্বিরা। ভ্রাম্যমাণ আদালত ॥ এজতেমা মাঠের আশপাশ এলাকায় হোটেল-রেস্তোরাঁর বৃহস্পতিবার সকাল থেকে শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়ে সাড়ে ৪৪ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করেছেন। জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণকক্ষ সূত্রে জানা গেছে, টঙ্গী বিশ্ব এজতেমা মাঠের আশপাশ এলাকায় প্রতিদিন দুই শিফটে মোট ১০টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হয়। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে খাদ্যে ভেজাল এবং ক্ষতিকর খাদ্যদ্রব্য রাখা ও বিক্রয়ের অভিযোগে বিশুদ্ধ খাদ্য আইনে পৃথক ১৬টি মামলা ও সাড়ে ৪৪ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এরমধ্যে বৃহস্পতিবার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মশিউর রহমান খান চারটি মামলায় সাড়ে ছয় হাজার টাকা এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রেবেকা সুলতানা ছয়টি মামলা ও ৩১ হাজার টাকা জরিমানা করেন। এছাড়াও শুক্রবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুর রউফ তালুকদার তিনটি মামলা ও চার হাজার টাকা এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ যুবায়ের তিনটি মামলা ও তিন হাজার টাকা জরিমানা করেন। মিডিয়ার জন্য ফ্রি ওয়াইফাই ॥ টঙ্গীর শহীদ আহসান উল¬াহ মাস্টার স্টেডিয়ামে পুলিশের কন্ট্রোলরুমের পাশাপাশি এবার মিডিয়া সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। গাজীপুর জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে মিডিয়াকর্মীদের জন্য ফ্রি ওয়াইফাইয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। গাজীপুরের পুলিশ সুপার মোঃ হারুন অর রশিদ জানান, সংবাদ সংগ্রহে আসা সংবাদকর্মীদের জন্য একটি মিডিয়া সেন্টার ও সেখানে বিনামূল্যে ইন্টারনেট ব্যবহারের (ফ্রি ওয়াইফাই জোন) ব্যবস্থা করা হয়েছে এ বছর।
×